ছবি: অমিতাভ চন্দ্র
আজ থেকে সত্তর বছর আগে, ১৯৪৭ সালের ১৫ অগস্ট আমি দিল্লির পথে দাঁড়িয়ে ছিলাম। চারিদিকে ধুলো উড়ছে। ভিড়ের ধাক্কাধাক্কিতে এক বার ঘোড়ার পায়ের তলায় আর একটু হলে চাপা পড়তাম। কে যেন হাত ধরে টেনে সরিয়ে দিল। লর্ড মাউন্টব্যাটেনের ঘোড়ায় টানা গাড়ির ঘোড়া না কি মাউন্টেড পুলিশের ঘোড়া, কে জানে। আমার বয়স তখন সবে ষোলো। সে দিনের স্বাধীনতার অনুভূতি আজকের প্রজন্মকে, যারা পরাধীনতার গ্লানি জানে না, তাদের বুঝিয়ে বলা কঠিন। নিতান্ত বালিকা বয়সে দেখেছি গাঁধীজির ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলন। ১৯৪৫-এ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে যখন নেতাজি ও আজাদ হিন্দ ফৌজের কীর্তিগাথা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ল, সে কী রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা!
লাল কেল্লায় আজাদ হিন্দ ফৌজের তিন অফিসারের বিচার চলছে— এক জন হিন্দু, অন্য জন মুসলমান, আর এক জন শিখ। সারা ভারত তাঁদের মুক্তির দাবিতে উত্তাল। সে দিনের স্লোগান ‘লাল কিল্লা সে আয়ি আওয়াজ, সেহগল ধীলন শাহনওয়াজ’। এত অভিজ্ঞতার পর আজ স্বাধীন ভারতে দিল্লির পথে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছি!
আমি কলকাতার মেয়ে। ঘটনাচক্রে সে সময় দিল্লিতে আমার মেজকাকা, লেখক নীরদচন্দ্র চৌধুরীর কাছে ছুটি কাটাতে এসেছিলাম। নীরদচন্দ্রের ব্রিটিশ সাম্রাজ্যপ্রীতি সর্বজনবিদিত। আমার জাতীয়তাবাদী মনে গভীর আশঙ্কা ছিল, দিল্লির স্বাধীনতা উৎসবে অংশগ্রহণ করা মেজকাকা পছন্দ করবেন না। মনে মনে ভাবছিলাম, থাকতাম যদি কলকাতায়, প্রভাতফেরিতে গান গেয়ে বেড়াতাম, কত আনন্দ হত! এমন সময়ে মেজকাকার স্টাডিতে ডাক পড়ল। বললেন, ‘‘বুঝেছি। হুজুগে যেতে পারবে না ভেবে মন খারাপ হয়েছে, ঠিক আছে। ম্যাফিকিং-এ (Maffick) চাও তো যেতে পারো।’’
আরও পড়ুন: দেখুন স্বাধীনতার প্রথম সকালের সেই দুর্লভ মুহূর্তগুলো
আমি তো আনন্দে আপ্লুত। ১৪ অগস্ট মধ্যরাতে পাশের ফ্ল্যাটে গিয়ে আমি আর ধ্রুব (নীরদচন্দ্রের পুত্র, আমার ভাই) রেডিয়োতে জওহরলাল নেহরুর বিখ্যাত ‘ভাগ্যের সঙ্গে অভিসারে যাওয়া’ বক্তৃতা শুনলাম। পর দিন ভোরবেলাতেই আমি, ধ্রুব ও আর এক ভাই কীর্তি দিল্লির পথপরিক্রমায় বেরিয়ে পড়লাম। সারা দিন পথে পথে ঘুরে গভীর রাতে বাড়ির পথ ধরলাম। দিল্লির সকল অট্টালিকা আলোকমালায় সজ্জিত, সারা শহর ঝলমল করছে। রাতের নিস্তব্ধ পথে হঠাৎ কীর্তি গমগমে গলায় আবৃত্তি শুরু করল— ‘‘চলে গেছ তুমি আজ মহারাজ/ রাজ্য তব স্বপ্ন সম গেছে ছুটে/ সিংহাসন গেছে টুটে...’’ সে যখন বলছিল, ‘‘যাদের চরণভারে ধরণী করিত টলমল তাঁরা আজ কোথায়’’, তখন আমার মনে সম্রাট শাজাহানের যুগ আর ব্রিটিশ রাজের অবসান কেমন যেন ওলটপালট হয়ে যাচ্ছিল।
স্বাধীনতার দিনটি আমাদের কাছে শুধু আনন্দের দিন ছিল না, সঙ্গে ছিল দেশভাগের গভীর বেদনা। র্যাডক্লিফ সাহেব ভারতের মানচিত্রের উপরে দাগ টেনে দিয়েছেন, আমি পূর্ব বাংলায় আমার নিকট-আত্মীয়দের গভীর সংকটে পড়তে দেখেছি। সে রাতে আলোকসজ্জা নিভে যেতে না যেতেই দিল্লিতে শুরু হল দাঙ্গাহাঙ্গামা। পঞ্জাব থেকে দলে দলে শরণার্থী এসে পড়লে তা তীব্রতর হল। শহরে চুরাশি ঘণ্টা কারফিউ জারি হল। বাড়িতে খাবারের অভাব। যুদ্ধের সময়ে ‘এগ পাউডার’ বলে একটি বস্তু পাওয়া যেত। বাড়িতে এক টিন মজুত ছিল। তাই দিয়ে ক’দিন চলল। ছাদে উঠলে দেখতে পেতাম, চারিদিকে আগুন আর ধোঁয়া। একতলার শিখ প্রতিবেশী ছুরিকাহত হয়ে বাড়ি ফিরলেন, কয়েক দিন পর তাঁর মৃত্যু হল।
এই ভাবে স্বাধীনতার আনন্দ আর দেশভাগের ট্র্যাজেডি মিলেমিশে গেল। সেপ্টেম্বরের গোড়ায় দিল্লি-কলকাতা ট্রেনযাত্রা ছিল ভয়াবহ অভিজ্ঞতা। দিল্লি স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে, চলন্ত ট্রেনের দু’পাশে বীভৎস দৃশ্য। ট্রেনের ভিতরে দুষ্কৃতিকারীদের তাণ্ডব। কানপুর স্টেশনে মিলিটারি তাদের গ্রেফতার করল।
নেতাজি বলেছিলেন, রক্ত দিলে তবেই স্বাধীনতা পাব। উনি নিশ্চয়ই বলতে চেয়েছিলেন রণক্ষেত্রে সৈনিকের রক্তের কথা। এখন নিরপরাধ নরনারীর রক্তে দেশ প্লাবিত হয়ে গেল। এত দুঃখের মধ্য দিয়েও স্বাধীনতা এক তৃপ্তি নিয়ে এল।
স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পূর্তি উপলক্ষে আর এক বার মধ্যরাতের অধিবেশন বসেছিল। দৈবচক্রে আমি তখন নিজে সাংসদ। শুনতে পেলাম, জওহরলাল নেহরুর বক্তৃতার রেকর্ড এবং গাঁধীজিরও কণ্ঠস্বর ওই ঐতিহাসিক অধিবেশনে শোনানো হবে। আমি স্পিকার সাংমা-কে গিয়ে ধরলাম, নেতাজির কণ্ঠস্বরও শোনানো হোক। সাংমা আমতা আমতা করে বললেন, দেরি হয়ে গেছে, এখন কী করব! আমি বললাম, আমাকে জিরো আওয়ারে এক বার কথাটা তুলতে দিন। আমি যখন জিরো আওয়ারে প্রস্তাবটি তুললাম, দলমত নির্বিশেষে সকলে হইহই করে টেবিল চাপড়ে আমাকে সমর্থন করতে লাগলেন। স্পিকার বললেন, ঠিক আছে, আমি আপনাদের মনোভাব বুঝেছি। তার পর দিন যায় কিন্তু কিছু ঘটে না। এক দিন দেখলাম, প্রধানমন্ত্রী ইন্দ্রকুমার গুজরাল পার্লামেন্টে তাঁর সিটে বসে আছেন। আমি কোনও মতে এক টুকরো কাগজ ছিঁড়ে তাতে লিখলাম, আপনি তো সে দিন সাংসদদের মনোভাব দেখেছেন। তবু কিছু হয়নি। ইংরেজিতে লিখলাম, আই নিড আ নড ফ্রম ইউ। ছেঁড়া কাগজ চাপরাশির হাতে দিলাম। আমার বার্তা পড়ে দেখে প্রধানমন্ত্রী আমার দিকে চেয়ে মাথা নাড়লেন, আমি ‘নড’ পেয়ে গেলাম। স্পিকারের কক্ষে আমার ডাক পড়ল। টেবিলে আমার ছেঁড়া কাগজের উপর প্রধানমন্ত্রীর নোট, ‘আমি মিসেস বোসের সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত।’ সাংমা বললেন, শিগগির নেতাজির কণ্ঠস্বর দিন। বললাম, কত চাই! ওঁরা একটা হিন্দি বক্তৃতার অংশ বেছে নিয়েছিলেন।
আরও পড়ুন: স্বাধীনতার সকালে পাওয়া দু’টি বিস্কুটই ছিল নিজের অর্জন
১৫ অগস্ট ১৯৯৭। মধ্যরাতের অধিবেশনে সেন্ট্রাল হল-এ উপচে পড়া ভিড়। আমার সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন শিশিরকুমার বসু। নেতাজির কণ্ঠস্বর যখন বেজে উঠল, সেন্ট্রাল হল জুড়ে সে কী উচ্ছ্বাস! বক্তব্যের প্রতিটি লাইনের শেষে প্রবল করতালি। আমি বলে ফেললাম, এমন অভূতপূর্ব প্রতিক্রিয়া, তবে কর্তৃপক্ষ কিসের ভয় করছিলেন? আমার অন্য পাশে বসেছিলেন পঞ্জাবের সাংসদরা। তাঁরা বলে উঠলেন, এই প্রতিক্রিয়াই তো ওঁরা ভয় করছিলেন। যা হোক, গাঁধীজি, নেতাজি, নেহরু— সব মিলিয়ে সেন্ট্রাল হল-এ এক উদ্দীপনাময় পরিবেশ। পার্লামেন্টের বাইরে এ আর রহমান গাইছেন, মা তুঝে সালাম।
স্বাধীনতার সত্তর বছর পরে আজ মনে হয়, কী চেয়েছিলাম আর কী পেলাম তার হিসাব মেলানো বেশ কঠিন। গাঁধীজি বলেছিলেন, সকলের চোখের জল মুছে যাবে, মুছেছে কি? নেতাজি বলেছিলেন দেশ থেকে দারিদ্র দূর হবে, দেশের প্রতিটি মানুষ পাবে শিক্ষা। আরও বলেছিলেন, কৃষক, শ্রমিক ও নারী— এঁদের তুলে আনতে হবে অগ্রগতির পথে। আজও দেশের বহু মানুষ দারিদ্রসীমার নীচে, শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত বহু মানুষ। কৃষকের আত্মহত্যা, নারীর লাঞ্ছনা নিত্য দিনের খবর। কোথাও উন্নয়ন আর অগ্রগতি হয়নি এমন কথা বলব না, কিন্তু এখনও বহু দূর পথ পরিক্রমা বাকি।
একটা বিষয়ে গর্ব অনুভব করতাম, আমরা গণতন্ত্র ধরে রেখেছি। আমি যখন বিদেশ মন্ত্রক সংসদীয় কমিটির চেয়ারপার্সন, দেশ-বিদেশের ডেলিগেট দেখা করতে এসে বলতেন, ‘‘তোমরা কী ভাবে গণতন্ত্র ধরে রেখেছ, বলো তো? তোমাদের প্রতিবেশী কোনও রাষ্ট্র পারেনি।’’ তখন খুব গর্ববোধ হত। আজ স্বাধীনতার সত্তর বছর পরে মনে হয়, আমরা গণতন্ত্রের অর্থ সঠিক বুঝেছি তো? আজকাল আমরা সংখ্যাগরিষ্ঠতা আর সংখ্যাগুরুবাদ যে এক নয়, তা ভুলে যাচ্ছি। এই দুটি যে আলাদা তা বুঝতে না পারলে ভারতের ভবিষ্যৎ অন্ধকার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy