গর্গ চট্টোপাধ্যায়
ভারতে বাংলা ভাষা ও বাঙালি জাতি বিপন্ন কিনা, এই বিতর্ক হচ্ছে মানেই বিপন্নতা পৌঁছেছে অস্তিত্বের সংকটের স্তরে। বাঙালির রক্তে স্বাধীন এই ভারত। ঊনবিংশ শতাব্দীতে এশিয়ার অন্যতম অগ্রসর জাতি বাঙালি জাতির চেতনায় কল্পিত দক্ষিণ এশিয়ায় অখণ্ড বহুজাতিক যুক্তরাষ্ট্র এই ভারত। এই বহুজাতিক, বহুভাষিক রাষ্ট্র কোন ভাষার ভিত্তিতে তৈরী নয়। তাই ভারতের সংবিধানে রাষ্ট্রভাষা বলে কিছু নেই। হিন্দি ভারতের রাষ্ট্রভাষা নয় এবং কখনও ছিল না। ভাষার ভিত্তিতে ভারত গঠিত না হলেও ভাষার ভিত্তিতে তৈরী হয়েছে ভারতের অহিন্দি রাজ্যগুলি। যে জাতির যে আবাদভূমি, সেই আবাদভূমি অর্থাৎ রাজ্যের সীমান্ত দিয়ে নির্ধারণ করা আছে মালিকানার। ঠিক জমির দলিলের মত। তাই তামিল ভাষার ভিত্তিতে তৈরী তামিলনাড়ু তামিলদের, কন্নড় ভাষার ভিত্তিতে তৈরী কর্ণাটক কন্নডিগাদের, মারাঠি ভাষার ভিত্তিতে তৈরী মহারাষ্ট্র মারাঠিদের ( যে কারণে তারা গুজরাট থেকে আলাদা হবার লড়াই লড়েছিল বহু শহীদের আত্মবলিদানে), মালয়ালম ভাষার ভিত্তিতে তৈরী কেরল মালায়ালীদের, গুজরাটি ভাষার ভিত্তিতে তৈরী গুজরাট গুজরাটিদের, পাঞ্জাবি ভাষার ভিত্তিতে তৈরী পাঞ্জাব রাজ্য পাঞ্জাবিদের ( ঐতিহাসিক পাঞ্জাবি সুবা আন্দোলনের ফলাফল), বাংলা ভাষার ভিত্তিতে তৈরী পশ্চিমবঙ্গ বাঙালিদের ( যে কারণে বিহার ও হিন্দির অধীনে থাকতে না চাওয়া মানভূমের একাংশ পুরুলিয়া জেলা হিসেবে পশ্চিমবঙ্গে যোগ দেয় ১৯৫৬ সালে), হিন্দি-উর্দু ভাষার ভিত্তিতে তৈরী বিহার বিহারীদের ( যে কারণে ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের ফলে বাংলা আবার এক করা হলেও "বিহার ফর বিহারিজ" স্লোগানের মাধ্যমে রাজেন্দ্র প্রসাদ সহ একাধিক বিহারি নেতা বাংলা ও বাঙালিদের প্রতি প্রবল বিদ্বেষ প্রকাশ করে বাঙালি-অধ্যুষিত কিছু জেলা সহ বিহার নামক একটি নতুন রাজ্য বাংলা থেকে কেটে বার করে ইংরেজদের সাহায্যে ১৯১২ সালে)। ভারত কোন নির্দিষ্ট ভাষার ভিত্তিতে তৈরী না হবার ফলে রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে যেমন হিন্দির বিশেষ অধিকার ও মর্যাদা থাকা অস্বাভাবিক এবং সকল মাতৃভাষার সমান অধিকারটাই স্বাভাবিক, ঠিক তেমনই ভাষার ভিত্তিতে তৈরী রাজ্যে সেই ভিত্তি ভাষার মানুষদের অর্থাৎ ভূমিপুত্রদের এবং ভূমিজ ভাষার বিশেষ অধিকার অর্থাৎ অগ্রাধিকার থাকাই স্বাভাবিক। তেমন পশ্চিমবঙ্গে বাংলা ও বাঙালি তথা অন্যান্য ভূমিজ জাতির।
বাঙালির অধিকার এবং বাংলা ভাষার অধিকার পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। জাতি না থাকলে ভাষা হাওয়ায় বেঁচে থাকেনা। পশ্চিমবঙ্গে পুঁজির মালিকানা ও শহর তথা শিল্পাঞ্চলে বাঙালির আধিপত্য না থাকলে বাংলা বাজার ও অর্থনীতির ভাষা থাকেনা। রাজস্থানে কল্পনা করতে পারেন যে জয়পুরের মূল হোলসেল বাজার বাঙালির দখলে এবং রাজস্থানের মানুষ সেখানে মাল কিনতে এসে বাংলা বলতে বাধ্য হচ্ছেন? পশ্চিমবঙ্গে জনবিন্যাস এবং জনপ্রতিনিধিত্ব বাঙালির পক্ষে না থাকলে রাজনৈতিক মঞ্চে, ফ্লেক্সেহোর্ডিং-এ, স্লোগানে বাংলার নিরঙ্কুশ জায়গা থাকেনা। অসংখ্য বাঙালি পরিযায়ী আছে যে মুম্বই, আমেদাবাদ, বেঙ্গালুরু, হায়দ্রাবাদে, সেখানে কোন বাঙালি সাংসদ বা বিধায়ক তো দূরের কথা, কোন বাঙালি কাউন্সিলার কল্পনা করতে পারে কেউ? কল্পনা করা যায় যে বাঙালিদের ভোটারদের মন জয় করতে বিহার, ইউপি, তামিলনাড়ু, গুজরাট বা মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী বা বিরোধী দলনেতা বাংলায় ভাষণ দিচ্ছে? কল্পনা করা যায় যে ইউপিতে কোন বাঙালি কাউন্সিলার তার দেশের বাড়ি বাঁকুড়া বা কোচবিহারের লোকেদের গণহারে ইউপির স্থায়ী বাসিন্দা বানিয়ে রাজ্য সরকারি সুবিধা দিতে ভুয়ো সার্টিফিকেটের জন্য দেদারে সই করছে? পশ্চিমবঙ্গে প্রশাসন ও পুলিশে উপর থেকে নিচুতলায় সকল পদ বাংলার ভূমিপুত্রদের হাতে না থাকলে, বাংলা ও বাঙালির স্বার্থের প্রশাসন সম্ভব? ইউপি-বিহারে কল্পনা করা যায় যে পশ্চিমবঙ্গের কোন বাঙালি ইউপি বা বিহারের জাল ডোমিসাইল ও কাস্ট সার্টিফিকেট তৈরী করে ইউপি বা বিহারে বাঙালি আইপিএস চক্র ধরে বাংলা ভাষায় পরীক্ষা দিয়ে ইউপি বা বিহার পুলিশে সাব-ইন্সপেক্টর হয়ে যাচ্ছে? পশ্চিমবঙ্গে ব্যাংক, পোস্ট অপিস, কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারি দফতর সর্বত্র পদগুলি বাংলার ভূমিপুত্রদের হাতে না থাকলে পরিষেবা পাওয়া সম্ভব? ইউপি এমপি রাজস্থানের কোন ব্যাঙ্ক বা পোস্ট অফিসে কোন বাঙালি কাজ করছে যে হিন্দি ভাষায় পরিষেবা দিতে পারেনা, স্থানীয়দের বাংলায় বলতে বলছে, হরিয়ানায় রেলের টিকিটে, এটিএমে বাংলা আছে, হিন্দি নেই, এটা কল্পনা করা সম্ভব? পাটনা পৌরসভায় গ্রুপ ডি কর্মীরা সব বাঙালি, লখনৌয়ের সরকারি হাসপাতালে ডাক্তার বাংলা বলে, হিন্দি জানেনা, কানপুরে সরকারি হাসপাতালে ভর্তির জন্য বাঙালি গ্রুপ ডিদের রাজনৈতিক মদতপুষ্ট দালালচক্র, এসব কল্পনা করা সম্ভব? কোন রাজ্যের পুঁজি বাজার চাকরি থেকে অটো লাইন, টোটো লাইন থেকে সাদা-কালো-ধূসর, অর্থনীতি তথা আইন-বেআইনের সবক্ষেত্রে বাংলার ভূমিপুত্রদের আধিপত্য না থাকলে, বাংলার সে এলাকা বাংলা থাকা সম্ভব? সে এলাকায় সূর্য্য সেনের জন্মদিনে মূর্তিতে মাল্যদান সম্ভব? বিহারে বাঙালি মস্তান ও মাফিয়াদের মধ্যে শুট-আউট হচ্ছে, তাদের মধ্যে কেউ সাংসদ, কেউ বিধায়ক, কেউ মেয়র হচ্ছে, তাদের ভয় বিহারেই বিহারীরা সিঁটিয়ে থাকে, এসব ভাবতে পারেন? গুজরাটের বন্দরে স্টিভেডর, মাফিয়া, স্মাগলার বাঙালি, এটা ভাবতে পারেন?
তাই পশ্চিমবঙ্গে দরকার ভূমিপুত্র সংরক্ষণ - রাজ্য সরকারি চাকরিতে বাংলা ভাষার পরীক্ষা বাধ্যতামূলক, বেসরকারি কাজে ভূমিপুত্র সংরক্ষণ যেমন হরিয়ানা, ঝাড়খন্ড, অন্ধ্রপ্রদেশ সহ অনেক রাজ্যে আছে, টেন্ডার, শিল্প-তালুক, বাজার, সাপ্লাই চেন, প্রোমোটিং, মিল, গুদাম, হকারি স্পট, খনি, বন্দর, অর্থাৎ টাকা করার সর্বক্ষেত্রে আইনি বা অন্যতর প্রক্রিয়ায় ভূমিপুত্র আধিপত্য। যেমন অন্য সব রাজ্যে হয় আর কি। ভিটে রেখে যায় বাপে, রক্ষা করতে হয় দাপে।
ভারতের সব রাজ্যে যা স্বাভাবিক, তা পশ্চিমবঙ্গে অস্বাভাবিক মনে হলে বুঝতে হবে নিজের মাটিতে নিজের অধিকার বুঝে নেওয়ার বিষয়ে কুন্ঠা হল দাসত্বের লক্ষণ, পরাধীনতার বৈশিষ্ট্য। পশ্চিমবঙ্গ ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রে। পশ্চিমবঙ্গ মঙ্গলগ্রহে না। সবার বাড়ি বাড়ি, আমার বাড়ি হোটেল যেখানে আমিই ভাড়া দিয়ে থাকি যেমন বাঙালি চাষীর ফলানো ধানের চাল বাঙালিরা বড়বাজারের থেকে কিনে থাকে, এমন অবস্থা জাতীয় জাগরণের বস্তুগত ভিত্তি। এই অবস্থায় আরও আরও রবীন্দ্র-নজরুল সন্ধ্যা করে সমাধান না। আজ রবীন্দ্রনাথ আমাদের বাঁচাবেন না, আমাদের রবীন্দ্রনাথকে বাঁচাতে হবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy