ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রণীত বর্ণপরিচয়। সংগৃহীত ছবি।
ফিনফিনে গোলাপি মলাটের পাতলা একটা বই। দাম এক আনা। জন্ম ১৮ শতকে।
বাঙালি ঘরে মায়ের কাছে শিশুর বর্ণমালা চেনার প্রথম পাঠ শুরু হয় এই বইয়েই। যুগ যুগ ধরে চলে আসছে এই ট্র্যাডিশন। জীবন বদলেছে,সময় বদলেছে, কিন্তু একই থেকে গিয়েছে ‘শ্রী ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রণীত বর্ণপরিচয়’। বর্ণমালা চেনার পাঠে এই বই পড়তে হয়েছিল স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকেও। তাঁর নিজের লেখাতেই রয়েছে তার প্রমাণ।
পরবর্তীতে শিশুর প্রথম পাঠে যোগ হয়েছে নিত্য নতুন উপকরণ। কিন্তু বদল ঘটেনি এই বইটির। বর্ণপরিচয় এখন পশ্চিমবঙ্গের প্রধান প্রাইমার অর্থাৎ প্রথম পাঠ্যপুস্তক।
১৮৫৫ সালের ভরা বৈশাখে এপ্রিলের ১৩ তারিখ প্রকাশিত হয় বর্ণপরিচয়ের প্রথম ভাগ। ওই বছরের ১৪ জুন আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে প্রকাশিত হয় দ্বিতীয় ভাগ।
গ্রামের পথে পালকিতে যেতে যেতে বর্ণপরিচয়ের পাণ্ডুলিপি তৈরি করেছিলেন বিদ্যাসাগর। বিহারীলাল সরকারের লেখা থেকে জানা যায়, প্রথম প্রকাশের পর এই বইটি তেমন আদর পায়নি। তাতে বইয়ের জনক বিদ্যাসাগর মহাশয় আশাহতও হয়েছিলেন। কিন্তু এর পরে ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে বইয়ের জনপ্রিয়তা।
বিদ্যাসাগরকে বলা হয় আধুনিক বাংলা বর্ণমালার রূপকার। বর্ণমালা সংস্কার করেছিলেন তিনিই।
বহুদিন পর্যন্ত বর্ণমালা ছিল ষোলো স্বর ও চৌত্রিশ ব্যঞ্জন-- এই পঞ্চাশ অক্ষরের সমাহার। বর্ণপরিচয়ে বেশ কিছু নতুন বৈশিষ্ট্য যোগ করেছিলেন বিদ্যাসাগর। ড়, ঢ়, য় সংযোজন করেছিলেন। স্বরবর্ণ থেকে দীর্ঘ ঋ আর দীর্ঘ ৯ বর্ণ দু'টি বাদ দিয়েছিলেন তিনি। স্বরবর্ণের তালিকাভুক্ত অনুস্বর এবং বির্সগকে ব্যঞ্জনবর্ণের তালিকায় স্থান দেন। চন্দ্রবিন্দুকে আলাদা ব্যঞ্জন বর্ণ হিসাবে চিহ্নিত করেন। এছাড়া যুক্তাক্ষর ক্ষ-কে বাদ দেন বর্ণমালা থেকে। এছাড়াও প্রথম পাঠের এই বইটিতে যুক্ত হয়েছিল একাধিক নতুন বৈশিষ্ট্য।
বর্ণপরিচয়ের বর্ণমালায় এই পরিবর্তনগুলির নেপথ্যে তাঁর নিজের ভাবনা এবং যুক্তি বিদ্যাসাগর প্রকাশ করেছিলেন বর্ণপরিচয় প্রথম ভাগের ভূমিকায়। বর্ণপরিচয়ের দ্বিতীয় ভাগে আছে সংযুক্ত বর্ণের পাঠ।
নতুন শিক্ষার্থীদের জন্য ভাষাশিক্ষার ক্ষেত্রে আরোহী পদ্ধতি অবলম্বন করেছিলেন তিনি। মানে নতুন পড়ুয়ারা সহজ থেকে কঠিন পাঠের দিকে এগোত। প্রথমে বর্ণ চেনা, তার পরে শব্দ তৈরি, তার পরে বাক্য গঠন পর্ব পেরিয়ে তরতরিয়ে লিখতে-পড়তে শেখে তারা।
বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয় প্রকাশের আগেও শব্দসার, শিশুশিক্ষা-র মতো বেশ কিছু প্রাইমার প্রচলিত ছিল। কিন্তু বিদ্যাসাগরের বইটি তুমুল জনপ্রিয়তা পায়। তাঁর জীবৎকালে এই বইয়ের শ’দেড়েক মুদ্রণে পঁচিশ লক্ষ কপি ছাপা হয়। বিদ্যাসাগর এই বইয়ের প্রথম সংস্কার করেন বই প্রকাশের কুড়ি বছর পরে, ষাটতম মুদ্রণপর্বে।
ভাষাশিক্ষার সঙ্গে তিনি পড়ুয়াকে নীতিশিক্ষা এবং মূল্যবোধের পাঠও দিতে চেয়েছিলেন। বর্ণপরিচয়ের দু'টি ভাগেই সে ভাবে পাঠ্যবস্তু সাজিয়ে ছিলেন তিনি।
বাঙালির ঘরে ঘরে বর্ণ পরিচয়ের আলো এনেছিলেন বিদ্যাসাগর। সংস্কৃতের দুর্বোধ্যতা থেকে মুক্তি দিয়ে সহজ ভাবে মাতৃভাষা শেখার পরিসর তৈরি করতে চেয়েছিলেন সংস্কৃত কলেজের তদানীন্তন অধ্যক্ষ। সাক্ষরতা প্রসার আন্দোলনে এই বই ছিল তাঁর অন্যতম প্রধান হাতিয়ার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy