দেশ: স্বাধীনতা দিবসের আগে উলুবেড়িয়ায় পতাকা হাতে খুদে। ছবি: সুব্রত জানা
স্বাধীনতা। আমাদের দেশের লোকই আমাদের শাসন করবেন। তদুপরি একেবারে শুরু থেকেই এ দেশের নাগরিকের ভোটাধিকার। ১৯৪৭-এর ১৫ অগস্টে ভারতের সাধারণ মানুষের কাছে এ এক অতুলনীয় প্রাপ্তি।
আজ, সেই দিনটির পরবর্তী সময়ে যাঁদের জন্ম, তাঁদের কাছে স্বাধীনতার অর্থই অন্য রকম। তার মধ্যে এই একাত্তর বছর পরেও খেতে না-পাওয়া মানুষদের জন্য বিক্ষোভ
প্রদর্শন আছে, শিশু শ্রমিকদের অস্তিত্ব বহাল আছে বলে ধিক্কার আছে, যৌনবিকারে ভূতগ্রস্ত হয়ে নারীদের প্রতি অশালীন আচরণের জন্য উত্তেজনা আছে, কৃষিক্ষেত্রে মানুষদের আত্মহত্যার জন্য বেদনা আছে। এই ঘটনাগুলো ভাবলে মনে হয় এ কীসের স্বাধীনতা? এ সবই স্বীকার্য। কিন্তু এর জন্য কি কেবল
সরকারকে দোষ দিলেই আমরা বাঁচব? আমাদের নিজেদেরও তো কিছু দায় থেকে যায় এই সমস্ত অন্যায় থেকে মুক্তির আলো ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়ার! সেই দায় পালন না করে যদি কেবলই দায়িত্বহীন শব্দবন্ধ উচ্চারণ করি, তা বোধহয় সমাজের পক্ষে ভাল হয় না।
কিছু বছর আগে কোনও এক তারকা মন্তব্য করেছিলেন, যে দিন তিনি বিমানবন্দর থেকে স্বল্পবাস পরে হাঁটতে হাঁটতে গভীর রাতে শহরের মধ্যে আসতে পারবেন, সে দিন তিনি বুঝবেন যে তিনি স্বাধীন। এই রকম আরও বিভ্রান্তি সৃষ্টিকারী মন্তব্য বহু বার কাগজে দেখেছি। মনে হয়েছে যাঁরা স্বাধীনতার মানেই জানেন না, তাঁদের বোধবুদ্ধি তো এমনই হবে।
আমরা যারা স্বাধীনতার পরবর্তী যুগে জন্মেছি, তারা জানি না, জানার চেষ্টাও করি না, পূর্ববর্তী সময়ে ইংরেজের অধীনে বেঁচে সাধারণ নাগরিকদের কী দুঃসহ দিন কাটাতে হয়েছে। কত অপমান সহ্য করতে হয়েছে। এই কলকাতার রাস্তায় শহরের কোনও কোনও অংশে যেতে তখন মানুষ ভয় পেতেন। অকারণে কোনও সাহেবের লাথি বা চড়চাপড় খেতে হতে পারত। অপমান ছিল নানা রকমের।
১৯৪৭ সালের এই দিনটিতে সেই অপমান এবং আরও অনেক রকম অবমাননা থেকে মুক্তি মেলে। আমাদের অনেক বীরের আত্মত্যাগ, স্বেচ্ছায় আত্মবলিদানের সেই ইতিহাস কিন্তু এই স্বাধীনতার মধ্যে লুকিয়ে আছে। এই ইতিহাস ভুলে হাল্কা চালে তাকে তুচ্ছ করার অধিকার আমাদের নেই।
ঠিক যেমন সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের অত্যাচার আমাদের উত্তেজিত করেছিল, আজও সেই রকম একটি দিন আসছে যখন একটি সেকুলার রাষ্ট্রকে হিন্দুরাষ্ট্রে পরিণত করার উদ্দেশ্যে একটি রাজনৈতিক দল ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। তাতে আশঙ্কা হয়, আবার আমাদের কোনও এক বিশেষ দলের পরাধীনতার গ্লানি বহন করতে হবে। বৈদেশিক রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরির যে চেহারা আমরা দেখতে পাচ্ছি, তাতেও আমরা শঙ্কার মাটিতে গুড়গুড় ধ্বনি যেন শুনতে পাই। পরাধীনতার গ্লানিতে আবার যেন আমাদের বা আমাদের সন্ততিদের ডুবে যেতে না হয়।
দেশভাগ এবং তার জন্য যে গ্লানি, তা তো আমাদের বহন করতে হবেই এবং তারই ফলশ্রুতিতে আরও কত জটিলতা যে সমাজকে পঙ্কিল করে তুলছে, তাতে আমরা ভয় তো পাই-ই। তবু আমি জানি, আমরা অনেকেই হিন্দু-মুসলমান-খ্রিস্টান-বৌদ্ধ-গরিব-ধনী হিসেব করে সমাজকে দেখি না। আমাদের কাম্য, প্রত্যেক মানুষ যেন
মানুষকে ‘মানুষ’ বলে স্বীকার করেন। আজকের স্বাধীনতা হয়তো এই অভিধাতেই পরিচিত হবে। সেই ভাবেই আমাদের নতুন স্বাধীনতা আসবে। তখন কাউকে
দোষারোপ না করেই আমরা মুক্তমনের অধিকারী হয়ে উঠব। হয়ে উঠব স্বাধীন। সেই স্বাধীন মন নিয়েই আমরা অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে সক্ষম হব।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy