২২ নভেম্বর ২০২৪
একুশের সেরা ২১

নিজেরে হারায়ে খুঁজি

 সঞ্জীব গোস্বামী
সঞ্জীব গোস্বামী
শেষ আপডেট: ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ০০:০৪
Share: Save:

রবিবার, ছুটির দিন। তাই জিন্‌স আর শার্ট পরে সকাল এগারোটার সময় বেড়িয়ে পড়লাম। ইচ্ছে আছে, সপ্তাহের বাজারটা এখনই সেরে রাখব।

ভার্জিনিয়া টেক থেকে পিএইচডি করে সপ্তাহ খানেক আগে নতুন চাকরি নিয়ে হ্যাম্পটন শহরে এসেছি। এখনও সে রকম চেনাশোনা হয়নি। অপরাজিতার থিসিস সাবমিট এখনও মাস ছয়েক বাকি, তাই ও এখনও কলেজের হোস্টেলেই আছে।

গুটি গুটি পায়ে রুট ১৩৪ হাইওয়ে দিয়ে যাচ্ছি। এখানে রাস্তার ধারে সুন্দর করে বাঁধানো ফুটপাথ। মনের খুশিতে ‘আজি ধানের ক্ষেতে রৌদ্র ছায়ায়’ গানটা ভাঁজতে ভাঁজতে মিনিট দশেক এগিয়েছি, হঠাৎ কানে এল, ‘‘আরে, ইন্দ্রজিৎ না?’’

ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি রাস্তার পাশের বেঞ্চিতে বসা এক জন বৃদ্ধ আমার দিকে হাসিমুখে তাকিয়ে। কয়েক মুহুর্ত চেয়ে থেকে ধরতে পারলাম, প্রফেসর এরিক মেসন। ভার্জিনিয়া টেকের মেকানিক্সের প্রফেসর ছিলেন, বছর সাতেক আগে রিটায়ার করেছেন। ভালই আলাপ ছিল কিন্তু যোগাযোগ রাখা যায়নি।

মুখে বয়সের ছাপ পড়েছে, কিন্তু নীল চোখ দুটো এখনও উজ্জ্বল। এত দিন পর দেখে ভীষণ ভাল লাগল, পাশেই বেঞ্চিতে বসে পড়লাম।

‘‘কেমন আছেন স্যার? গ্ল্যাড টু মিট ইউ।’’

‘‘চলে যাচ্ছে। তোমার কী খবর? থিসিস জমা দিয়েছ?’’

‘‘হ্যাঁ স্যর, গত মাসে।’

"গুড। তা হলে তো আবার সেই ব্যাচেলর লাইফ!"

একটু খটকা খেলাম, অপরাজিতার সাথে ওঁর অনেক বার দেখা হয়েছে। আমাদের মেকানিক্স সার্কেলে আমি আর অপরাজিতা অনেক বার একসঙ্গে মিটিংয়ে গিয়েছি। এরিকের বাড়িতেও আমরা দু’জনে ডিনার খেয়েছি।

তা-ও সামলে বললাম, ‘‘স্যর, অপরাজিতার সাথে তো আপনার আলাপ আছেই।’’

উনি অবাক হয়ে হাসলেন , ‘‘অপরাজিতা? আর ইউ ম্যারেড দেন? গ্রেট, আমার সাথে বৌ-এর আলাপ করিয়ে দাওনি তো!’’

আমি একটু অবাক হয়ে কী বলব ভাবছি। উনিই বললেন ‘‘এনিওয়ে, একদিন বাড়িতে এসো, জমিয়ে গল্প করা যাবে।’’

আমরা যেখানে বসে আছি তার ঠিক পেছনেই কিছু ঝোপঝাড় আর ফুলগাছে ভর্তি। এতক্ষণ লক্ষই করিনি, ওখানে একজন বয়স্ক মহিলা গাছের কাছে বসে কিছু করছেন। এমন সময় মহিলা ডেকে উঠলেন ‘‘হাই এরিক, দেখেছ, ব্লু মিস্ট শ্রাব, ব্লু ডেইজ়ি, কত কিছু ফুটে আছে।’’

ভদ্রমহিলা কাদামাখা হাতে একরাশ নীলরঙের ফুল নিয়ে ফুলগাছের ঝোপ থেকে উঠে এলেন।

মুখে হাসি নিয়ে বললেন "এরিক, জাস্ট লুক অ্যাট দিস ফ্লাওয়ার্স। বেশ কয়েকটার শেকড়ও আছে, আমি নিয়ে বাগানে পুঁতব।’’

এরিক হাসলেন , ‘‘অ্যাজ ইউ উইশ, ডার্লিং। নাউ জেনিফার, কাম হিয়ার ... মিট মাই স্টুডেন্ট ইন্দ্রজিৎ, এ রিয়েলি ব্রাইট ওয়ান"।

জেনিফার হাসিমুখে আমার দিকে কয়েক পা এগিয়ে এলেন - "নাইস টু মিট ইউ, ইন্দ্রজিৎ।’’

উনি চিনতে পারলেন না দেখে অবাক হলাম। ভি টেক ক্যাম্পাসে অনেক বার কফি শপে আড্ডা মেরেছি, ডিনার খেয়েছি একসঙ্গে। নাম এক হলেও ওনাকে দেখতে পুরোপুরি আলাদা। এ বার পুরো ধন্দে পড়ে গেলাম। তা হলে কি স্ত্রী মারা যাওয়ার পর এরিক আবার বিয়ে করেছেন? বা ডিভোর্স? এখানে এ সব হয়, তাই কথা বাড়ালাম না।

আমরা তিন জনে পাশাপাশি বেঞ্চিতে বসে পড়লাম। আমি শুরু করলাম , ‘‘আচ্ছা এরিক, আপনি ভার্জিনিয়ায় কবে এলেন? রিটায়ারমেন্টের পরে তো আপনি তোমার বার্থপ্লেস মিসৌরিতে চলে গিয়েছিলেন বলে শুনেছিলাম।’’

‘‘না না, মিসৌরি কেন? আমি তো রিচমন্ডে আছি।’’

আবার অবাক, রিচমন্ডে? আমার সব ঘুলিয়ে যাচ্ছে, হয়তো আমার কোথাও ভুল হচ্ছে । ‘‘ওখানেই বাড়ি করেছ তাহলে?"

জেনিফার উত্তর দিল - ‘‘হ্যাঁ, বড় বাড়ি। একসঙ্গে অনেকে থাকি।’’

এরিক হাসলেন - ‘‘বেশ বড়, বুঝলে। প্রায় পঞ্চাশজন একসঙ্গে থাকি।’’

পঞ্চাশ জন? সে কী ? বৃদ্ধাবাস নাকি? অবাক হলাম কারণ প্রফেসরদের পেনশন এখানে ভাল। তা ছাড়া এরিকের ফ্যামিলি বেশ পয়সাওয়ালা বলেই শুনেছিলাম। খটকা যাচ্ছে না। জেনিফারের দিকে তাকিয়ে বললাম - "জেন, আপনার বড় ছেলে ডেভিডের সাথে তো আলাপ হয়েছিল। কোথায় আছে এখন?" জেনিফার হাসলেন। ‘‘তুমি তো বড্ড ভুলোমনা, ইন্দ্রজিৎ। আমার তো বড় মেয়ে, সান্ড্রা। ও ক্যালিফোর্নিয়ায়, সিলিকনভ্যালিতে আছে।’’

আবার বোকা হয়ে এরিকের দিকে তাকালাম। এরিক হাসলেন। ‘‘আরে ও রকম হয়, ওকে বোকো না জেন। ঠিকই বলেছ ইন্দ্রজিৎ, ডেভিড আমার মেজো ... ও নেব্রাসকায় সেটল্‌ড।’’ এরিকের কোনও মেয়ে ছিল বলে ক্যাম্পাসে থাকতে শুনিনি, দেখিওনি। ডেভিডের সাথে বিয়ার পার্টি হত। সব কিছুই কেমন ঘোলাটে, কাজেই ডিপার্টমেন্টের কথায় এলাম। ‘‘ভি টেকের কারোর সাথে যোগাযোগ রাখেন, এরিক?" এরিক বিষণ্ণ মুখে বলল, ‘‘নাহ্। প্রথম জন, সেবাস্তিয়ান বা রিচার্ড যোগাযোগ রাখত। এখন তো শুধু বেথানিই উত্তর দেয়, অন্যরা সবাই সায়লেন্ট।’’ একটু আশ্বস্ত হলাম, নামগুলো সবই চেনা।

জেনিফার নীল ফুলগুলো কোলের ওপর রেখে যেন হাত দিয়ে আদর করছিলেন। আমি সেটা দেখেই বললাম ‘‘জেনি, ক্যাম্পাসে কোয়ার্টারের বাগানটার কথা মনে আছে?’’ জেনিফার কেমন শূন্য দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাল, ‘‘তোমরা কী সব ভার্জিনিয়া ভার্জিনিয়া করছ, আমি ও দিকে কখনও যাই নি। আমার বাড়ি তো সাউথ ক্যারোলিনায়।’’

একদমই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে এরিকের দিকে তাকালাম। এরিক তখন দূরে আকাশে একঝাঁক উড়ন্ত পাখির দিকে তাকিয়ে। কী বলব ভাবছি,হঠাৎ তীব্র সাইরেনের শব্দ আর তিনটে গাড়ি আমাদের সামনের রাস্তায় এসে থামল। সেখান থেকে বন্দুক আর ব্যাটন হাতে অন্তত দশ জন মার্শাল নেমে আমাদের ঘিরে দাঁড়ালেন। সব শেষে একজন বছর পঞ্চাশের মহিলা নেমে এলেন, পিছনে আরও দুজন নার্স। মহিলা আমাদের সামনে এসে দাঁড়ালেন তার পর খুব আদরের সঙ্গে ডাকলেন ‘‘এরিক, ক্যারোলিন ... চলো, এ বার আমাদের যেতে হবে। লাঞ্চের সময় হয়ে গিয়েছে ডার্লিং।’’

আমি হাঁ হয়ে সব শুনছি। মহিলাকে দেখে এরিক উঠে হাত বাড়িয়ে দিলেন, জেনিফারও উঠে দাঁড়ালেন। আমি কী করব বুঝতে না পেরে উঠে দাঁড়ালাম। মহিলা আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললেন ,কী, খুব অবাক হচ্ছ? তাই না? বাই দি ওয়ে, আমি এলিজ়াবেথ।" আমি মাথা নাড়লাম ,‘‘একদম। কিচ্ছু বুঝছি না।’’ ‘‘সব ভুলে গিয়েছে। ওরা দুজনেই। অ্যালঝাইমার্স। বেশ অ্যাডভান্সড স্টেজে আছে, পুরনো কথা প্রায় কিছুই মনে নেই। তাও এরিকের একটু ভালো কন্ডিশন। ক্যারোলিন তো নিজের আইডেন্টিটিও গুলে খেয়েছে।’’

খাবি খেয়ে বললাম ‘‘এরিক ওঁকে জেনিফার বলছিলেন কেন?’’

‘‘খুব স্যাড কেস। জেনিফার এরিকের আসল ওয়াইফ। এরিক রিচমন্ডের ইনস্টিটিউটে আসার পর প্রত্যেক মাসেই আসত। বছর তিনেক হল মারা গিয়েছে, ক্যানসারে ... ভীষণ স্মোক করত।’’ এই বার আমার মেমোরির সাথে মিলছে। বললাম ‘‘আমি এরিক আর জেনিফারকে কলেজ থেকেই চিনি। আজ এখানে দেখে খুব অবাক হয়েছিলাম।’’

‘‘আসলে মাসে এক বার রোগীদের ঘুরতে নিয়ে যাওয়া হয়। আজ আমরা সবাই বাসে করে হ্যাম্পটনের একটা পার্কে এসেছিলাম। সবাই যখন বসে মজা করছে তখন ওরা দুজন সায়লেন্টলি পালিয়েছিল। ওদের হাতে জিপিএস ট্যাগ লাগানো। তাই ট্র্যাক করে খুঁজে পেলাম। এরিককে ওর বৌয়ের মারা যাওয়ার কথা বলা হয়নি। ওর আর ক্যারোলিনের মেমরি ফেল করার পর ওরা দুজনেই নিজেদের হাজ়ব্যান্ড-ওয়াইফ হিসাবে দেখছে, আমরা বাধা দিই না।’’

আমি হেসে মাথা নাড়লাম। এরিক আর ক্যারোলিন হাত ধরাধরি করে গাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে, আমার কথা যেন ভুলেই গিয়েছেন। সবাই গাড়িতে উঠতেই আবার সাইরেন বাজিয়ে গাড়িগুলো বেরিয়ে গেল। তাকিয়ে দেখি ক্যারোলিন সব ফুল ফেলে গিয়েছেন। ওখানে রেখে যেতে বড্ড মায়া হল। সেই নীল ফুলের তোড়া হাতে নিয়ে আবার বাড়ির দিকে হাঁটতে লাগলাম।

আজ আর শপিং করতে ভাল লাগছে না!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
Follow us on: Save:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy