Advertisement
০২ নভেম্বর ২০২৪
Mumps

বাড়ছে মাম্পস, বাড়াচ্ছে উদ্বেগ

হাঁচি, কাশির ড্রপলেটের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে মাম্পস ভাইরাস। এর প্রকোপ কমাতে দরকার সচেতনতা।

—প্রতীকী চিত্র।

—প্রতীকী চিত্র।

কোয়েনা দাশগুপ্ত
শেষ আপডেট: ১৮ মে ২০২৪ ০৮:৫০
Share: Save:

শহর থেকে জেলা, রাজ্য থেকে দেশ, বাড়ছে মাম্পস রোগীর সংখ্যা। ক্রমশ সরকারি হাসপাতাল, বেসরকারি নার্সিংহোমে ইন্টেনসিভ কেয়ার ইউনিটে (আইসিইউ) বাড়ছে রোগীর সংখ্যা। শুধু এ রাজ্যে নয়, কেরল, মহারাষ্ট্র, দিল্লি, গুজরাত... সব জায়গাতেই বেড়েছে মাম্পসের দাপট। চিকিৎসকদের কথায়, ক্রমশ দেশ জুড়ে বিপজ্জনক এক পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে। দরকার দ্রুত পদক্ষেপ ও সচেতনতা।

মাম্পস কী?

মাম্পস আদতে ভাইরাল সংক্রমণ। সাধারণত বাচ্চারাই এতে আক্রান্ত হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এখন রোগীর বয়স দুই থেকে দশ। প্রাথমিক ভাবে এই ভাইরাস প্যারোটিড গ্রন্থি-সহ বিভিন্ন লালা গ্রন্থিগুলিকে আক্রমণ করে। সেখান থেকেই হয় সংক্রমণ। কারও হাঁচি, কাশির ড্রপলেট থেকে ছড়িয়ে পড়তে পারে এই ভাইরাস।

উপসর্গ

প্রাথমিক ভাবে, মাম্পস-এর প্রধান উপসর্গই হল, গলা, চিবুক ফুলে যাওয়া, সঙ্গে ব্যথা ও জ্বর। কারও ক্ষেত্রে প্রথমে এক দিকে ফুললেও, পরে আর এক দিকেও ফুলে যেতে পারে। সঙ্গে বমি, খেতে না পারা, মেজাজ খিঁচড়ে থাকা, দুর্বলতা... নানা উপসর্গও থাকে। এ তো গেল সাধারণ উপসর্গ। এর সঙ্গে মাম্পসে আক্রান্ত অনেক শিশুরই অ্যাসেপ্টিক মেনিনজাইটিস, এনসেফ্যালাইটিস, অর্কাইটিস অর্থাৎ মস্তিষ্কে প্রদাহ ও অণ্ডকোষে প্রদাহ, প্যানক্রিয়াটাইটিসেও আক্রমণ হচ্ছে। গত কয়েক দিনে মস্তিষ্কে প্রদাহ নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া শিশুর সংখ্যা বেড়েছে বলে জানাচ্ছেন কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের শিশুরোগ চিকিৎসক দিব্যেন্দু রায়চৌধুরী। অবস্থার অবনতিতে শিশুদের রাখতে হচ্ছে আইসিইউতে, যা ক্রমশ চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

কেন বাড়ছে?

ডা. রায়চৌধুরী বলছেন, আবহাওয়ার হঠাৎ বদলের কারণে হয়তো বাড়ছে মাম্পস। তা ছাড়া, নির্দিষ্ট সময় অন্তর রূপ বদল করে এই ভাইরাস। সম্ভবত এ বারেও সে কারণে শরীরের স্বাভাবিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ভাইরাসের সঙ্গে যুঝে উঠতে পারছে না। রয়েছে সচেতনতার অভাবও। ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার অন্তত তিন-চার দিন পর থেকে উপসর্গ দেখা দেয়। ইমিউনিটি ভাল হলে, অনেকের ক্ষেত্রে আবার কোনও উপসর্গ থাকে না। এই অবস্থায় বাচ্চাদের অনেকেই স্কুলে যায়, একসঙ্গে খেলাধুলো করে। সেখান থেকেই ছড়িয়ে পড়ছে রোগ। তবে কেন বাড়ছে তার চেয়েও জরুরি রোগ প্রতিরোধ করা।

চিকিৎসা

ভাইরাল সংক্রমণ হওয়ায় এ ক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়োটিকের কোর্স করে তেমন উপকার হয় না। বরং জ্বর বা ব্যথা কমার জন্য প্যারাসিটামল, হাঁচি, কাশি হয়ে থাকলে তার জন্য প্রয়োজনীয় ওষুধ দেওয়া হয়। অর্থাৎ উপসর্গ অনুযায়ী এ ক্ষেত্রে চিকিৎসা হয়।

  • ভ্যাকসিন ও বুস্টার ডোজ়: মাম্পসের তেমন নির্দিষ্ট কোনও চিকিৎসা না থাকলেও, রয়েছে ভ্যাকসিন। তবে শুধু মাম্পসের জন্য নয়, একসঙ্গে মাম্পস-মিসলস-রুবেলা অর্থাৎ এমএমআর ভ্যাকসিন এ ক্ষেত্রে দেওয়া হয়ে থাকে। শিশুর ন’মাস বয়সে প্রথম দেওয়া হয় এই ভ্যাকসিন। পরে দেড় বছর ও পাঁচ বছরে দেওয়া হয় আরও দু’টি বুস্টার ডোজ়। দিব্যেন্দু বলছেন, “সমস্যা হল, মাম্পসের প্রতিষেধক সরকারি স্তরে শিশুদের দেওয়া হয় না। আর অধিকাংশ শিশু সরকারি হাসপাতাল থেকেই বিভিন্ন প্রতিষেধক নেয়। ফলে বাদ যায় মাম্পসের টিকা। স্বাস্থ্য মন্ত্রকের তরফে মাস কয়েক আগে হাম ও রুবেলার প্রতিষেধক (এমআর ভ্যাকসিন) দেওয়া হয়।” স্কুলগুলিতেও কর্মসূচি চালিয়ে সকলকে ভ্যাকসিন দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু সেখানেও বাদ পড়ে মাম্পস। তবে বেসরকারি স্তরে তিনটি ভাইরাসেরই একসঙ্গে প্রতিষেধক (এমএমআর) পাওয়া যায়।

সচেতনতা

ডা. ত্রিদিব বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন, “শেষ কয়েক মাস ধরে মাম্পসের প্রকোপ বৃদ্ধির বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করে সরকারি স্তরেও এমএমআর প্রতিষেধক চালুর বিষয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রককে চিঠি দিয়েছে ইন্ডিয়ান অ্যাকাডেমি অব পেডিয়াট্রিক্স।” চিকিৎসকদের কথায়, দেশ জুড়েই সমস্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় স্পষ্ট যে, তিনটি রোগের প্রতিষেধক যেখানে একসঙ্গে পাওয়া যায়, সেখানে সরকারি স্তরে শুধু হাম ও রুবেলার প্রতিষেধক দেওয়া ঠিক হয়নি। অবিলম্বে এমআরের বদলে সরকারি প্রতিষেধক নীতির মধ্যে এমএমআর আনা জরুরি। অভিভাবকেরা অনেক সময়েই ঠিক ভাবে ভ্যাকসিনেশন করান না। ‘‘ন’মাসের ভ্যাকসিন দেওয়া হলেও, অনেকে বুস্টার ডোজ় দেওয়ান না বাচ্চাকে। যে সকল বাচ্চার বুস্টার ডোজ় নেওয়া নেই, অবিলম্বেই তাদের এই ভ্যাকসিন নিতে হবে। এমআর-এর বুস্টার ডোজ় নেওয়া থাকলেও, একটি এমএমআর ভ্যাকসিনও নেওয়া দরকার,” বললেন ডা. রায়চৌধুরী।

কী করবেন?

  • মাম্পস হলে বাচ্চাকে যতটা সম্ভব আলাদা রাখুন। মাস্ক ব্যবহার করুন।
  • ব্যথা বাড়লে গরম সেঁক দেবেন না।
  • নজর দিন বাচ্চার খাবারের দিকেও। ব্যথার কারণে বাচ্চারা খেতে না চাইলে দুধ, ফলের রস, পাতলা খিচুড়ির মতো তরল ও নরম খাবার খাওয়াতে পারেন। জল খাওয়ান বেশি করে।
  • সাধারণ ভাবে মাম্পস সম্পূর্ণ সারতে প্রায় দু’সপ্তাহ সময় লাগে। তত দিন বাচ্চাকে স্কুল বা খেলার মাঠ থেকে দূরে রাখুন।
  • বাচ্চার উপসর্গের দিকে নজর রাখুন। সামান্য খিঁচুনি, বমি, ভুল বকা, অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার মতো কোনও উপসর্গ দেখা দিলে, তৎক্ষণাৎ চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করুন।

চিকিৎসকেরা সকলেই একমত, যে কোনও সংক্রামক অসুখকে দীর্ঘ দিন ধরে উপেক্ষা করা ঠিক নয়। প্রাথমিক ভাবে হাম বা রুবেলার মতো মাম্পসও যে প্রাণঘাতী হয়ে উঠতে পারে, তা ভাবেননি অনেকেই। তবে ঠিক চিকিৎসার অভাবে স্থায়ী ক্ষতি হতে পারে বাচ্চার মস্তিষ্ক বা টেস্টিকলেও। হাম ও রুবেলা দূরীকরণ কর্মসূচিতে দেখা যায়, এমআর ভ্যাকসিন দেওয়ার ফলে দেশে আক্রান্তের সংখ্যা অনেক কমেছে। সে ভাবেই এ বার মাম্পস নিয়েও সচেতন হতে হবে। সতর্ক থাকুন, সুস্থ রাখুন সন্তানকে।


মডেল: হিয়া মুখোপাধ্যায়, ঐশ্বর্য বসু, জিকো; ছবি: জয়দীপ মণ্ডল, অমিত দাস

অন্য বিষয়গুলি:

Contagious diseases high fever
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE