Advertisement
০৪ নভেম্বর ২০২৪

বাড়িভর্তি বই

ছোটবেলা থেকেই বাড়িতে বইদের দাপুটে বসবাস। বাবার (মণীশ ঘটক) নিজস্ব সংগ্রহে অন্যান্য বইয়ের সঙ্গে কিছু ইংরেজি বইও থাকত। শৈশবে সে সব বই অত উলটে পালটে দেখিনি। তবে বাঁধানো ‘পরিচয়’ ত্রৈমাসিক কাগজের দিকে যথেষ্ট মনোযোগ ছিল। সে-ও সব সময় হাতে পেতাম না। বাবা-মায়ের বই সংগ্রহের ব্যাপারটা চিরকালই ছিল। কত বই আসত পোস্টে। আমাদের বাড়ির যত সুখের বিষয়, যেমন জন্মদিন, কোনও উৎসবের দিন, পূজা, নববর্ষের দিন— এই সব বিশেষ বিশেষ দিনগুলোর প্রধান উপহারই ছিল বই। পুজোয় জামার থেকেও বেশি হত বই।

মহাশ্বেতা দেবী
শেষ আপডেট: ১৫ এপ্রিল ২০১৪ ০৩:০২
Share: Save:

ছোটবেলা থেকেই বাড়িতে বইদের দাপুটে বসবাস। বাবার (মণীশ ঘটক) নিজস্ব সংগ্রহে অন্যান্য বইয়ের সঙ্গে কিছু ইংরেজি বইও থাকত। শৈশবে সে সব বই অত উলটে পালটে দেখিনি। তবে বাঁধানো ‘পরিচয়’ ত্রৈমাসিক কাগজের দিকে যথেষ্ট মনোযোগ ছিল। সে-ও সব সময় হাতে পেতাম না।

বাবা-মায়ের বই সংগ্রহের ব্যাপারটা চিরকালই ছিল। কত বই আসত পোস্টে। আমাদের বাড়ির যত সুখের বিষয়, যেমন জন্মদিন, কোনও উৎসবের দিন, পূজা, নববর্ষের দিন— এই সব বিশেষ বিশেষ দিনগুলোর প্রধান উপহারই ছিল বই। পুজোয় জামার থেকেও বেশি হত বই। এত বইয়ের মধ্যেও, আমার বাবার আবার কিছু বই নিয়ে খুব বাছাবাছি ছিল। বই উপহার দিয়ে বলতেন, পড়লাম আর ফুরিয়ে গেল, তেমন এ বই নয়। বার বার পড়ি, তার পর ধীরে ধীরে বইদের সঙ্গে ভাব হবে, বন্ধুত্ব হবে— এ সব বই হচ্ছে সেই রকম।

আমার বাবা লিখতেন কবিতা। ছদ্মনাম নিয়েছিলেন যুবনাশ্ব। ওই নামেই কবিতাসংগ্রহ বেরিয়েছিল। সে বইও থাকত বাড়িতে। আর সবর্দাই বই কিনতেন। আর সেই সব সংগ্রহের মধ্যে অনেক সারপ্রাইজ থাকত। তিনি সব সময়ই নতুন নতুন বই এনে অবাক করে দিতেন। তবে, ওই যে, বই নিয়ে বাছবিচার ছিল খুব। সব বই একখানে, আর কিছু বিশেষ বই থাকত একটা বিশেষ আলমারিতে। সেই আলমারিতে হাত দেওয়া বারণ ছিল। আমিও অনুমতি পেয়েছি অনেক পরে। কল্লোল যুগের অন্য যে সাহিত্যিকরা বাবার বন্ধু ছিলেন, তাঁরা বই নিতেন ঠিকই, তবে যথাসময়ে ফেরতও দিয়ে যেতেন।

মনে পড়ে রাজশাহি শহরের কথা। পুরনো দিনের একতলা বাড়িটার সর্বত্র বইই বিরাজ করত। আমার ঠাকুরদার বইয়ের সংগ্রহ ছিল যথেষ্ট ঋদ্ধ। তবে গ্রামের বাড়িতে অত বই দেখিনি। এ দিকে ঠাকুরদার বই থাকলে, ও দিকে ছিল মাতামহীর বাংলা বইয়ের অতি সমৃদ্ধ সংগ্রহ। এ হল ঢাকা শহরের কথা। আমার দিদিমা, কিরণময়ী দেবীর কয়েক হাজার বাংলা বই ছিল। তবে, তখন আমি কোন বয়সের জানি না, আমি পড়ব বলে বাবাও বাংলা বইয়ের একটা চমৎকার সংগ্রহ গড়ে তুলেছিলেন। কিন্তু দিদিমার সংগ্রহ করা অত বই কোথায় যে গেল তা জানি না। সেই আলমারিগুলির চেহারা মনে ধরা আছে।

দিদিমার কাছে এক রকম বই, আর মামার কাছে আর এক রকম। বড়মামা শচীন চৌধুরী ছিলেন বিখ্যাত ‘ইকনমিক অ্যান্ড পলিটিকাল উইকলি’-র প্রতিষ্ঠাতা। ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে অর্থনীতিতে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হয়েছিলেন। তাঁর কাছে থাকত তাবড় তাবড় অর্থনীতির বই।

আমার বিয়ের পরে যে বাড়িতে এলাম, সেখানেও বই ছিল। তবে, তা যে অনেক বই, সে কথা বলতে পারি না। সেগুলো মোটামুটি ব্যক্তিগতসংগ্রহই। আমার ওই বাড়ি তো বড় ছিল না। বই নিয়ে গিয়েছিলাম বেছে বেছে। সংখ্যায় অনেক ছিল না। সেগুলো রাখার জন্য দুটো আলমারি বানানো হল। বাকি বইরা থাকত সব ঘরে, সবখানে। বিছানায়, চেয়ারে, টেবিলে। ভাবখানা ছিল, আমরা থাকি যেমন তেমন, বইয়ের জায়গা যেন হয়। তার পর তো বাসা বদলও করেছি। বালিগঞ্জ স্টেশনের কাছ থেকে গেলাম গল্ফ গার্ডেন, সেখান থেকে গেলাম রাজডাঙা। আমাদের সময় তো আর ‘মুভার্স অ্যান্ড প্যাকাসর্’ ছিল না। নিজেরাই বন্দোবস্ত করে কী ভাবে যে বইগুলোকে স্থানান্তরিত করেছিলাম! যত দূর মনে হয়, একটিকেও খোয়া যেতে দিইনি। আগে বই আসুক, তার পর অন্য কিছু।

বাড়ির বই প্রসঙ্গে অতুলবাবুর কথা না বললেই নয়। অতুলচন্দ্র গুপ্ত ভারী মননশীল মানুষ ছিলেন। পণ্ডিত লোক, মস্ত উকিল। বাংলা সাহিত্যে তাঁর অসাধারণ দখল ছিল। এই অতুলবাবুর নিজেদের বিশাল বাড়ি ছিল। সারা বছর যা বই কিনতেন, তা রাখবার জন্য প্রতি বার পুজোয় একটা-দুটো করে অতিরিক্ত আলমারি বানাতেন। আমি দেখেছি অতুলবাবুর পৌত্র ড. প্রতুল গুপ্তকে। প্রতুল গুপ্তের বাড়িও ছিল আলমারিতে ভর্তি।

বাংলা ছাড়া অন্য ভাষার নানা বই আছে আমার কাছে। সংখ্যায় কম হলেও মরাঠি বই আছে বেশ কিছু। সাহিত্যের থেকেও আমার ইতিহাস, নৃতত্ত্ব সংক্রান্ত বই পড়ার শখ বেশি। অরুন্ধতী রায়, বীণা দাসের লেখা সমাজতত্ত্ব ও নৃতত্ত্বের বই রেখেছি। ইতিহাসের তো যুগ ধরে ধরে বই আছে আমার কাছে। মধ্যযুগের ইতিহাস, বাংলার ইতিহাস, মুর্শিদাবাদের ইতিহাস— এই সব। ওই জন্যই বোধহয় আমার থেকে লোকে বই চাইতে আসত কম। এমন বই পড়ার আগ্রহ থাকে না সকলের।

অন্য ভাষার বই পড়ে আমি লাভবান হয়েছি। মরাঠা ইতিহাস সংক্রান্ত বই, একটা হিন্দি নাটিকা থেকে সংগ্রহ করেছি আমার ‘ঝাঁসীর রাণী’ বইটার জন্য নানা তথ্য। কেমন দেখতে ছিলেন রানিসাহেবা, কেমন করে যুদ্ধযাত্রার প্রস্তুতি নিলেন, সে সব পড়েছিলাম। কিছু উদ্ধৃতি নিয়েছিলাম চলতি লোকবিশ্বাস থেকে। গ্বালিয়র পার্কে রানির মূর্তির গায়ে লেখা ছিল সে কথা— রানি কাঠ ছুঁলেন, তা তরোয়াল হয়ে গেল। পাহাড় স্পর্শ করলেন, ঘোড়া হয়ে গেল। পাথর-মাটি থেকে এল তাঁর ফৌজ।

আমি ঘুরে বেড়াতাম জিম করবেটের বই নিয়ে। এত প্রিয় ছিল আমার। কী রচনাশৈলী! ‘ম্যানইটিং লেপার্ড অব রুদ্রপ্রয়াগ’ পড়ে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম একেবারে। আমার জঙ্গলপ্রীতি, অরণ্যের প্রতি ভালবাসা তখনই হৃদয়ে বসত করে থাকবে। যা পরে ঘুরেফিরে এসেছে ‘অরণ্যের অধিকার’ প্রভৃতি নানা লেখায়। জঙ্গল নিয়ে যাঁরা লেখালেখি করেছেন তাঁরা সকলেই আমার খুব প্রিয়।

আমার বইয়ের সম্ভার আমি যতটা পেরেছি রক্ষা করেছি। এখনও তিন ভলিউম মিশেল ফুকো, মার্কস, মাও জে দং সমগ্র আছে। গাঁধী, বিবেকানন্দ ও রবীন্দ্র রচনাবলি আছে। জাতকসমগ্র, শিবরাম, শঙ্খ ঘোষের সব লেখা আছে। রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণ আছে। ভারত সহ বিভিন্ন দেশের আদিবাসী জনজীবনের ইতিহাস ও তাদের লোককাহিনি, বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের অনেক বই আছে। লাতিন আমেরিকা, আফ্রিকা, মধ্য ও পশ্চিম এশিয়া, রাশিয়া, ফ্রান্স, জার্মানির লেখকদের বই আছে। ব্রেশ্ট, আলেহো কার্পেন্তিয়ের, মার্কেস, হুয়ান রুলফো, পামুক-এর সমগ্র আছে। আর বোঝাই করা আছে ‘বর্তিকা’ সহ অন্যান্য লিট্ল ম্যাগাজিন। সব মিলিয়ে আজ প্রায় সাড়ে তিন-চার হাজার বই আছে আমার কাছে।

অন্য বিষয়গুলি:

bangali mahasweta devi
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE