মরাঠি অস্মিতা নিয়ে সমগ্র মহারাষ্ট্রবাসী তার স্বরাজ্যের সগর্বে গুণ কীর্তন করে বলেন—
“মঙ্গল দেশা
পবিত্র দেশা
মহারাষ্ট্র দেশা
প্রণাম ধ্যেয়া মাঝা হা
শ্রী মহারাষ্ট্র দেশা...”
নিজের জাত্যাভিমানের জন্য স্বতন্ত্রতা খুব প্রয়োজনীয়। গৌরবের আঁচে সমগ্র মরাঠি সমাজে সবার মধ্যে ছড়িয়ে দিতে পারার এই তাগিদটা সংঙ্ঘবদ্ধ করে দেয় নিশ্চয়ই। ‘মহারাষ্ট্র ডে’ বা ‘মহারাষ্ট্র রাইজিং ডে’ কেবল তো আর ঐতিহাসিক দিবস নয়। এই দিনটা যেন মহারাষ্ট্রবাসীর কাছে একটা প্রাণখোলা দিন। একটা গৌরবের দিন। স্বতঃস্ফূর্ততা উৎসাহ উদ্দিপনার সবটাই এই ১লা মে দিনটাকে ঘিরে।
বিগত ১৬ শতক থেকেই মরাঠা জাগছিল শিবাজির নেতৃত্বে। মোঘল সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে তাঁর লড়াই তো ছিলই। আরও পরে অ্যাংলো-মরাঠা যুদ্ধের পর মহারাষ্ট্রের ছোট ছোট সাম্রাজ্যগুলি ‘বম্বে স্টেট’ হিসেবে ব্রিটিশ রাজ-এর অধীনে চলে আসে। স্বাধীনতার পর ‘সংযুক্ত মরাঠা সমিতি’ দাবি করতে থাকেন— মরাঠা ভাষাভাষি জনগণদের জন্য একটা সম্পূর্ণ নিজস্ব রাষ্ট্র থাকবে।
বাবাসাহেব অম্বেডকরও সেই সময় বলেন যে ‘এক রাষ্ট্র— ক ভাষা’ হিসেবে ভিত্তি করে মরাঠা সাম্রাজ্যকে অধিকার দেওয়ার কথা। বাবাসাহেব এই ব্যাপারে একটি জোরালো স্মারকনামাও পেশ করেন।
জওহরলাল নেহেরু কিন্তু কোনও ভাবেই এটা মানতে চাননি যে কেবল মাত্র ভাষার ভিত্তিতে সদ্য স্বাধীনতা প্রাপ্ত ভারত রাষ্ট্রের, প্রদেশ ভাগের চিন্তাকে। যদিও ১৯৫০ সাল নাগাদ ভাষাগত প্রাদেশিকতার ভিত্তিতে অন্ধ্র কেরল কর্নাটক ততদিনে নিজের পৃথক রাজ্য গড়ে নিয়েছে। সেই হেতু মহারাষ্ট্র গড়ার দাবি মরাঠাবাসীরা তখনও দাবি করে আসছিলেন।
শেষপর্যন্ত কেন্দ্রের অবিচলতার বিরুদ্ধে সমগ্র মরাঠাবাসী জনগণ মনে করতে শুরু করলেন এ বার নিজেদের অধিকার আদায়ের সময় হয়েছে।
“আমছি মহারাষ্ট্রাচে
মহারাষ্ট্রা আমচা”
গেল শতকের ১৯৫৬ সালে ভারতে নতুন প্রণীত সংবিধান আইনে, ‘দ্য স্টেট রিঅর্গানাইজেশন অ্যাক্ট’ এ প্রতিটি রাজ্যকে তাদের মৌখিক ভাষা সংস্কৃতি লোকচারের দিক দিয়ে চিহ্নিত করার সুবিধার্থে পৃথক করার ঘোষণা করা হয়। শেষপর্যন্ত কেন্দ্রের কাছে হস্তক্ষেপ দাবি করার প্রতিবাদে মুম্বইয়ের ফ্লোরা ফাউন্টেনের কাছে সে সময় এক সরকার বিরোধী জমায়েত হয়। যেখানে সরকার পক্ষের পুলিশের গুলিতে শতাধিক লোকের প্রাণ যায়।
অতি দুঃখজনক তথা ন্যাক্কারজনক পরিস্থিতির জন্য মুম্বইয়ের এই ফ্লোরা ফাউন্টেনের শহিদ স্মারক হিসেবে নতুন নামকরণ হয় ‘হুতাত্মা স্মারক’।
“জয় জয় মহারাষ্ট্র মাঝা
করু উদঘোষ হরিৎ ক্রান্তিচাহাস
দালু পর্য্যাওবরণাচা
গর্জা মহারাষ্ট্র মাঝা”
প্রাথমিক ভাবে বম্বে স্টেট নামে সেই সময় যে বৃহৎ অঞ্চলটি পরিচিত ছিল সেখানে অঞ্চলভেদে মোট চার রকম ভাষার ব্যবহার প্রচলন ছিল। সমগ্র অঞ্চলের জনসাধারণ এলাকা বিশেষে নিজেদের জাতি বিশেষে গুজরাতি, কাচ্ছি, মরাঠি ও কোঙ্কনি ভাষায় নিজেদের গোষ্ঠীতে কথোপকথন করতেন।
‘সংযুক্ত মহারাষ্ট্র সমিতি’র উদ্যোগে এই বৃহৎ বম্বে রাজ্যটিকে দুটি ভাগে ভাগ করার লিখিত প্রস্তাবনা পার্লামেন্টে পাঠানো হয়। এই প্রস্তাবনায় স্পষ্ট করে বলা হয়েছে যেখানে গুজরাতি ও কাচ্ছি ভাষার বাহুল্য রয়েছে সেই অঞ্চলটি গুজরাত। এবং বাকি অন্য যে বৃহৎ অঞ্চলটি রয়েছে, সেখানকার মানুষ জন মরাঠি ও কোঙ্কনি ভাষায় কথা বলেন সেই সমগ্র অঞ্চলটির নাম হোক মহারাষ্ট্র। সংযুক্ত মহারাষ্ট্র সমিতির এই লক্ষ্যপূরণ সফল হয়। ১৯৬০ সালের ২৪ এপ্রিল ভারতে সংসদে প্রস্তাবটি প্রথমে গৃহীত হয়। এবং এর ঠিক ছয় দিন পরই ১৯৬০ সালের ১লা মে মহারাষ্ট্র ও গুজরাত দুটি পৃথক রাজ্য হিসাবে স্বীকৃতি লাভ করে। বম্বে রি-অর্গানাইজেশন অ্যাক্টের মাধ্যমে ১লা মে, মুম্বইকে মহারাষ্ট্রের রাজধানী শহর হিসেবেও মাণ্যতা দেওয়া হয়। মহারাষ্ট্রের জনগণ, নিজের স্বরাজ্য পেয়ে খুশি হন। মরাঠাবাসীরা এমনিতেই বেশ উৎসবমুখর থাকতে পছন্দ করেন। তাঁদের প্রতিটি উৎসবই সামাজিক ও সংস্কৃতিক ঐতিহ্যের দ্যোতক। তামাম মহারাষ্ট্রের নাগরিকদের কাছে মহারাষ্ট্র দিবসটাও এক ঝলমলে উৎসবের প্রতীক। তারা উদাত্ত হয়ে বলেন,
“শ্রীখণ্ড পুরি
রেশমী ডোরি
লিম্বা চে পান
নব বর্ষা যাও ছান
আমচা সর্ভনচা
সর্ভনচা তরফে
হার্দিক শুভেচ্ছা”
মরাঠা বীরের জাতি। তাদের যশ তাদের আত্মভিমানও বাড়িয়ে দেয়। মরাঠিদের আবেদন তাঁদের ঋজুতায়, তার বাক্যের স্পষ্টতায়, তাঁর সৃজনশীল নান্দনিকতায়। মহারাষ্ট্রের অসামান্য প্রাণশক্তির কাছে হার মানে আরও কিছু নামজাদা শহরও। মনোরঞ্জন, উন্নতি, প্রগতি সবেতেই মহারাষ্ট্রবাসী যথেষ্ট তুখোর। তারা তাঁদের এই ঐতিহ্য পরম্পরায় যথেষ্ট সংবেদনশীল। তাঁরা বলতে পারেন—
“আমহালা অভিমান আহে
মহারাষ্ট্রীয় অসন্যাচা
আমহালা গর্ব আহে মরাঠি ভাদেয়া
আমহি জপতো আমচি
সংস্কৃতি, আমচি নিষ্ঠা আহে মাতীশী”
১লা মে মহারাষ্ট্রে রাষ্ট্রীয় সরকারি ছুটির দিন এবং এই মহারাষ্ট্র দিবস দিনটি ‘মহারাষ্ট্র রাইজিং ডে’ নামে যথেষ্ট উৎসব উদ্দিপনায় পালিত হয়। ইতিমধ্যেই গত তিন বছর আগেই ২০১১ সালে, দিনটি ‘স্বর্ণজয়ন্তী’ হিসেবে পালিত হয়েছে যথেষ্ট ধুমধামের সঙ্গে। মুম্বইয়ের শিবাজি পার্কে বর্ণাঢ্য কুচকাওয়াজ ও ঐতিহ্যবাহী মরাঠি সাংস্কৃতিক উৎসবের মধ্য দিয়ে দিনটি পালিত হয় প্রতিবছর। রাজ্যের রাজ্যপাল সেনাবাহিনীর প্যারেড-সহ অভিবাদন গ্রহণ করেন। স্যালুট প্রদান করেন স্টেট রিজার্ভ পুলিশ ফোর্স, বৃহম্মুবই ডিফেন্স, ফায়ার ব্রিগেড, সিটি পুলিশ ইত্যাদি। ওই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী-সহ উচ্চপর্যায়ের সমস্ত মন্ত্রী, আমলা ও তাবড় তাবড় রাজনৈতিক নেতারা। প্যারেড কুচকাওয়াজের পর সাংস্কৃতিক নাচ গানের অনুষ্ঠানও হয়। মুম্বইকররা সমস্বরে বলে ওঠেন—
“জয় জয় মহারাষ্ট্রা মাঝা
গর্জা মহারাষ্ট্র মাঝা”
প্রসঙ্গত, এই মহারাষ্ট্র দিবস দিনটিতে আরও একটি বিশেষ সতর্কীকরণ বহাল থাকে সমগ্র মহারাষ্ট্রে। সারা রাজ্যে ১লা মে দিনটি ‘মহারাষ্ট্র দিবসের’ মর্যাদা স্বরূপ কোনও প্রকার মাদক জাতীয় দ্রব্য ও পানীয়ের কঠোর নিষেধাজ্ঞা থাকে।
প্রতি বছরের মতো গত বছরও যথেষ্ট উৎসাহ উদ্দিপনার সঙ্গে দিনটি পালিত হয়েছিল। যুবা প্রজন্মের প্রায় হাজার খানেক মানুষ ‘ড্রাগ ফ্রি’ দিন হিসেবে সচেতনতায় অংশ নিয়েছিলেন। ও দিকে মহারাষ্ট্র রাজ্যেরই পূর্বাঞ্চল বিদর্ভ রাজ্যের কৃষকদের কান্না কিন্তু থেকেই গেছে। বিদর্ভে শতাধিক কৃষক শ্রেণীভুক্ত মানুষ ও তার সঙ্গে বিধবা মহিলারা ওই দিনটিকে পালন করেছিলেন।
পূর্ব মহারাষ্ট্রের বিদর্ভ অঞ্চলের সমস্ত কৃষক শ্রেণি এখনও মনে করেন— মহারাষ্ট্রের যা কিছু উন্নতি ভালোত্ব উন্নয়ন সবটাই ওই মুম্বই ও বৃহম্মুবাই এবং কাছে পিঠের শহরতলি কেন্দ্রিক। বিদর্ভে তারা ক্ষতিগ্রস্থ ও অবহেলিত হচ্ছেন। ‘বিদর্ভের জন আন্দোলনে সমিতি’-এর চিফ কিশোর তেওয়ারি তাঁর ভাষণে সে দিন বলেছিলেন, মহারাষ্ট্র সরকার বিদর্ভে গরিব কৃষক অধ্যুষিত জনগোষ্ঠীকে সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ হয়েছে সর্বত ভাবে। গরিব কৃষিকাজজীবি মানুষদের জন্য ন্যূনতম দরকারি সুযোগসুবিধা দেওয়ার দিকে সরকারের আরও বেশি করে নজর দেওয়া উচিত।
মুম্বই বৃহম্মুবইয়ের রাস্তার মোড়ে বাজারে চোখে পড়ে বিশাল হোর্ডিং ব্যানারে ৫৩তম মহারাষ্ট্র দিবসের আগাম শুভেচ্ছা বার্তা।
“মহারাষ্ট্রা দিনাচ্যা
প্রত্যেক মহারাষ্ট্রীয়
জানালা শুভেচ্ছা”
ভাষা আলাদা হলেও, আমরা যারা ভিন রাজ্য থেকে মুম্বই তথা মহারাষ্ট্রে কর্মসূত্রে বৈবাহিক সূত্রে অথবা জন্মসূত্রে রয়েছি তারাও ৫৩তম মহারাষ্ট্র দিবসের আনন্দ উদ্দিপনার শরিক হয়ে যাই। এমনইতে ১লা মে দিনটা ‘শ্রমিক দিবস’ হিসেবেই পালন করতে দেখে এসেছি এতদিন। মহারাষ্ট্রে এই ‘শ্রমিক দিবসের’ মুকুটে আরও একটা সবেতন ছুটির পালক যুক্ত হয়ে যায়, ‘মহারাষ্ট্র দিবস’ হিসেবে।
এ দিকে তো দেশ জুড়ে ভোটের বাদ্যি। পয়লা বৈশাখ কেটে গেছে হাঁসফাঁস গরমে। খানিক ভালমন্দ খাওয়া দাওয়া। গুরুজনদের প্রণাম, নতুন পোশাক, শুভেচ্ছা বার্তা আদানপ্রদানের হিড়িক থেমে গেছে কবেই। এখন কেবল টিভি খুললেই, খবরের কাগজ খুললেই ভোটের ফিরিস্তি। ভোট জ্বরে কাঁপছে টিভির পর্দা এ চ্যানেল সে চ্যানেল। আমরা সাধারণ মানুষ, কীই বা করার আছে আমাদের। সামনেই নির্বাচন। কাকে যে ভোট দেব। কাকে ভোট দিয়ে লোকতন্ত্রকে রক্ষা করা হবে? কাকে ভোট দেব এমনতর চিন্তায় বেশির ভাগ মানুষই বিভ্রান্ত। মুম্বইয়েও আম আদমি-বিজেপি-শিবসেনা-কংগ্রেস-মনসে (মহারাষ্ট্র নবনির্মাণ সেনা) কত উমিদবার। কাকে ভোট দিয়ে জেতালে কার সঙ্গে কারই বা আঁতাত হবে। শেষপর্যন্ত ভারতের প্রধানমন্ত্রিত্ব কার কাছে থাকবে। দিল্লির সমনদে কোন দলের সরকার গঠন হবে এমন হাজারো প্রশ্ন।
এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেছে পেপসি আই পি এল ২০১৪। চলবে সেই ১লা জুন পর্যন্ত, ফাইনাল ওই দিনই। আপাত কত ভোট রঙ্গ, শ্রমিক দিবস, মহারাষ্ট্র দিবস, বৈশাখ আই পি এল উন্মাদনা নিয়েই রসেবসে উত্তেজনায় কাটুক দিনগুলো...।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy