সুনীলের রোজই ঘুম ভেঙে যায় খুব ভোরবেলা, আলো ফোটার আগে। চোখ খুলে সুনীল জানলার বাইরে ভোর হবার ঠিক আগের একটা জমাট অন্ধকার দেখতে পায়। বিছানার অন্য পাশে লতা অঘোরে ঘুমোচ্ছে। উঠে যাবে একটু পরেই। রোজই উঠে যায়। তবে সারা রাত্তির খুব ঘুমোয়। আসলে সারাদিন খাটে খুব। বিছানায় পড়লেই মড়ার মতো ঘুমোয়। সুনীলের ঘুম আসে না। আসলেও ছেঁড়া ছেঁড়া। দুঃস্বপ্নে ভরা। কোনও বিশেষ দুঃস্বপ্ন নয়, এমনি সাধারণ সব বিচ্ছিরি অলীক স্বপ্ন। মধ্যিখানে ডলি আর বাবু ঘুমোচ্ছে। ডলি ক্লাস এইটে পড়ে আর বাবু ক্লাস ওয়ানে। ছ’বছর আগে যখন বাবু হয় তখন সুনীলের কাজ ছিল। বাইরে আস্তে আস্তে আলো ফুটছে। সুনীল চুপচাপ উঠে গিয়ে বাইরে দরজার সামনে বসে। সরু গলির মোড়ে চায়ের দোকানে উনুনে আঁচ পড়ল। গলির মাঝবরাবর মিষ্টির দোকানের ছোঁড়াটা দোকানের সামনেটা ঝাঁট দিচ্ছে। সুনীল রোজই এ রকম উঠে বসে দেখে এ সব। আজও দরজার পাশে উবু হয়ে বসে সুনীল দেখতে থাকে। গলির মোড়ে বড় রাস্তা। বাস যায়। দুটো স্টপেজ গেলে সুনীলদের কারখানা।
সুনীল খুব ভাল লেদের কাজ করত। সোনাদা হাতে ধরে শিখিয়েছিল। কারখানা যত দিন চালু ছিল, সব সূক্ষ্ম কাজ সুনীল করত। সোনাদার কী একটা রোগ হয়েছিল, হাত কাঁপত। সোনাদা বেশি কিছু করতে পারত না। তবে রোজ আসত। সুনীল গুরু মানত বলে সুনীলের মেশিনের পাশেই একটা ছোট টুল নিয়ে বসে থাকত। ছোটোখাটো কাজ, ফাইফরমায়েস খেটে দিত। মালিক কিছু দিত, সোনাদার তাতেই চলত। আস্তে আস্তে লোকজনের আনাগোনা শুরু হয়। গলিতে ইশকুলের বাচ্চারা বেরোয়। বাবু ইশকুলের ড্রেস পরে বাইরে আসে। সুনীল ঘরে গিয়ে প্যান্ট পরে আসে। বাবুকে স্কুলে দিয়ে আসবে। সুনীল বাবুকে স্কুলের একটু আগে থেকে ছেড়ে দেয়। বাবা-মায়েদের ভিড় ভাল লাগে না। বাবু ফিরবে চন্দনের সঙ্গে। চন্দন সুনীলের ছোট ভাই। চার বছরের ছোট। মধ্যে আর একজন ছিল, মারা গিয়েছে। চন্দন ড্রাইভারি করে। মদ খায়। নিজেকে একটা কেউকেটা মনে করে। বাবু সুনীলের সঙ্গে ফিরতে চায় না। চন্দন ফেরার সময় বাবুকে বিস্কুটটা, লজেন্সটা কিনে দেয়, নানা রকম গল্প করে।
বেলা বাড়ে। সুনীল উবু হয়ে চুপচাপ বসে থাকে। ডলি এসে দুটো রুটি, একটু তরকারি আর চা দিয়ে যায়। সুনীল খেয়ে নেয়। সুনীল বসে থাকে। কখনও বাড়ির বাইরে দরজার পাশে, কখনও মিষ্টির দোকানের সামনের বেঞ্চিতে। ডলি ঠিক তাকে খুঁজে রুটি আর চা দিয়ে যায়। যত দিন যাচ্ছে সুনীলের নড়াচড়ার ইচ্ছে তত কমে যাচ্ছে। কারখানা বন্ধ হবার পর সুনীল কিছু দিন মিটিংগুলোতে যেত। আশা রাখত যে কারখানা না খুলুক, বকেয়া টাকাগুলো অন্তত মালিক দিয়ে দেবে। অনেক হাঁটাহাঁটি করেছে এক সময় ইউনিয়নের দাদাদের কাছে। কাজের জন্য, বকেয়া টাকার জন্য। ফাঁকা আশ্বাস ছাড়া কিছু পায়নি। এখন সেই আশাটুকুও নিভে গিয়েছে। সুনীল দুই হাঁটুর মধ্যে মুখ গুঁজে গলির ধারে বসে থাকে। একটা গাড়ি সুনীলকে দেখে হর্ন দেয়। সুনীল আরও সরে বসে। ট্যাক্সিটা সুনীলের পাশে দাঁড়ায়। বাবলা ট্যাক্সি নিয়ে বেরোচ্ছে ভাড়া খাটতে। বাবলা চন্দনের বন্ধু। এই ছেলেগুলো সুনীলকে নানা রকম ভাবে বিরক্ত করে। বাবলা সুনীলের ঠিক পাশেই থুতু ফেলে। সুনীল নড়ে না। একই ভাবে বসে থাকে। বাবলা সুনীলকে এ বার সরাসরি খোঁচায়, ‘‘এই পাগলা!’’ সুনীলের আজকাল রাগ হয় না কিন্তু একটা ভোঁতা কষ্ট হয়। বাবলা পকেট থেকে একটা সিগারেটে বার করে ধরায়। সুনীল লুব্ধ দৃষ্টিতে তাকায়। বাবলা দাঁত বের করে হাসে। বলে, ‘‘পাগলা আবার সিগারেট খাবে!’’
দশটা বাজতে যায়। এ বার মেজদা অফিস বেরোবে। মেজদা অফিস বেরোনোর সময় সুনীলকে মাঝেমাঝে বউদির নজর এড়িয়ে দু-পাঁচ টাকা দেয়। সুনীল হাত পেতে নেয়। খারাপ লাগে না। মেজদাই সংসারটা চালায়। আজও মেজদা যাবার সময় দুটো টাকা সুনীলকে দিয়ে যায়। সুনীল ডলির জন্য একটা টফি কেনে আর নিজের জন্যে কয়েকটা বিড়ি। সাবধানে বসে আয়েশ করে বিড়িটা ধরায় সুনীল।
দশটা বেজে গিয়েছে। ডলি এ বার স্কুল যাবে। যাবার আগে ডলি সুনীলকে আর এক কাপ চা দিয়ে যায় আর সকালের থালা আর চায়ের গেলাসটা তুলে নেয়। যাবার আগে ডলি সুনীলের গা ঘেঁষে ফিসফিসিয়ে বলে, ‘‘বাবা, আমার জ্যামিতি বক্সটা হারিয়ে গিয়েছে। একটা এনে দেবে? জেঠিমা জানতে পারলে আস্ত রাখবে না।’’
ডলি এখনও বোঝে না যে সুনীল পুরো জ্যামিতি বক্স কেন, একটা কম্পাসও এনে দিতে পারবে না। ডলি প্রায়ই এটা-সেটা হারায়, ভেঙে ফেলে। সুনীল কিছু বলে না। চুপচাপ চা খায়। টফিটা ডলিকে দেয়। ডলি অন্যমনস্ক ভাবে নিয়ে নেয়। সুনীলের আজকাল সারাক্ষণ মাথা ঘোরে। মাথার মধ্যে সর্বক্ষণ একটা ধোঁয়াশা ভাব। সুনীল খুব রোগা হয়ে গিয়েছে। তবে সেটা কেউ জানে না। কেউ সুনীলের দিকে নজর করে দেখে না। লতাও না। সুনীল কাউকে কিছু বলে না। প্রায় সাড়ে দশটা। বাবুর স্কুল এ বার ছুটি হবে। সুনীল ধীরে ধীরে গলির মোড় পেরিয়ে স্কুলের দিকে যায়। বাবলা এখনও মোড়ের মাথায় ট্যাক্সি নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। বিরক্ত মুখ করে চা খাচ্ছে। বোধহয় প্যাসেঞ্জার পায়নি। সুনীলকে দেখে বাবলা হেঁকে ওঠে, ‘‘কী রে পাগলা, লুঙ্গি পরে বিয়ে করতে যাচ্ছিস নাকি!’’
বাবলা সুনীলের থেকে ছোট। তবু ইচ্ছে করে তুইতোকারি করে। সুনীল কোনও জবাব দেয় না। স্কুলের দিকে এগোয়।
স্কুলের কাছে এসে সুনীলের মাথাটা পরিষ্কার হয়ে যায়। ঠিক যে রকম হাতে টুল ধরার সময় হত। সব ক’টা ইন্দ্রিয় সজাগ। এক সুতো এ দিক-ও দিক নেই। সুনীল একটা কোনা দেখে দাঁড়ায়। এখান থেকে স্কুলের গেটটা দেখা যায়। বাবু বেরোবে এখুনি। চন্দন এসে গিয়েছে। দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছে। সুনীলকে কেউ দেখতে পাচ্ছে না। ওই তো বাবু বেরোচ্ছে। সুনীল বাবুর দিকে তাকিয়ে থাকে। বাবু হাসছে। চন্দন ওকে একটা বুড়ির চুল কিনে দিয়েছে। চন্দন আর বাবু বাড়ির দিকে যাচ্ছে। সুনীল বাড়ি যাবে না। সুনীলের আজ একটা বিশেষ কাজ আছে। সুনীল ধীর কিন্তু নিশ্চিত পদক্ষেপে রেললাইনের দিকে হাঁটা দেয়। একটা প্রশান্তি নেমে আসে ওর সারা শরীর আর মন জুড়ে। চারপাশের দৃশ্যপট আস্তে আস্তে মিলিয়ে যেতে থাকে। এত শান্তি সুনীল কোনও দিন পায়নি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy