ছবি: কৌশিক সরকার।
তুম হে যো ম্যায়নে দেখা
তুম হে যো ম্যায়নে সোচা....
তুম হে যো ম্যায়নে জানা....
যো হোঁশ থা ওহ তো গয়া...
বিশাল লনের ওপর দিয়ে হলুদ শাড়ির আঁচল উড়িয়ে হেঁটে আসা কেমিস্ট্রি টিচারকে দেখে এমন গানই তো গেয়ে উঠেছিলেন ‘ম্যায় হুঁ না’ ছবির নায়ক শাহরুখ খান।
কিন্তু যে পরিচালক বাংলা সিনেমার গান শোনার আনন্দ আবার ফিরিয়ে এনেছেন সেই সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের পরের ছবি ‘নির্বাক’য়ে কোনও গান নেই। যদিও নায়িকা সুস্মিতা সেন। গান ছাড়া সৃজিতের ছবি?
আশ্চর্য সমাপতন এটাও সৃজিতের অভিনয় মানেও গান। যেমন অঞ্জন দত্তের ‘দত্ত ভার্সেস দত্ত’ ছবিতে তিনি একজন কান্ট্রিমিউজিক প্রেমী। তাঁরই হাত ধরে নায়ক চেনে সমকালের গানকে। ‘শব্দ’ ছবিতে সাউন্ড রেকর্ডিস্ট। এ ভাবেই গানের সূত্র ধরে সৃজিতের যাত্রা সেই ছোটবেলা থেকেই।
তাও সুস্মিতা সেনকে নিয়ে ছবি। আর সেখানে গান নেই।
সবার ওপর সঙ্গীত সত্য
সৃজিত বলছেন, “আমি যে এই মহূর্তে আপনার সঙ্গে কথা বলছি তখনও মগজের মধ্যে গান গুনগুন করছে। এই মুহূর্তে মগজ গাইছে ‘বহে নিরন্তর অনন্ত ধারা’। মনে হয় সবার ওপর সঙ্গীত সত্য তাহার ওপর নাই। আমার মধ্যে একই সঙ্গে জেগে ওঠে এক জন ধৃতরাষ্ট্র আর এক জন সঞ্জয়। সঞ্জয় যখন ধৃতরাষ্ট্রকে ‘নির্বাক’ ছবির গল্পটা বলছিল, তখন কোনও গান আসেনি। তাই গান নেই। সুস্মিতা সেন আমার অন্য ছবির গানগুলো শুনে প্রশংসাই করেছেন। কিন্তু ‘নির্বাক’ গান থাকবে না বলে তিনি আশাহত হয়েছেন এমন নয়।”
আসল কথা হল যে সৃজিতের ছবির গান ‘আমাকে আমার মতো থাকতে দাও’ প্রায় প্রবচন হয়ে ওঠে, যে সৃজিতের ছবির গান ‘ চল রাস্তায় সাজি ট্রাম লাইন’ হয়ে ওঠে ভ্যালেনটাইন্স ডে স্পেশাল।
জোয়ান বেজ আর বেগম আখতার
স্বয়ং উত্তমকুমার যে পাড়ায় বাস করতেন সেই ভবানীপুরের রসিক সমাজেই কেটেছে সৃজিতের শৈশব। যেখানে সারা বছর জুড়ে ছিল নানা জলসা, বিচিত্রানুষ্ঠান। সৃজিতের বাড়িতেও বসত গানের বৈঠকী আসর। পেশায় ডাক্তার মা ছিলেন কল্যাণী রায়ের কাছে সেতারের ছাত্রী। আর আর্কিক্টের অধ্যাপক বাবার কাছে গান ছিল জীবনেরই সমার্থক। “সেই ছোটবেলা থেকে শুনছি মাথায় স্ট্র হ্যাট পরা জোয়ান বেজের গান ‘ডায়মন্ড অ্যান্ড রাস্ট।’ একদিকে বড়ে গুলাম আলি, বেগম আখতার, অন্য দিকে চলছে ‘ইজাজত’- ‘অনুভব’য়ের গান’। এসে পড়লেন সুমন চট্টোপাধ্যায় তাঁর ‘তোমাকে চাই’ নিয়ে। ক্যাসেটটা শুনতে শুনতে স্পুল ছিঁড়ে গিয়েছিল।” বাড়িতে অতিথি এলে সৃজিতকে ছেলেবেলায় গান গাইতে বলা হত। সৃজিত হবহু সুর মিলিয়ে গেয়ে দিতেন ‘রাণার’ গানটা।
বড় পিসিমনির কোলে বসে গান
গানে ভরা শৈশবের আর এক মধ্যমণি ছিলেন আরতি মুখোপাধ্যায়। সৃজিতের বড় পিসিমনি । “বড় পিসিমনির কোলে বসে ওঁর গান শুনতাম ‘এক বৈশাখে দেখা হল দু’জনায়’, ‘আমি মিস ক্যালকাটা’, ‘তখন ‘তোমার একুশ বছর বয়স।’ আমাদের বাড়িতে বড় পিসিমনি এলে গানের আসর বসে যেত।’’ মগজের পরে এল হৃদয়। “‘হয়তো তোমারই জন্য হয়েছি প্রেমেরই বন্য’ শুনে বুঝলাম প্রেমেও যে বন্য হওয়া যায়। কত প্রেম জীবনে শুরু হয়েছে গান দিয়ে। গানেই শেষ হয়ে গিয়েছে,” বলছেন সৃজিত।
গানের এই যাত্রারই ভিন্ন ব্যাঞ্জনা তাঁর জীবনে ‘জাতিস্মর’ ছবি। অষ্টাদশ শতাব্দীর গান নিয়ে গবেষণা করে প্রত্যেকটি গানই বাছাই করেছিলেন তিনি নিজে। কিন্তু এই বিন্যাসের জন্য কোনও পুরস্কার পেলেন না। কবীর সুমন সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে পুরস্কার পেলেন। রূপঙ্কর পেলেন গানের পুরস্কার। একটা স্পেশাল জুরি অ্যাওয়ার্ড তো থাকতে পারত সৃজিতের জন্য? হেসে উঠে সৃজিত বললেন, “ঠিক আছে। আমার চলচ্চিত্র-সঙ্গীত যাঁদের সান্নিধ্য পেয়েছে তাঁদেই পুরস্কারেই আমি পুরস্কৃত। অনেক বড় বড় সঙ্গীত শিল্পীর সান্নিধ্য পেলাম এই ক’বছরে। দেখলাম যিনি যত বড় শিল্পী তিনি তত বিনয়ী। এটাই তো শেখার।”
দোলনায় দুলতে দুলতে
কিন্তু সৃজিতের মতো আধুনিক পরিচালক কী ভাবে পুরতনী গানে ডুবলেন বা মজলেন? সেই যাত্রাও শুরু সৃজিতের দোলনা স্কুলে পড়ার সময় থেকে। সেই স্কুলে ঘণ্টা দেড়েকে প্রার্থনা সভায় গাইতে হত রবীন্দ্রসঙ্গীত, নানা প্রদেশের লোকগান, সেই সঙ্গে ভাওয়াইয়া, মুর্শিদি, বাউল, ভাটিয়ালি, পদাবলী গান তো ছিলই। ছিল রজনীকান্ত-অতুলপ্রসাদের গানও। “আর আমার ভাগ্যটাই এমন সঙ্গীতময়! পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়ের মতো বন্ধু পেয়েছি যে মানুষ হিসেবে দারুণ সাঙ্গীতিক। এত ভাল গিটার বাজাতে পারে, গান গায়যে অভিনয় কিংবা পরিচালনায় না এসে যদি গানটাই মন দিয়ে গাইত তাতেও জনপ্রিয়তা তুঙ্গে উঠত। পেয়েছি কবীর সুমনের মতো অভিভাবক, যিনি আমাকে পুত্রস্নেহে ভালবাসেন। বুম্বাদা (প্রসেনজিত্ চট্টোপাধ্যায়) তো গান পাগল। সিঙ্গাপুরে একটা অনুষ্ঠানে গিয়ে মাঝরাত পর্যন্ত হেমন্তের গান গেয়েছিল একের পর এক।”
শুধু কি তাই? বেঙ্গালুরু ছেড়ে যখন কলকাতায় এলেন ছবি করবেন বলে, যাঁর ছবি ‘ম্যাডলি বাংঙালি’তে প্রথম অ্যাসিস্ট করলেন সেই অঞ্জন দত্তও তো গানের মানুষ। সেই ছবিতে একটি সুফি গানও লিখেছিলেন সৃজিত। কথাগুলো ছিল এই রকম ‘ইয়ে জহান্নাম অউর ইয়ে জন্ন্ত হ্যায় তেরি হি মওলা’। হিন্দি-উর্দুতে পারদর্শী সৃজিত গীতিকার হিসেবেও যে ইচ্ছে করলেই পা বাড়াতে পারেন তার প্রমাণ রয়ে গেছে, ‘লে ছক্কা’ ছবির ‘আলি মওলা’ গানে। তরুণ প্রজন্মের ভাল লেগেছে তাঁর লেখা ‘অটোগ্রাফ’ ছবির গান ‘উঠছে জেগে সকালগুলো/পাশ ফিরে মন আবার শুল’। গীতিকারের এই প্রতিভাও এসেছে পারিবারিক ধারাতেই। বাবা ছিলেন সুধীন দাশগুপ্তের ছাত্র। অনুষ্ঠানে গানও গাইতেন। “কিছুদিন আগে বাবার লেখা, সুর দেওয়া এবং নিজের গাওয়া গানের একটা সিডি বেরিয়েছে, যেটা আমি খুব যত্নে করে রেখে দিয়েছি,” বলছেন সৃজিত। সৃজিতের ছবির গানে মুগ্ধ আরতি মুখোপাধ্যায় বললেন, “আমাদের বাড়িটাই যে গানবাজনার বাড়ি। এই পরিবারের ছেলে যখন ছবি বানাবে সেখানে মিউজিকের একটা আলাদা ওজন তো থাকবেই। সৃজিতের প্রত্যেকটা ছবির গান শুনেছি। খুব ভাল।”
বব ডিলান থেকে অনুপম
বেঙ্গালুরুতে গিয়ে যখন বড় কোম্পানিতে উচ্চপদে চাকরি করছেন তখনই আলাপ হয় গায়ক সপ্তর্ষি আর অনুপম রায়ের সঙ্গে। খুলে ফেলেন একটা ব্যান্ডও। “অনুপমকে বলেছিলাম যদি কোনও দিন ছবি করি তোকে বড় ভাবে ব্যবহার করব। মনে পড়ে ‘অটোগ্রাফ’ হিট করার পর অনুপম কলকাতায় আসার জন্য ব্যগ্র। বলেছিলাম চাকরি ছাড়তে পারিস। কিন্তু ছবির গান গেয়ে বা কম্পোজ করে রুটিরুজি হবে না। ফাংশানে গাইতে হবে। সেই অনুপম এখন স্বয়ংসম্পূর্ণ শিল্পী নিজের জোরেই,” জোরালো গলায় বলেন সৃজিত।
সঙ্গীতের খোঁজ সৃজিতের মজ্জাগত। সেই কারণেই তাঁর সঙ্গে জে এন ইউতে পড়তে গিয়ে দেখা হয়ে যায় পিট সিগার- বব ডিলানের। গানের আড্ডা, গান শোনা জমে ওঠে জিম মরিসন - লিওনার্ড কোহেনের সঙ্গে। খুলে যায় বিশ্বসঙ্গীতের দরজা। কিন্তু গান নিয়ে সব চেয়ে আনন্দের সময় কোনটা? সৃজিত বললেন, “যখন দেখলাম ‘অটোগ্রাফ’য়ের গান শুনে বাঙালি মুগ্ধ হল, তরুণ-তরুণীদের হেডফোনে বাজতে লাগল ‘চল রাস্তায় সাজি ট্রামলাইন’, যখন মিউজিক শপগুলোতে, মাল্টিপ্লেক্সে বাজছে ‘অটোগ্রাফ’য়ের গান, তখন মনে হয়েছিল ‘হৃদয় আজি মোর কেমনে গেল খুলি/ জগত্ আসি সেথা করিছে কোলাকুলি।’”
‘অটোগ্রাফ’, ‘২২শে শ্রাবণ’, ‘হেমলক সোসাইটি’র পর ‘মিশর রহস্য’ ছবিতে গান লেখার পুরো দায়িত্বটাই দিয়েছিলেন শ্রীজাতকে। বললেন, “এ ছবিতে ‘বালির শহর’ গানটা লেখার আগে শ্রীজাতকে ব্রিফ দিয়েছিলাম, একই গানে থাকবে মরুভূমি-সফরের মেজাজ আর প্রেম। ও দুটোই এনেছিল।” বলছিলেন, “‘মিশর রহস্য’র আগে আমি শ্রীজাত, সঙ্গীত পরিচালক ইন্দ্রদীপ দাশগুপ্ত, সবাই মিলে রাত তিনটে চারটে অবধি মিটিং করতাম। ‘২২শে শ্রাবণ’, ‘মিশর রহস্য’য়ে ইন্দ্রদীপ সাঙ্গীতিক ভাবে সিনেমার একটা বড় অংশ হয়ে আছে শুধু ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোরিংয়ের জন্য।”
শ্রেয়া ঘোষালের প্রেমে আছি কবীর সুমনেও
সঙ্গীত নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট সৃজিতের মজ্জায়। সেই জন্যই ‘বালির শহর’ বলে গানটা যেখানে সুনিধি চহ্বাণকে দিয়ে গাওয়ালে যথেষ্ট জনপ্রিয়তা পেতে পারত সে গানটি ঝুঁকি নিয়ে গাইয়েছেন শ্রেয়া ঘোষালকে দিয়ে। শ্রেয়া গানের ভেতর সুনিধি সুলভ লাস্য আরোপ করার ঝুঁকি নিয়েছেন সৃজিতেরই অনুপ্রেরণায়। কেন এই শ্রেয়া প্রীতি? “প্রেমে আছি শ্রেয়ার। এটাই ভাবছেন তো? তাই ভাবুন, হেডিংও করতে পারেন লেখার। ( হাসি) আমি যে কার প্রেমে নেই? কবীর সুমনেরও প্রেমে আছি, ইন্দ্রদীপ দাশগুপ্তরও প্রেমে আছি।” একবার বেঙ্গালুরুতে এই কবীর সুমনকেই আমন্ত্রণ করে সম্বর্ধনা দিয়েছিলেন সৃজিত এবং তাঁর বন্ধুবান্ধবেরা। কবীর সুমনের গাওয়া তেত্রিশটা গান ছন্দে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছিলেন সৃজিত। বললেন, “আমার সাঙ্গীতিক বোধ, জীবনবোধ যা গড়ে উঠেছে তার অনেক খানি জুড়ে আছেন সুমনদা। ওঁকে নিয়ে একটা ছবি করার ইচ্ছে ছিল। ‘জাতিস্মর’ সেই ইচ্ছে পূর্ণ করেছে।”
সৃজিতের আগামী ছবির ‘চতুষ্কোণ’ য়ের সঙ্গীতে কী নতুনত্ব থাকবে? বললেন, “এ বার আমি অনুপমকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে বলেছিলাম দ্যাখ, পুরনো ফেজ থেকে বেরিয়ে এসে অনুপম রায়ের সিগনেচার টিউন যেমন থাকবে তেমনই একদম অন্য ঘরানার আধুনিকতাও চাই গানে। ও সেটা করেছে। মনে হয় অ্যালবামটা শ্রোতাদের ভাল লাগবে। ‘এসে গেছে বসন্ত’, ‘বোবা টানেল’ বলে গান দুটো খুবই ভাল।”
তবে সৃজিতের এর পরের ইচ্ছে হল শান্তনু মৈত্র, প্রীতম, জিত্ গঙ্গোপাধ্যায়কেও ছবির সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে পাওয়ার। তাঁর গাড়িতে বাজে শান্তনু মৈত্রেরই সুরের গান ‘রূপকথারা’, বাজে পরমব্রত-র ‘হাওয়াবদল’ বা বিরসা দাশগুপ্তের ‘জানি দেখা হবে’ ছবির গান।
প্রেমিকাকে মিউজিকাল হতেই হবে
যিনি এত বেশি সঙ্গীতে থাকেন তাঁর প্রেমিকার কি সঙ্গীতজ্ঞ হওয়াটা জরুরি? বললেন, “ না। গান জানতে হবে এর কোনও মানেই নেই। কিন্ত মিউজিকাল হতে হবেই। অসাঙ্গীতিক কোনও মেয়ের সঙ্গে আমার কোনও দিন প্রেম হতে পারে না।” এই মুহূর্তে জীবনের থিম সং কি? আমাকে আমার মতো থাকতে দাও নাকি ‘এ তুমি কেমন তুমি’ নাকি ‘প্রেমে ক্ষান্ত হলেম প্রাণ’?
বেশ খানিকটা সময় নিয়ে ভেবে বললেন, “কোনওটাই নয়।”
তা হলে?
এই মূহূর্তে আমার গান যেটা মগজে চলছে সেটা হল ‘ম্যায় জিন্দেগি কা সাথ নিভাতা চলা গয়া, হর ফিক্র কো ধুয়ে মে উড়া তা চলা গয়া’। ধোঁয়া অবশ্য নেই। সিগারেট ছেড়ে দিয়েছি।
- এটা মগজের গান হলে, হৃদয়ের গান কোনটা?
ওই হৃদয় আর মগজ মিলেই তো গান আমার। কিছুটা বৈজ্ঞানিক, কিছুটা অবৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া। বাট ইটস এ হ্যাপি ম্যারেজ। শুভবিবাহ।
কিন্তু নিজেও তো গায়ক হতে পারতেন?
চেষ্টা করিনি গান শেখার। গানটা তো এমনি এমনিই গাইতে পারতাম। সুরে লয়ে এই দিব্যি আছি। বাকিরা গাইবে আমি শুনব। রসিকেরও তো দরকার আছে। ( হাসি)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy