মেয়েটি আমার কাছে প্রথম যে অবস্থায় এল, তার হুবহু বর্ণনা দিচ্ছি। বয়স ৭+, গায়ের রং কালো। শুকনা পাতলা হাড় জিরজিরে শরীর। একই রঙের জামা, পায়জামা। একটি গাছের শিকড় লাল সুতা দিয়ে হাতের কব্জিতে বাঁধা। মাথায় সামান্য কোঁকড়ানো চুল। এক আঙুল সমান একটি চুলের বেণী।
‘‘তোমার নাম কী?’’
চুপ করে রইল । দু’বার জিজ্ঞেস করলাম, কিছুই বলল না । কিছু খাওয়াতে পারলাম না। সোফার উপর ঘুমিয়ে গেল। প্রতিবেশী এক ভাবি হঠাৎ এসে দেখে মেয়েটি সোফায় ঘুমিয়ে আছে। ভাবি বলে, ‘‘এখানে ঘুমোচ্ছে কেন?’’ বললাম, ‘‘নতুন আসছে।’’ ভাবি হেসে বলে, ‘‘বুঝা যাচ্ছে একদম টাটকা নতুন। নয়তো এখানে শুয়ে থাকার কথা নয়।’’ সন্ধ্যা হতেই চিন্তা হল, এত ছোট মেয়ে রাত্রে বিছানা নষ্ট করে দেওয়া অস্বাভাবিক নয়। অথবা দরজা খুলে এক দিকে হাঁটা দিলে কী করব! ঢাকা শহর, কোথায় খুঁজব। ভাবলাম পাঠিয়ে দিব। পাঠাতে পারলাম না। মেয়েটা কান্নাকাটি করে না । ভাল খাবার দেখলে খুশিতে তাড়াতাড়ি খেতে বসে। ওকে যত্ন সহকারে খাওয়াতে লাগলাম । আর দরজায় তালা লাগিয়ে রাখতাম। এক দিন তালা লাগাচ্ছি, ও আমাকে ইশারায় না করে। তালার দরকার নেই। ও যাবে না। আশ্বস্ত হলাম। কয়েক দিন পর ওর বাবা-মা জানতে চাইল ও কেমন আছে। ‘‘ভাল।’’ প্রথমেই আমার প্রশ্ন ছিল, ওর হাতে লাল সুতা কিসের? ওর মা বলে ওর সঙ্গে খারাপ কিছু আছে। কি রকম খারাপ! ওর সাথে আগলা কিছু আছে! আমাকে যা বুঝাচ্ছে তা হল ওর সঙ্গে জিন/ শয়তান জাতীয় কিছু আছে ।
জিজ্ঞেস করলাম, ‘‘তুমি কেমনে বুঝলা?’’
বলে, ও কথা বলতে পারে না । ভাত খায় বেশি, আরও কী কী ।
মেয়েটি কোনও কাজ করতে পারে না, কথা বলতে পারে না, কানে কম শোনে। বললাম, ‘‘ওকে নিয়ে যাও।’’
বলে, ‘‘কাজ না করলে মাইর লাগাবেন।’’
‘‘আমি মারতে পারব না।’’
মেয়ের মা চুপ করে আছে।
‘‘আচ্ছা, কয়েক দিন দেখি। তবে, এই লাল সুতাটি আমি রাখব না, ছিঁড়ে ফেলব।’’
মা চুপ করে আছে। কথা শেষ। মেয়েটি একটু একটু কাজ করে। বুঝতে পারলাম ও দুই-একটি শব্দ উচ্চারণ করতে পারে। যেমন দরজাকে ‘দুয়ার’, ভাতের প্লেটকে ‘থালা’, গোসল করাকে ‘নাইতে যাওয়া’ বলে, কিন্তু আমাদের শব্দগুলো ও উচ্চারণ করতে পারে না এবং একটা বাক্য একেবারে উচ্চারণ করতে পারে না । ওর শব্দগুলোই আমরা ঘরে বলতে থাকলাম। আমরা ওকে তুই করে বলি, ও আমাদেরকে তুই করে বলে। বুঝলাম তুই বলাটা ওর জন্য সহজ। ও চা কে বলে চা-হা । আমরাও চা-হা বলতে থাকলাম । আমাদের এখানে থাকতে চাওয়ার কারণ বুঝলাম, বাড়িতে ওর ছোট দু’টি ভাই আছে। দু’টি ভাই ওকে অনেক মারধর করে, ও কেন কথা বলতে পারে না তাই।
বছর গড়াল। মেয়েটির জন্য আমাদের মায়া হয়ে গেল। মনে হল, সে ঘরের একজন সদস্য। মেয়ের বাবাকে প্রচুর সাহায্য করতে থাকলাম। কিন্তু মেয়ের মা অসন্তুষ্ট । আমরা বেতন কম দিই, ঠকাই। মেয়েটা বড় হচ্ছে, ওকে কখনও বাইরে যেতে দিই না। মেয়েটাও বুঝে গিয়েছে, বাইরে যাওয়া নিরাপদ নয়। প্রায় পাঁচ বছর হয়ে গেল। মাঝখানে দু’-তিন বার বাড়িতে গিয়েছিল। এক বার গেল, কিছু দিন পর খবর পেলাম আমাদের এখানে আসার জন্য ব্যাগ হাতে নিয়ে থাকে, আর ওর বাবাকে বলে ‘‘আমাকে ঢাকা নিয়ে যা।’’ ওর বাবাকে ফোন দেই। ওর বাবা ঘুরাতে থাকে। এক ফাঁকে বলে বেতন আরও বাড়াতে হবে। আমরা রাজি হয়ে যাই। এই বার বাসায় আসলে ডাক্তার দেখাই। তেমন কোনও সমস্যা নেই, কিছু ওষুধ দিলেন। খাওয়ালাম। কথার তেমন কোন উন্নতি হয়নি। মেয়েটির ঠান্ডার সমস্যা হলে একদম কানে শোনে না, আরও কষ্ট হয়। হঠাৎ মেয়ের মা ফোন দিয়ে বলে, ‘‘মেয়ের বিয়ে ঠিক হয়ে গিয়েছে, মেয়েকে নিয়ে যাব।’’ আমার সন্দেহ হল। বললাম, ‘‘আরও দুই-এক বছর মেয়েকে তোমার কাছে রাখো, অন্য কোন বাসায় দিয়ো না। ও কথা বলতে পারে না। ও কোনও প্রতিবাদ করতে পারে না। মেয়ে মানুষ! বিপদে চিৎকার দিয়ে কিছু বলতে পারবে না।’’ যাওয়ার সময় মেয়ের জন্য বিয়ের শাড়ি এবং কানের গোল্ডের জিনিস, সাজগোজের আরও অনেক অনেক কিছু দিয়ে পাঠিয়ে দিলাম। মেয়েটা যাওয়ার সময় বলে, ‘‘বাড়িতে গিয়ে আমি মোটা মোটা ভাত খেতে পারি না। আমার গলা দিয়ে নামে না। তরকারি মজা না।’’ কথাগুলো আকার-ইঙ্গিতে বলেছিল। মেয়েটা চলে গেল। মেয়েটার জন্য মন কাঁদে। ফোন দিই। ফোন ধরে না। অনেক দিন পর যোগাযোগ হলে বলি, ‘‘মিথিলাকে দাও।’’ হ্যাঁ, মেয়েটির নাম মিথিলা। বলে, ‘‘মিথিলা বেড়াতে গিয়েছে।’’ পরে শুনতে পেলাম ওকে আর এক বাসায় দিয়েছে। খুব কষ্ট হল। ভয়ও হল, মেয়েটা ঠিক থাকবে তো? লোভী বাবা-মা। মেয়েটা কষ্ট পাক, তাতে কী? মেয়ের কষ্টের চেয়ে ওদের টাকার প্রয়োজন অনেক বেশি। আমাকে সত্যি কথা বলত, আমি আরও বেতন বাড়িয়ে রেখে দিতাম । মেয়েটা নিরাপদে থাকত। ওদের সঙ্গে আর যোগাযোগ নেই।
বছর খানিক পরে হঠাৎ আমার কাছে মিথিলার বাবার ফোন।
‘‘আপা, কেমন আছেন?’’
‘‘ভাল আছি।’’
অনেক ক্ষণ চুপ থেকে বলে, ‘‘আপা, মিথিলাকে রাখবেন?’’ আমি তো কখনও বলিনি, আমি রাখব না। তোমরা দাও না। তোমরা নিয়ে গেছ। আমার তো করার কিছু নেই।’’
বলে, ‘‘মিথিলাকে ওখানে রাখব না।’’
আমি জোর দিয়ে কিছু বললাম না। বললাম, ‘‘তোমার ইচ্ছা।’’ কয়েক দিন পরে আবার ফোন। ‘‘আপা, নিয়ে আসব?’’ বললাম, ‘‘নিয়ে আসো।’’ এক দিন সত্যি সত্যি নিয়ে আসল। মিথিলাকে চিনতে আমার কষ্ট হল। একদম শুকিয়ে গিয়েছে। তার চেয়ে বড় কথা হল, ওর চুলগুলি ওখানে গিয়ে কেটে ফেলছে। আমাদের বাসায় ওর চুলগুলি ঘন কালো ও লম্বা হয়েছিল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, চুলগুলি কাটছে কেন? নীচের দিকে তাকিয়ে আস্তে করে বলে, মাথায় নাকি উকুন হইছে। স্বাস্থ্য খারাপ হয়েছে কেন? কিছু বলে না, চুপ করে আছে। ‘‘আপা আপনার কাছ থেকে নিয়ে ভুল করে ফেলছি। আপনার যত দিন ইচ্ছে ওকে রেখে দিন।’’ মনে হল, একজন হারিয়ে যাওয়া প্রিয়জনকে খুঁজে পেলাম। আজ বছর খানিক হয়ে গেল। ও এখন অনেক কাজ পারে । রান্না শিখেছে, সেলাই শিখেছে, ছবি আঁকতে পারে। ল্যাপটপ থেকে দেখে দেখে সুন্দর ছবি আঁকে। স্মার্ট ফোন দিয়ে ছবি তুলতে পারে । বাসায় কখনও ফোন আসলে ও ধরে না। আমার কাছে দিয়ে দেয়। কারণ ও সবগুলো কথা গুছিয়ে বলতে পারবে না। আজ আমি গোসল করছি। এই সময় মেয়ের ফোন । মেয়ের ছবি দেখে বুঝেছে আপু ফোন দিয়েছে। ও ফোন ধরে সুন্দর করে বলছে, ‘‘আপু, মামি গোসল করতেছে।’’ আমার গোসল শেষ। দরজা খুলে শুনতেছি, মিথিলা আর মেয়ে কথা বলতেছে। আমি উৎসুক হয়ে ওর কাছে আসলে হাতের ফোনটা ছুড়ে খাটে রেখে আমার গলা জড়িয়ে ধরে বলে, ‘‘মামি, আমি কথা বলতে পারি আমি কথা বলতে পারি।’’
আমি চোখের পানি আটকিয়ে রাখতে পারলাম না।
একুশ মানে ভাষার মাস। একুশ মানে নিজের মত কথা বলার মাস। ‘‘মোদের গরব,মোদের আশা,
আ-মরি বাংলা ভাষা
তোমার কোলে তোমার বোলে
কতই শান্তি ভালবাসা।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy