ইতিহাস বলছে, রোগের ওষুধ হিসাবে ভিনিগারের ব্যবহার হচ্ছে অন্তত ৫০০০ বছর ধরে। ছবি: সংগৃহীত।
যিশুখ্রিস্ট তখন ক্রুশে বিদ্ধ, যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন, তাঁর হাত-পায়ের ক্ষত থেকে রক্ত ঝরছে, ঝুঁকে পড়েছে মাথা, দেখে কিছুটা অনুকম্পার সঙ্গেই স্পঞ্জে ভেজানো সামান্য তরল তাঁর মুখের কাছে ধরেছিল রোমের সেনারা। যিশু সেই তরল প্রথমে প্রত্যাখ্যান করলেও শেষে গ্রহণ করেছিলেন। বাইবেল বলছে, সেই তরল ছিল ‘ভিনিগার’। যা সেই সময়ে রোমান সেনাদের নিয়ম করে খেতে হত। বিশেষ করে যুদ্ধকালে। কারণ, ভিনিগারকে সেই সময়ে মনে করা হত এক মহৌষধ! আজ যে অ্যাপল সাইডার ভিনিগার নিয়ে আলোচনার অন্ত নেই, এককালে সেই পানীয়ের প্রেমে পড়েছিলেন স্বয়ং রোমের প্রধান জুলিয়াস সিজ়ার। এতটাই যে, তাঁর সাম্রাজ্যে ভাল কাজ করা শ্রমিকদের জন্য ‘সাইডার ভাতা’ও চালু করে দেন তিনি!
এ বার ফিরে আসা যাক এ যুগে। ৫৫ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ থেকে সোজা ২০২৪। ইন্টারনেটে ভাইরাল একটি ভিডিয়ো। দেখা যাচ্ছে, এক খাদ্যরসিক তাঁর সামনে রাখা পিৎজ়ায় কামড় বসানোর আগে এক চুমুক অ্যাপল সাইডার ভিনিগার খেয়ে নিচ্ছেন। আর কিমআশ্চর্যম্! পর ক্ষণে তাঁর ব্লাড সুগারের পরীক্ষা বলছে, রক্তে শর্করার পরিমাণ মোটেই ততটা বাড়েনি, যতটা এক কামড় পিৎজ়া খাওয়ার পরে সাধারণ ভাবে বেড়ে যাওয়া উচিত। বরং তুলনায় সংখ্যাটা অনেকটাই কম!
অ্যাপল সাইডার ভিনিগারের গুণাগুণ নিয়ে এমন একটি নয়, হাজার হাজার ভিডিয়ো ছড়িয়ে রয়েছে ইন্টারনেটে। কোনওটির বক্তব্য, সাইডার ওজন কমায়, কেউ বলছেন, চুল ভাল রাখে, কেউ বলছেন, ত্বক ভাল থাকে, কেউ ব্রণ-ফুস্কুড়ি কমাচ্ছেন স্রেফ অ্যাপল সাইডার ভিনিগার লাগিয়ে। আবার কারও বক্তব্য সাইডার সেবন তাঁদের সার্বিক ভাবে ভাল রেখেছে। কিন্তু অ্যাপল সাইডার ভিনিগারের কি সত্যিই এত ক্ষমতা?
ভিনিগারে কি মহৌষধ!
ইতিহাস বলছে, রোগের ওষুধ হিসাবে ভিনিগারের ব্যবহার হচ্ছে অন্তত ৫০০০ বছর ধরে। ভিনিগার, যা কিনা মিষ্টি জাতীয় ফলকে জারিত করে তৈরি হত, তা প্লেগ রোগীদেরও দেওয়া হত ওষুধ হিসাবে। খাওয়ার জন্য তো বটেই, রোগে আক্রান্ত ত্বকে লাগানোর জন্যও। চিকিৎসাশাস্ত্রের পিতামহ হিপোক্রিট, যাঁর নামে আজও শপথ নেন চিকিৎসকেরা, সেই তিনি ভিনিগারের ব্যবহার করতেন অ্যান্টিসেপটিক হিসাবে। গল্পকথা নয়, আমেরিকার সরকারি স্বাস্থ্য ওয়েবসাইটে ফলাও করে লেখা আছে সে কথা। একই বক্তব্য সিনসিনাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদেরও। তাঁরাও জানাচ্ছেন ঠান্ডা লাগা, সর্দিকাশির মতো রোগের উপশমের পাশাপাশি সার্বিক স্বাস্থ্যরক্ষার টনিক হিসাবে ভিনিগারের সঙ্গে মধু মিশিয়ে খাওয়াতেন তিনি।
চিনের পুরাতনী চিকিৎসায় আবার ভিনিগার খাওয়ানো হত শরীরের ভিতরের রক্তপাত বন্ধ করার জন্য, শরীরে বিষক্রিয়া রোধ করার জন্য, কোষ্ঠকাঠিন্যের উপশম , রক্তসঞ্চালন ভাল করার জন্যও। জাপানের ইতিহাস বলছে, তাদের যোদ্ধা সামুরাইরাও নিয়মিত ভিনিগার খেতেন বলবৃদ্ধির জন্য। ইসলাম ধর্মে ফেরেস্তা বা পয়গম্বর মানা হয় মহম্মদকে। মহম্মদের বাণীসমৃদ্ধ গ্রন্থ হাদিসেও লেখা আছে ভিনিগারের কথা। যেখানে মহম্মদ বলছেন, ‘‘নিয়েম অলউদুম অলখল্’’। যার অর্থ ভিনিগারই হল সবচেয়ে ভাল খাবার।
ভিনিগার এবং অ্যাপল সাইডার ভিনিগার
ভিনিগার প্রথম দিকে তৈরি করা হত খেজুর, ডুমুর, বার্লি থেকে। কিন্তু ১৫০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে তৎকালীন ইউরোপে এল আপেল। এ যুগে আপেল যতই চিকিৎসকদের প্রিয় ফল হোক না কেন, সে যুগে লাল টুকটুকে ওই ফল খাওয়ার যোগ্য বলেই মনে করতেন না অনেকে। আপেলকে বলা হত তিতকুটে। তাই তাতে মিষ্টি ভাব আনতে আপেল থেঁতো করে আপেলের রস গেঁজিয়ে ভিনিগার তৈরি করা শুরু হয়। ৫৫ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে অধুনা ইংল্যান্ডে গিয়ে সেই পানীয় খেয়েই ভাল লাগে সিজ়ারের। তার পর থেকে সিজ়ারের রাজ্য বিস্তার যত হয়েছে, সাইডারের ব্যবহারও বেড়েছে। একটা সময় অ্যাপল সাইডার তার স্বাস্থ্যগুণের জন্যই হয়ে ওঠে রাজারাজড়াদের প্রিয় পানীয়। তাঁরা আবার অন্য ভিনিগারের সঙ্গে অ্যাপল সাইডার মিশিয়ে খেতেন। সে সময়ে বিভিন্ন রোগের চিকিৎসার জন্যও অ্যাপল সাইডারের ব্যবহার শুরু হয়। বিশেষ করে পেটের রোগ, দন্তশূল, খুশকি বা অন্যান্য সমস্যার জন্য অ্যাপল সাইডারকে কার্যকর ওষুধ মনে করা হত। কিন্তু সব কিছুরই অন্ত আসে। অ্যাপল সাইডারের জনপ্রিয়তাও একটা সময় কমল। যদিও তার পরে বিংশ শতকে আবার দ্বিগুণ গতিতে ফিরেও এল। সৌজন্যে এক চিকিৎসক এবং তাঁর লেখা একটি বই।
অ্যাপল সাইডারের কামব্যাক!
উনিশ শতকের শুরুতে তখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলছে। কাতারে কাতারে মানুষ জখম হচ্ছেন। সেই সময়ে রোগীদের ক্ষতস্থান নিরাময়ে অ্যাপল সাইডার ভিনিগার এবং অন্য ভিনিগারের ব্যবহার শুরু করেন চিকিৎসকেরা। পরে ভারমন্টের চিকিৎসক ডেফরেস্ট ক্লিনটান জারভিস একটি বই লেখেন। নাম— ‘‘ফোক মেডিসিন: আ ভারমন্ট ডক্টরস গাইড টু গুড হেল্থ’’। জারভিস ছিলেন মেডিসিনের চিকিৎসক। বিশেষ করে প্রচলিত ওষুধপত্র নিয়েই ছিল তাঁর গবেষণা। জারভিস তাঁর বইয়ে লিখেছিলেন, অ্যাপল সাইডার ভিনিগারের সঙ্গে মধু মিশিয়ে খেলে তার মতো ভাল স্বাস্থ্যরক্ষার ‘টনিক’ আর দু’টি নেই। শুধু তা-ই নয়, পুড়ে যাওয়ার ক্ষত সারাতেও ভিনিগারকে ওষুধ হিসাবে ব্যবহার করার কথা বলেছিলেন তিনি। জারভিসের সেই বই এক বছরে আড়াই লক্ষ কপি বিক্রি হয়েছিল। দু’বছর ধরে ছিল বেস্টসেলার তালিকায়। আজও সেই বই পাওয়া যায়।
জারভিসের মতোই অ্যাপল সাইডার ভিনিগার মধু দিয়ে খাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন এ যুগের চিকিৎসকেরাও। কলকাতার পুষ্টিবিদ এবং ডায়েটেশিয়ান শ্রেয়া চক্রবর্তী গত ন’বছর ধরে তাঁর পেশায় রয়েছেন। তিনি বলছেন, ‘‘এ ব্যাপারে কোনও সন্দেহ নেই এবং সেই আদিম যুগ থেকেই দেখা গিয়েছে, ভিনিগার জীবাণুনাশে সাহায্য করে। সে জন্য অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গিয়েছে, ভিনিগারকে সংরক্ষণের কাজেও ব্যবহার করা হচ্ছে। তাই অ্যাপল সাইডার ভিনিগারের সঙ্গে মধু মিশিয়ে খেলে তাতে শরীরের ভাল বই খারাপ হবে না।’’ তবে একই সঙ্গে শ্রেয়া মনে করেন, শুধু অ্যাপল সাইডার ভিনিগার খেলেই যাবতীয় সমস্যা মিটে যাবে, তা-ও নয়।
গবেষণা কী বলছে?
১। অ্যারিজোনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টিবিদ জনস্টন বলছেন, যে কোনও ভিনিগার এবং অ্যাপল সাইডার ভিনিগারে আছে অ্যাসেটিক অ্যাসিড। ১৯৮৮ সালের একটি গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, অ্যাপল সাইডার রক্তে হঠাৎ শর্করার মাত্রা বেড়ে যাওয়াকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে। সে ক্ষেত্রে যে কোনও শর্করাজাতীয় খাবার খাওয়ার আগে যদি কেউ এক-দু’চামচ অ্যাপল সাইডার ভিনিগার খান, তবে খাবার খাওয়ার পরে যে হঠাৎ শর্করার বৃদ্ধি, তাকে ঠেকানো যাবে। যদিও গবেষক পল গিলের বক্তব্য, অ্যাপল সাইডার সত্যিই দীর্ঘকালীন ব্যবহারের জন্য ভাল কি না, তা নিয়ে আরও গবেষণা জরুরি।
২। ২০০৯ সালে জাপানে ১৫৫ জন প্রাপ্ত বয়স্ককে নিয়ে একটি গবেষণা চালানো হয়। তাতে দেখা যায়, যাঁরা তিন মাস নিয়ম করে ২ চামচ করে অ্যাপল সাইডার ভিনিগার খেয়েছেন তাঁরা তিন মাস পরে চার পাউন্ড ওজন কমিয়েছেন। ২০২৪ সালের একটি রিপোর্টে আবার দেখা যাচ্ছে, তিন মাস ধরে প্রতি দিন সকালে জলের সঙ্গে এক চামচ করে অ্যাপল সাইডার ভিনিগার খেয়ে ১৫ পাউন্ড পর্যন্ত ওজন কমেছে ১২০ জনের। গবেষণাটি করা হয়েছিল লোবাননের বাসিন্দা ১২-২৫ বছর বয়সিদের উপরে। পাশাপাশি, এ-ও দেখা গিয়েছে যে, অ্যাপল সাইডার ভিনিগার খাওয়া বন্ধ করার এক মাসের মধ্যেই আবার একই ওজন ফিরে এসেছে। অ্যাপল সাইডার খেয়ে ওজন কমানো প্রসঙ্গে ডায়েটেশিয়ান শ্রেয়া বলছেন, ‘‘আমি মনে করি না, শুধুমাত্র অ্যাপল সাইডার ভিনিগার খেয়ে ওজন কমানো সম্ভব। এর জন্য একটা রুটিন মেনে চলতে হয়। নিয়ম মানতে হয়। তবেই দীর্ঘ মেয়াদে ভাল ফল পাওয়া সম্ভব। আমি অ্যাপল সাইডারও খেলাম আবার বার্গার বিরিয়ানিও খেলাম, তাতে কোনও কাজ হবে না। আমি মনে করি শুধু অ্যাপল সাইডার ভিনিগার খেয়ে ওজন কমানোর যে ধারণা চালু আছে, তা আদতে একটা মিথ।’’ ক্লিভল্যান্ড ক্লিনিকের ডায়েটিসিয়ান বেথ জারোনিরও বক্তব্য কিছুটা এক। তিনি বলছেন, ‘‘আমি কখনও আমার রোগীদের অ্যাপল সাইডার খেয়ে ওজন কমানোর পরামর্শ দিই না।’’
৩। অ্যাপল সাইডার ভিনিগার হজমে সহায়তা করে বলে ধারণা। নিউ ইয়র্কের ডায়েটেশিয়ান তামারা ড্যুকের ফ্রিউম্যান জানাচ্ছেন, তাঁর বহু রোগীই তাঁকে বলেছেন, খাবার আগে বা পরে অ্যাপল সাইডার খেয়ে তাঁদের হজম ক্ষমতার উন্নতি হয়েছে। কিন্তু অনেকে এ-ও বলেছেন যে, নিয়মিত অ্যাপল সাইডার খেয়ে তাঁদের অ্যাসিডিটির সমস্যা মারাত্মক বেড়ে গিয়েছে। কলকাতার পুষ্টিবিদ শ্রেয়াও বলছেন, ‘‘অ্যাপল সাইডার ভিনিগারে পুষ্টিগুণ নেই তা নয়। বরং আপেলের যা যা পুষ্টিগুণ, তার অনেক খানিই আছে, আর আছে পলিফেনলের মতো অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট এবং অ্যাসেটিক অ্যাসিড। যা শরীরের পক্ষে ভাল। কিন্তু কেউ যদি নিয়মিত অ্যাপল সাইডার ভিনিগার খেতে চান, তবে আমি বলব, সকালে না খেয়ে রাতের খাবার পরে সামান্য মধু দিয়ে মিশিয়ে খেতে। তাতে যাঁদের অ্যাসিডিটির সমস্যা আছে, তাঁরা খুব বেশি সমস্যায় পড়বেন না। ’’
৪। ২০১৯ সালের একটি গবেষণায় এগ্জ়িমা বা চুলকানির সমস্যায় ভুক্তভোগী ২২ জনকে বলা হয়েছিল প্রতি দিন ১০ মিনিট করে দু’সপ্তাহ তাঁদের একটি হাত সাধারণ কলের জলে এবং অন্য হাত অ্যাপল সাইডার ভিনিগার গোলা জলে ডুবিয়ে রাখতে। দু’ সপ্তাহ পরে দেখা যায়, এঁদের মধ্যে ১৬ জনেরই ভিনিগার ডোবানো হাতে অস্বস্তি বেড়েছে বই কমেনি। কারও কারও আবার চুলকানির সঙ্গে সঙ্গে জ্বালাও শুরু হয়েছে। ভার্জিনিয়া স্কুল অফ মেডিসিনের ত্বকের চিকিৎসক লিডিয়া লু বলছেন, ‘‘দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হল, এগ্জ়িমার জন্য অ্যাপল সাইডার মোটেই ভাল নয়। বরং ভাল হওয়ার বদলে খারাপই হতে পারে। তাই ত্বকের জন্যও অ্যাপল সাইডার কতটা ভাল, তা জানতে হলে আরও গবেষণা দরকার। তার আগে সরাসরি ত্বকে অ্যাপল সাইডার ভিনিগার লাগিয়ে ব্রণ বা ফুস্কুড়ি সারানোর ঝুঁকি না নেওয়াই ভাল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy