গবেষণা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বীকৃতি পাওয়ার পরেই অধ্যাপক তাপস পাল ছাত্র জয়জিৎ দেবনাথকে নিয়ে যান উত্তরবঙ্গে বৃহন্নলা সমাজের প্রধান সোনামণি শেখের কাছে। —নিজস্ব চিত্র।
সরকারি ভাবে অনেক ক্ষেত্রে স্বীকৃতি মিললেও বৃহন্নলা সমাজ এখনও মূল স্রোতের বাইরে। অন্য স্রোতে জীবন বইয়ে দেওয়া সেই তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের অনেক সমস্যাই মেনে নিতে হয়। সরকারি বা বেসরকারি ক্ষেত্রে কর্মসংস্থানের অভাব তো রয়েইছে। অনেকে সরকারি প্রকল্পের সুযোগ থেকেও বঞ্চিত। শিক্ষা থেকে স্বাস্থ্য— সবেতেই বিবিধ বাধা। নিম্ন স্তরের আয়, পেশাগত জীবনের হয়রানিও অনেক। এর পরেও অনেকেই সমাজের মূলস্রোতে যুক্ত হওয়ার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু পারছেন কি?
এমন নানা প্রশ্ন নিয়ে রায়গঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল বিভাগ থেকে পিএইচডি শেষ করেছেন গবেষক জয়জিৎ দেবনাথ। আর তাঁর গবেষণায় উঠে এসেছে এমন তথ্য যে, বৃহন্নলা সমাজে শিক্ষাগত মান সাধারণত কম হলেও দার্জিলিঙের বাসিন্দা অনিতা দাস এমবিএ করেছেন। মালদহ জেলার এক জন উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেছেন।
বৃহন্নলাদের নিয়ে সদ্য গবেষণা শেষ করে ডিগ্রি পেয়েছেন জয়জিৎ। তাঁর কথায়, ‘‘আমি যে হেতু ভূগোল বিভাগ থেকে গবেষণা করেছি, তাই আমায় একটা এলাকা চিহ্নিত করতে হয়েছিল। এই পর্বে উত্তরবঙ্গের আটটি জেলা নিয়ে কাজ করেছি। তাতে উঠে এসেছে নানা অজানা তথ্য। উত্তরবঙ্গে বৃহন্নলাদের মাত্র ১.২৭ শতাংশ শিক্ষিত।’’ জেলায় জেলায় বিভিন্ন বৃহন্নলা পল্লিতে গত কয়েক বছর ঘুরেছেন জয়জিৎ। সেই অভিজ্ঞতা থেকেই তিনি জানতে পেরেছেন, বৃহন্নলাদের মধ্যে ধর্মের বিভাজন নেই। সব ধর্মের উপাসনা পদ্ধতি নিয়েই একত্রে বাস করেন তাঁরা। অধিকাংশই হিন্দু। তবে উত্তরবঙ্গে মুসলমান, খ্রিস্টান ও বৌদ্ধ ধর্মালম্বী বৃহন্নলার খোঁজও মিলেছে। এমন বিষয় নিয়ে কেন গবেষণা? জবাবে জয়জিৎ জানান, তাঁর গবেষণার তত্ত্বাবধায়ক (গাইড) অধ্যাপক তাপস পালই বিষয় নির্বাচন করে দিয়েছিলেন।
প্রসঙ্গত, রায়গঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক তাপস অতীতেও বিষয় নির্বাচনে এমন অভিনত্ব দেখিয়েছেন। তাঁর তত্ত্বাবধানেই কণা সরকার নামে এক ছাত্রী ‘গ্রামীণ চপশিল্প এবং সংসার পরিচালনায় তার প্রভাব’ নিয়ে গবেষণা করেছিলেন। এ বার উত্তরবঙ্গে বৃহন্নলাদের আর্থ সামাজিক, সাংস্কৃতিক অবস্থান জানার পাশাপাশি তাঁরা কেমন রয়েছেন, সেটাই ছিল গবেষণার বিষয়। বিষয় নির্বাচন নিয়ে অধ্যাপক তাপসের বক্তব্য, ‘‘সুপ্রিম কোর্ট ২০১৪ সালেই বৃহন্নলাদের তৃতীয় লিঙ্গ হিসাবে বিবেচনা করার কথা বলেছে। তবুও অনেক কিছুতেই তাঁরা আলাদা। সাধারণ নারী আর বৃহন্নলাদের ধর্ষণে অভিযুক্তের শাস্তিতেও অনেক ফারাক। প্রশাসনের কাছে কোথায়, কত মানুষ এই সম্প্রদায়ের রয়েছেন, সে ভাবে তার কোনও হিসাবও নেই। এই গবেষণা সেই কাজটা করে দিয়েছে উত্তরবঙ্গের জন্য।’’ তাঁর কথায়, বাংলায় তো বটেই, গোটা দেশেই এই সমাজের জন্য আলাদা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নেই। তাঁদের সন্তানেরাও তাই সাধারণ স্কুলে গিয়ে হেনস্থার শিকার হয়। আর কাজকর্মের সুযোগ তো নেই-ই। ফলে পরিব্রাজক হয়ে বাড়ির দরজায় দরজায় ঘুরতে হয়। তাপসের বক্তব্য, ‘‘বৃহন্নলারা যে প্রান্তিক এলাকায় বাস করেন, তা এই গবেষণায় স্যাটেলাইট মানচিত্রের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে। তাঁরা এতটাই ভয়ে ভয়ে থাকেন যে, অনেকে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালেও যান না। তাঁদের সন্তানেরা মানসিক ভাবে দুর্বল হয়ে যায় শৈশব থেকেই। এঁদের জন্য কোনও বৃদ্ধাশ্রমও নেই।’’
গবেষক জয়জিৎ জানান, তাঁর সঙ্গে প্রতিটি আখড়ায় গিয়েছেন তাঁর অধ্যাপক তাপস। এমনকি, আগামী দিনে কোপাই নদীর পারে বৃহন্নলাদের জন্য আলাদা বিদ্যালয় তৈরির পরিকল্পনাও করেছেন। তাপস বলেন, ‘‘কয়েক বছর ধরে কাজটা করতে করতে, সমস্যাগুলো দেখতে দেখতে আমি মনে মনে একটা ব্রত নিয়ে ফেলেছি। ঈশ্বর চাইলে কাজটা ঠিক করে ফেলব।’’
গবেষণা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বীকৃতি পাওয়ার পরেই তাপস ছাত্র জয়জিৎকে নিয়ে গিয়েছিলেন উত্তরবঙ্গে বৃহন্নলা সমাজের ‘রানি বড়মা’ হিসাবে পরিচিত সোনামণি শেখের কাছে। সে কথা জানিয়ে সোনামণি বলছিলেন, ‘‘আমার তো খুব ভাল লেগেছে। ওঁরা গবেষণার বইটাও দিয়ে গিয়েছেন আমায়। আমরা সকলে সম্মানিত।’’ আর তাপস বলছেন, ‘‘আমি চাই এঁদের ভিক্ষুকের জীবন শেষ হোক। মুঘল যুগে বৃহন্নলাদের কর আদায়কারী হিসাবে কাজে লাগানো হত। এখনও করসংগ্রাহক হিসাবে তাঁদের নিয়োগ করা যায় কি না, সেটা ভেবে দেখা যেতে পারে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy