আমেরিকার উত্তরে একেবারে পাহাড়ের কোলে মন্টানা। বছরে ছ’মাস বরফে ঢাকা থাকে। এখানেই পিএইচডি করছে ওরা। আজাদ আর সুচেতনা। বন্ধুত্ব পার করে সম্পর্কটা আর একটু মোড় নিয়েছে। পরিচয় হয়েছিল ইন্ডিয়া নাইটে। সে দিন স্টেজ জুড়ে ছিল দক্ষিণীরা। কুন্তীর কথকের পর গিটার নিয়ে জমিয়ে দিয়েছিল জগদীশ। অনুষ্ঠানের মাঝামাঝি এসে যে শ্যামলা মেয়েটি গান ধরল সে সুচেতনা। সুচেতনা লোকসঙ্গীত গাইছিল—
“হো— নাও ছাড়িয়া দে, পাল উড়াইয়া দে,
ছলছলাইয়া চলুক রে নাও, মাঝ দৈরা দিয়া।
চলুক মাঝ দৈরা দিয়া।।”
সমস্ত হল মেতে উঠল বাংলা গানে। তালে তালে করতালি দিতে লাগল সাহেব-মেমরাও। আজাদের বুকের ভেতর সঙ্গে সঙ্গে ঢেউ তুলল একটা নদী। ভাটিয়ালি দ্রুত হল কাহারবায়। নদীর দেশের ছেলে আজাদ। বাংলাদেশ থেকে এসেছে। ইছামতির পাড় ঘেঁষে তার বাড়ি। অনুষ্ঠানের পর মন্ত্রমুগ্ধের মতো এগিয়ে গেল আজাদ। পরিচয় করে বাংলাদেশি নাইটেও সে সুচেতনাকে গান গাইতে রাজি করাল। মন্টানা স্টেট ইউনিভার্সিটিতে নভেম্বরে তিন প্রতিবেশী দেশ তাদের অনুষ্ঠান করে। ভারত, বাংলাদেশ আর পাকিস্তান। সে দিন একেবারে ঝুমুর ধরল মেয়েটা।
‘‘মেদিনীপুরের আয়না চিরন
বাঁকুড়ার ওই ফিতা
আরে যতন করি বাঁধলি ফিতা
তা-ও তো বাঁকা সিঁথা।’’
হইহই করে উঠল দর্শক। সিট ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। ঝুমুরের তালে তালে নেচে উঠল অডিটোরিয়াম। তারা থামতে দিতে চায় না সুচেতনাকে। সাত সমুদ্র তেরো নদীর পাড়ের দেশে নিমেষে আসন করে নিল শ্যামল, কোমল এক ভাষা তার মাটির গানে। আর আজাদ, খুলনার ইছামতি পাড়ের আজাদ উপচে পড়ল খুশিতে।
কত জনই না হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল সে দিন সুচেতনার দিকে। সিলেটের ইয়াসিন, রুবেল, রুকসানা, পাকিস্তানের আমির, বানু। মন্টানার বিগ স্কাই থেকে আসা স্যামুয়েল, জ্যাকি আরও অনেকে। তবু ভিড়ের পেছনে সরতে সরতে হঠাৎ আজাদ দেখেছিল সুচেতনার চোখ তাকেই খুঁজছে। যেন সে কতই আপনজন। আর পিছোয়নি আজাদ, সামনে পা বাড়িয়েছিল। তার পর এই পাঁচ বছরে কত বার পাহাড়ের কোলে কোলে সিসেম, মেপল, ফার, পাইনের জঙ্গলে রংবদলের খেলা দেখতে দেখতে ওরা কাছাকাছি এসেছে আরও। চোখের তারায় খেলা করে গিয়েছে সোনালি রোদ্দুর, নীল মায়াবি জ্যোৎস্না। তবু সেই ভীষণ জানা কথাটা বলি বলি করেও বলা হয়নি কিছুতেই। আজ আউসেল ফলসের ধারে কবেকার প্রাচীন কঠিন পাথরে প্রাচীনতম ভালবাসার স্বরলিপি নতুন ছন্দে লিখতে লিখতে শতাব্দীপ্রাচীন নির্ঝর ভিনদেশি এই দুটি তরুণ-তরুণীর মনে সহসা ঝঙ্কার তুলল। ওদের আড়াল ঘুচে গেল। এ বার দেশে ফেরবার সময় দুজনেই ভারি ফুরফুরে মেজাজে ছিল। দুজনেই চাকরি পেয়েছে। সল্টলেক সিটিতে আজাদ আর সুচেতনা আইডহে। পাশাপাশি দুটো স্টেট। একটা গাড়ি কিনলে একসঙ্গেই থাকা যাবে। দুবাই পর্যন্ত একসঙ্গে উড়ান। বিশাল আলো ঝলমলে দুবাই এয়ারপোর্টে ট্রেনে করে খানিকটা ঘুরে বেড়াল দুজনে। জমানো পয়সা থেকে একটা ছোট্ট সোনার আংটি আজাদ কিনেই ফেলল একটা ডিউটি ফ্রি স্টল থেকে। লাজুক হাতে পরিয়ে দিল সুচেতনার অনামিকায়। ঢাকার প্লেন ছাড়ল আগে। কলকাতার প্লেন ছিল তার ঘণ্টা খানেক পর। দিন পনেরোর ছুটি। তার মধ্যেই দু’বাড়িতে রাজি করাতে হবে। পারবে না? দু’জনেই ভাবছিল। ধর্মটা কি অচলায়তন হবে? কখনওই নয়। সুচেতনার দাদু যে ১৯৫২-র ভাষা আন্দোলনে শহিদ হয়েছিলেন। নিখিলেশ চক্রবর্তী। নামটা জেনে নিয়েছে আজাদ। সে জানে তার মা-বাবা ভাষা আন্দোলনের প্রতি কতটা শ্রদ্ধাশীল। পুরনো ঢাকায় তাদের আদি বাড়ি। সরকারি চাকরি পেয়ে বাবা পরে খুলনায় চলে আসে। তবু প্রতিটি একুশে ঢাকায় যায় তারা। একুশে বইমেলায় ছোট থেকেই বই কিনেছে আজাদ। মুখোমুখি দেখেছে তার প্রিয় লেখক হুমায়ুন আহমেদকে। ওঁর সই করা বই আছে তার সংগ্রহে। এ বার সে বই নিয়েই ফিরবে আজাদ, দেখাবে সুচেতনাকে। সুচেতনাও যে হিমু আর মিসির আলি গুলে খেয়েছে। আজাদ কথা দিয়েছে সুচেতনাকে ঘুরিয়ে আনবে বরিশাল, সেই অন্য রকম নির্জনতম কবির দেশে, যাঁর কলমে জন্ম নিয়েছিল ‘সুচেতনা’। স্বপ্নে বিভোর হয়ে যায় আজাদ। কোনও এক জ্যোৎস্না রাতে ইছামতীর বুকে গফুর মাঝির নৌকায় সে সারা রাত সুচেতনার গান শোনে। জোয়ারের ভরা নদী ছলাক ছলাক করে আজাদের ছাব্বিশের ঘাটে।
কলকাতার উড়ানে জানলার পাশের সিটে আংটিটার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে বসেছিল সুচেতনা, না কি আংটিটাই তার দিকে? পাশের যাত্রীটি মোবাইলে মগ্ন। অলক্ষে ফিক করে একটু হাসল সে। ছোট্ট একটা কল্কা, খুব পছন্দ হয়েছে তার। বাড়িতে বলতে হবে। একটুও ভয় হচ্ছে না তার। সব্বার আগে বলবে ঠাম্মিকে। বলবে, ‘‘মিঞা তোমাগো দ্যাশের লোক।’’ ব্যস, ওতেই হবে। সুচেতনা জানে ঠাম্মির দেহটাই শুধু এ দেশে এসেছে, মনটা আজও পড়ে আছে সেই মানিকগঞ্জে। সাতচল্লিশেও দেশের মাটি আঁকড়ে ছিল ওরা। বাহান্নতে দাদু শহিদ হলেন। তবু দেশ ছাড়েনি ঠাম্মি। স্কুলে পড়াতেন। দেশ ছাড়তে হল সত্তরে। বাবা তখন এতটুকু। দেশের গল্প কত যে শুনেছে সুচেতনা। পদ্মা! মেঘনা! তাদের বিশাল বিশাল ঢেউ! বলতে বলতে ঠাম্মির চোখে ঘোর। শ্রাবণ মাসে বিয়ে হয়েছিল। শ্বশুরবাড়ি আসবার সময় মেঘ করল। নৌকা যখন মাঝনদীতে আকাশ কালো করে এল। ঝপাঝপ বৈঠা ফেলছে মাল্লারা। নকুড় মাঝি শক্ত করে ধরে রেখেছে হালখানা। কত প্রাণ যে নিয়েছে নদী! কোলের কাছে আরও ঘেঁষে বসত সুচেতনা। কী যেন আছে ঠাম্মির বলায়। সুচেতনাকে ছুঁয়ে যেত সেই সর্বনাশী জল।
‘‘তুমি ভয় পেয়েছিলে ঠাম্মি?’’ সুচেতনা জিজ্ঞেস করত।
‘‘ভয়?’’ কনেবৌটির মতো হাসত ঠাম্মি, ‘‘এ পার দেহন যায় না ও পার দেহন যায় না। আকাশ ঝিলকায়। ম্যাঘ গুড়গুড়াইয়া উঠে। লাইজলজ্জা বিসর্জন দিয়া নূতন বৌ এক্কেরে বরের কুলে উইঠ্যা গলা আঁকড়াইয়া ধরে।’’
ঠাম্মি বলত আকাশছোঁয়া ধানক্ষেতের গল্প। বলত, ফিতের মতো সরু আলপথ ধরে চাষিবৌরা মাথায় করে নিয়ে ফিরত ধানের আঁটি। ছবির মতো দেখতে পেত সুচেতনা। আলপথের সেই বাতাস যেন স্পর্শ করত তাকে। তাই না সে শহর কলকাতার কংক্রিটের মধ্যে বড় হয়েও গানে মিশিয়ে দিয়েছে মাটির টান। ঠাম্মি তার প্রাণ। ঠাম্মি নিশ্চয়ই সম্মান করবে তার সিদ্ধান্তকে। সুচেতনা স্মিতমুখে বাড়ি ফেরে। ঠাকুরঘর থেকে নেমে এল ঠাম্মি। জড়িয়ে ধরল প্রাণের চেয়ে প্রিয় নাতনিকে। সুচেতনা ঠাম্মির তসরে ছেলেবেলার মতো খুঁজে নিল চন্দনগন্ধ। তবু অঙ্ক মিলল না। আজাদের কথায় ম্লান হয়ে এল প্রদীপ। সেই নিভু নিভু আলোয় সুচেতনার সামনে উঠে এল গোপন করে রাখা এক নির্মম ইতিহাস! নিখিলেশ শহিদ হওয়ার পর গ্রামে ওদের মর্যাদা বেড়েছিল। সবাই হাত তুলে দেখাত ওদের বাড়ি ওই যে! কিন্তু সময় বদলাচ্ছিল। সত্তরে পাকসেনা কুঠিবাড়িতে ক্যাম্প বসাল। রফিকসাহেবকে ধরে নিয়ে গিয়ে উলঙ্গ করে ঘোরাল। তারেক আর জামালকে উল্টো করে বেঁধে ঝুলিয়ে রাখল গাছে। প্রতিবেশী সইদুল বন্দি হয়ে কাঁপতে কাঁপতে বলে ফেলেছিল, ‘‘ছাইড়্যা দ্যান কত্তা, আমরা মোছলমান এক্কেরে খাঁটি মোছলমান। ওই অরা হিঁদু , ভাষা শহিদের পরিবার!’’
বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দিয়েছিল ওরা। ছেলেমেয়ে নিয়ে তার আগেই বার হয়েছিল ঠাম্মি। কিন্তু হাত ছাড়িয়ে তাঁর সাত বছরের মেয়ে উপাসনা হঠাৎ ছুটে গিয়েছিল আগুনের দিকে। তার পুতুলটি আনা হয়নি যে। তাকে তুলে নিয়েছিল ওরা। ফিরতে পারেনি ঠাম্মি। কোলে ছেলে। চিৎকার করে কাঁদতেও পারেনি। বহু দিন গুম হয়েছিল।
‘‘মা কি রাজি হবে!’’ বাবা মাথা নিচু করল। মা নিঃশব্দে আঁচলের প্রান্ত জড়াচ্ছে আঙুলে। মাথা নামিয়ে ফেলেছিল সুচেতনাও। তার অনামিকায় ঝিকঝিক করছিল আংটিটা। এমন সময় মাথায় চন্দনস্পর্শ। ঠাম্মি! ঠাম্মি বলল, ‘‘তর বাবায় যে ভাষা শহিদ আছিল শশাঙ্ক, হের বাসায় হিন্দু-মুসলমান ভেদ করতে নাই।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy