ঠিক বেরোবার মুখে সুদীপের ফোনটা পেয়ে বিদিশার মনটা বিরক্তিতে ভরে গেল। সুদীপ আসতে পারবে না, জরুরি মিটিং পড়ে গিয়েছে। বলেই খালাস, যেন পমকে মানুষ করার সব দায়িত্ব বিদিশার একারই। আজ মেয়ের বিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠা দিবসের পঞ্চাশ বছর পূর্তির অনুষ্ঠানের বিশাল আয়োজন করা হয়েছে। অনেক নামীদামি অতিথির সামনে নাচ, গান, নাটক সব কিছুই হবে। এ বারে প্রথম বার পম একক গাইবার সুযোগ পেয়েছে, তাই প্রথম থেকেই উত্তেজনায় বিদিশা একেবারে ফুটছিল, সুদীপ একেবারে জল ঢেলে দিল!
কথাটা বললেই সুদীপ বলবে, ‘‘তোমার সম্পূর্ণ নিজের সিদ্ধান্তে মেয়েকে মানুষ করছ। আমি শুধু টাকা জুগিয়ে যাচ্ছি, এটাই তো ভাল। মাথা গলালেই মাথা ঘামাতে ইচ্ছা করবে।’’
নামী ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনা, সপ্তাহে দু’দিন পাশ্চাত্য সঙ্গীতে তালিম নিতে যাওয়া— সব সিদ্ধান্তই বিদিশার। গানের ব্যাপারে প্রথম দিকে সুদীপের একটু খুঁতখুঁতানি ছিল, কিন্তু ধোপে টেকেনি। পমের এখন ক্লাস নাইন। সেভেন পর্যন্ত পাশ্চাত্য নৃত্যেও তালিম নিতে যেত কিন্তু সে পড়াশোনার চাপ দেখিয়ে প্রায় জেহাদ ঘোষণা করে ছেড়ে দিয়েছে। এই নিয়ে বিদিশার খুব দুঃখ আছে, সে মেয়ের মধ্যে দিয়েই নিজের অসম্পূর্ণ ইচ্ছাটাকে পূরণ করছিল। কিন্তু পম তার মায়ের মতোই একরোখা। সে তার স্কুলের অন্যান্য বন্ধুদের মতো অত্যাধুনিক পোশাকেও খুব একটা আগ্রহী নয়। উল্টে ইদানীং দু-একটা অনুষ্ঠানে শাড়ি পরার আগ্রহ দেখে বিদিশা বিস্মিত হয়েছে। আর এর জন্য তার শাশুড়ির উপরে রাগটা আরও বেড়ে গিয়েছে। শ্যামলী কবে জন্মস্থান ছেড়ে চলে এসেছে, তবুও তার শোক এখনও ভুলতে পারেনি, ভাষাও ছাড়েনি। মেয়ের বিদ্যালয়ে মায়েদের একটা দল আছে, তাদের মাঝেমধ্যেই এর-ওর বাড়িতে একটা ছোটখাটো সম্মেলন হয়, যখন তাদের বাড়িতে হয় তখন তো বিদিশা শ্যামলীর ওই রকম টানযুক্ত ভাষার জন্য লজ্জায় তটস্থ হয়ে থাকে। অথচ এই সাধারণ, আটপৌরে, আদ্যন্ত ভেতো বাঙালি মানসিকতার মানুষটা পমের বেস্ট ফ্রেন্ড! তার সঙ্গেই সারাদিন গুজগুজ ফুসফুস চলে। শ্যামলী নাকি ছোট থেকেই গান শিখত। বিয়ের পরে আস্তে আস্তে ও সব পাট চুকে গিয়েছে। কিন্তু গান তাকে আজও ছাড়েনি। বিয়ের পর থেকে অনেক ঘরোয়া অনুষ্ঠানে বিদিশা তার গান শুনেছে, সুমিষ্ট স্বর, কিন্তু ও সব গান তার বরাবরই প্যানপ্যানে মনে হয়। ছোটবেলায় পম তার ঠাম্মার কাছ থেকে রবীন্দ্রসঙ্গীত শিখে গাইত, বিদিশার কড়া হুকুমে সেটা বন্ধ হয়ে গিয়েছে, কারণ রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইলে স্বর মোটা হবেই, আর সেটা পাশ্চাত্য সঙ্গীতের পক্ষে বেমানান। এই নিয়ে পমের সঙ্গে বিদিশার একটা তীব্র মন কষাকষি আছে, আর তার সমস্ত ঝাল গিয়ে পড়ে শ্যামলীর উপরে।
ঝলমলে অনুষ্ঠান একেবারে শেষের পর্যায়ে। এ বারে পমের একক গান হবে। পম টাইটানিকের সেই বিখ্যাত গানটা গাইবে। মেয়েটা খুব ভাল গায় এই গানটা। বিদিশা নড়েচড়ে বসল। আসার সময়ে পমের পোশাক নিয়ে একটা ছোটখাটো অশান্তি হয়ে গিয়েছে। এই অনুষ্ঠানের জন্য বিদিশা নিজে পছন্দ করে একটা উজ্জ্বল পোশাক কিনে এনেছিল, কিন্তু পম তার ঠাম্মার দেওয়া একটা সাদার উপরে গোলাপি আর সোনালি সুতোয় কাজ করা ঘাঘরা পরে বেরিয়ে এসেছিল। কার প্রশ্রয়ে এটা করেছে ভেবেই তখন সে প্রচণ্ড ক্ষেপে গিয়েও, পরমুহূর্তে রাগটা গিলে নিয়েছিল, কারণ পম যদি বিগড়ে যায়, তা হলে অনুষ্ঠানে যাওয়াই বাদ দিয়ে দিতে পারে। তবে ফিরে গিয়ে যে এটার একটা হেস্তনেস্ত করবে, এইটা মনে মনে ভেবে এসেছে।
আলোর বন্যায় পম ভাসতে ভাসতে মঞ্চে এসে দাঁড়াল। বড়দের প্রণাম আর বন্ধুদের ভালবাসা দিয়ে বলতে শুরু করল, ‘‘আজ যে ইংরেজি সিনেমার গানটা আমার গাওয়ার কথা, কোনও একটা বিশেষ কারণে আমি সেটা না গেয়ে ম্যামের অনুমতি নিয়েই একটা বাংলা গান গাইতে চলেছি।’’
বিদিশা হাঁ হয়ে গেল, পম কী বলছে এ সব! গান পাল্টানোর কথা তাকে এক বারও বলেনি তো! কী হচ্ছে এ সব?
পাশ থেকে ফিসফাস শুরু হয়ে গিয়েছে, কারণ সে সবাইকে গানটার কথা বলে রেখেছিল। অপমানে তার কান লাল হয়ে উঠছিল।
‘‘মোদের গরব, মোদের আশা, আ মরি বাংলা ভাষা!
তোমার কোলে, তোমার বোলে, কতই শান্তি ভালবাসা!’’
সমস্ত হলে সূচ পড়ার স্তব্ধতা। গান শেষ হতেই হাততালিতে ভেসে গেল হল। বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতার স্ত্রী অর্থাৎ বর্তমান আধিকারিকের মা উঠে দাঁড়াতেই প্রায় সবাই সম্মোহিতের মতো উঠে দাঁড়াল। তিনি পমকে কাছে ডাকলেন। পম গিয়ে প্রণাম করতেই তিনি তাকে প্রায় জড়িয়ে ধরলেন। দুজনে কী কথা বলে চলেছে শোনা যাচ্ছে না, কিন্তু দেখতে দেখতেই বিদিশার চোখ দুটো ভিজে উঠল। সেই জন্যই কয়েক দিন ধরে এই গানটাই সে শ্যামলীর মুখে শুনছিল, যাতে শুনে শুনেই তার গানটা কণ্ঠস্থ হয়ে যায়!
কিছু ক্ষণ ধরে ওঁর সঙ্গে কথা বলার পর হঠাৎই পমকে তার দিকে ছুটে আসতে দেখে বিদিশা ঘাবড়ে গেল। তবে তার এখনও অনেক চমক বাকি ছিল।
সুমিত্রার দামি শাড়ি, গয়না দেখে বিদিশা মনে মনে তার শাশুড়িকে নিয়ে বেশ চিন্তিত হয়ে পড়েছিল, কিন্তু প্রাথমিক হতভম্বতা কাটিয়ে যখন তারা সেই ছোটবেলার উচ্ছ্বাস নিয়ে পরস্পরের আলিঙ্গনে বাঁধা পড়ল, তখন সে-ই হতভম্ব হয়ে গেল।
‘‘তোমরা জানো, তোমার শাশুড়ি কত ভাল গান গাইত? বাবা মারা যাওয়ার পরে আমি কলকাতায় মামাবাড়ি চলে এলাম। ব্যস, কিছু দিন পরে যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে গেল। বিয়ের অনেক পরে ঢাকায় গিয়ে শুনেছিলাম, ওরাও পরে কলকাতায় চলে এসেছিল। সেই থেকে খোঁজা শুরু, আজ নাতনির জন্য শেষ হল। ও যদি না এই গানটা গাইত, তা হলে আজও খুঁজে পেতাম না। মনে হচ্ছিল ভাষার মাসে যেন সেই স্কুলের শ্যামলী গাইছে, তাই তো গান শেষ হতেই ভীষণ কৌতূহলে ওকে ডেকে নিলাম, কোন বিশেষ কারণে ও এই গানটা গাইছে?’’
ইতিমধ্যে সুদীপও বাড়ি ফিরে সিনে ঢুকে পড়েছিল। সে গদগদ হয়ে সুমিত্রার কথা শুনছিল। শ্যামলীর মুখে বালিকাসুলভ লজ্জা ফুটে উঠছিল। বিদিশা তাকিয়েছিল। সে এত দিন নিজের গরবেই মজে ছিল, কোনও দিন আলাদা ভাবে শ্যামলীর মূল্যায়ন না করেই এক রকম বাতিলের দলে ফেলে দিয়েছিল।
‘‘পরিচয় করিয়ে দিই, আমার একমাত্র ছেলে আর বৌমা। খুব গুণী মেয়ে, ছেলে তো একটুও সময় পায় না, ও একাই নাতনিকে মানুষ করছে।’’
লজ্জায় বিদিশার অর্ধেক কথা কানেই ঢুকছিল না।
এত দিন শ্যামলী তাদের পরিচয়ে পরিচিত হত, আজ তারা শ্যামলীর পরিচয়ে পরিচিত হচ্ছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy