বসন্ত এসে গেছে। তবে দোলের রং না লাগলে কি বাঙালির হৃদয় চেতনায় বসন্ত জাগ্রত হয়?
ফাগুনের আগুন রঙে যখন প্রকৃতি রঙিন হয়ে ওঠে, ঠিক তখন বাঙালির মনেও লাগে রঙের ছোঁয়া। সে রং আসলে উৎসবে, আনন্দে, আবেগে মেতে ওঠার এক উপলক্ষ মাত্র। সে কাল থেকে এ কাল চলছে কলকাতার দোল-বিলাস। শুধু বদলেছে সময়টা। অতীতের দোল বিলাসের কত না কাহিনি আজ কিংবদন্তী। এক কালে কলকাতার বাবুদের বিলাসিতার আর এক নাম ছিল হোলি খেলা। প্রাচীন কালের মদনোৎসবের সঙ্গে মিল ছিল সেই দোল উৎসবের। ইতিহাসে কান পাতলে শোনা যায় দোলের বিচিত্র গল্পের কথা।
জোব চার্নক ১৬৮৬-তে কলকাতায় এসেছিলেন। কিন্তু, বেশি দিন একটানা এখানে থাকতে পারেননি। পরে, ১৬৯০-এর ঘোর বর্ষায় চার্নক যখন তৃতীয় বার এখানে এলেন, তখন কলকাতা এক গণ্ডগ্রাম। সেখানে না ছিল বাবু, না ছিল অভিজাত সমাজ। প্রাসাদোপম সেই সব বাড়িও ছিল না তখন। তাই নবাগত ইংরেজদের তখন ঠাঁই বলতে কখনও তাঁবু তো কখনও বা নৌকা। বেশ কিছু দিন থাকার পরে জীবনযাত্রায় একঘেয়েমি কাটাতে চার্নক এবং তাঁর সাঙ্গপাঙ্গরা চাইলেন নেটিভদের সঙ্গে মেলামেশা করতে। কিন্তু নেটিভরা সেই সময় তাঁদের পাত্তাও দিতেন না।
৩২৫ বছর আগে এমনই এক বসন্তে, কয়েক জন ফিরিঙ্গি ছোকরা গ্রামের ভেতরে ঘুরতে বেরিয়েছিল। হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ তাঁদের কানে এল গানের সুর। সেই সুর অনুসরণ করে তাঁরা এগোতে এগোতে পৌঁছলেন এক দিঘির পাড়ে। সেখানে তাঁরা যা দেখলেন, তা বিস্ময়কর!
দিঘির দক্ষিণে এবং উত্তরে দু’টি খাড়াই মঞ্চ। তার একটিতে গোবিন্দজি এবং অন্যটিতে শ্রীরাধিকার অধিষ্ঠান। দুই দেব-দেবীকে মাঝে রেখে চলছিল দোল খেলা। যাঁরা দোল খেলছিলেন তাঁদের পোশাকেও ছিল অভিনবত্ব। আবিরে চার দিক লাল। পিচকারিতে তরল রং নিয়ে চলছিল খেলা। কাতারে কাতারে লোক এসেছেন সেই উৎসবে। বসেছিল মেলাও। দিঘির উত্তর পাড়ে অর্থাৎ রাধাবাজারে, স্তূপ করে রাখা ছিল আবির। পথঘাটের সঙ্গে দিঘির জলও লাল হয়ে গিয়েছিল।
গোপিনীদের নৃত্য, উত্তেজক চটকদারি সঙ্গীত আর চারপাশের পরিবেশ সেই ইংরেজ ছোকরাদের প্ররোচিত করে তোলে। এই গোপিনীরা যে আসলে সকলেই পুরুষ তা ভাবতেও পারেননি ওই ফিরিঙ্গি ছোকরারা। প্রাচীন গ্রিসের ‘স্যাটারনালিয়া’র সঙ্গে এই রং-উৎসবের মিল খুঁজে পেয়ে তাঁরা ভেবেছিল বুঝি ‘কামোৎসব’। এর পরে তাঁরাও অংশ নিতে ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করেন। ফলে এক কাণ্ড ঘটে বসল! এটা ফিরিঙ্গিদের বেয়াদপি মনে করে নেটিভরা তাঁদের উৎসবে ঢুকতে বাধা দিলেন। শুধু তাই নয়! তাঁদের পিঠে পড়েছিল চড় থাপ্পড়। বৈদ্যনাথ মুখোপাধ্যায়ের একটি প্রবন্ধে ঘটনাটির উল্লেখ মেলে।
পরে ইংরেজরা এ দেশে আসার পরে ঔপনিবেশিকতার প্রভাবে যে নব্য বাবুসমাজ গড়ে উঠেছিল, হোলি উৎসব তাতে প্রাধান্য পেয়েছিল। আর যে বাবুরা ‘দিনে ঘুমিয়ে, ঘুড়ি উড়িয়ে, বুলবুলির লড়াই দেখে রাতে বারাঙ্গনা দিগের আলয়ে গীতবাদ্য ও আমোদ করিয়া কাল কাটাইত’ তাঁদের হোলি উদযাপনও বিচিত্র ধরনের ছিল। আর জীবনযাত্রায় এই সব ভোগ-বিলাসের লীলাসঙ্গিনী ছিল গণিকাকুল। ভবনীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘নব বাবুবিলাস’-এ এই সব বাবুদের জীবনযাপনের উল্লেখ মেলে।
বাবু-বিলাসের নিধুবন ছিল তাঁদের সখের বাগানবাড়ি। রুপোর রেকাবিতে রাখা আতর মেশানো আবির উড়িয়ে, রুপোর পিচকারির সুগন্ধী রঙিন জল ছিটিয়ে, গেলাসে রঙিন পানীয় ঢেলে, হোলির ঠুমরি কিংবা দাদরার তালে তালে দোস্ত ইয়ারদের নিয়ে মাতাল হয়ে ওঠার আনন্দটা কেমন ছিল তা শুধু বাবুরাই জানতেন!
বাবু কালচারের হোলির বিবরণ দিতে গিয়ে কবি ঈশ্বর গুপ্ত লিখেছিলেন “ক্রমেতে হোলির খেলা, নবীনা নাগরী মেলা, ছুটে মুটে যায় এক ঠাঁই। ...যার ইচ্ছা হয় যারে, আবির কুমকুম মারে, পিচকারি কেহ দেয় কায়। উড়ায় আবীর যত, কুড়ায় লোকেতে কত, জুড়ায় দেখিলে মন তায়। ঢালিয়া গোলাপ জল, অঙ্গ করে সুশীতল, মাঝে মাঝে হয় কোলাহল।”
কলকাতার দোল প্রসঙ্গে ইতিহাসের পাতায় প্রমাণ মেলে যে, ‘সে সময়ে কোনও ব্যক্তির বেদাগ বস্ত্র থাকিত না, দলে দলে মিছিল বাহির হইতেছে, পিচ্কারি ও আবিরে পথঘাট ঘরবাড়ি লালে লাল হইয়া যাইতেছে।’ সে কাল থেকে এ কাল দোলের একটা জিনিস বদলায়নি, সেটা হল আবেগ। ধনী দরিদ্র নির্বিশেষে সকলে হোলির আনন্দে মেতে উঠতেন।
বালথাজার সলভিন্স তাঁর ‘Les Hindoues’ গ্রন্থে দোলযাত্রার একটি ছবির বর্ণনায় সে কালের রং উৎসবের বর্ণনা দিয়েছেন। তিনি উল্লেখ করেছেন যে, হিন্দুদের এই দোল উৎসবে খ্রিস্টান ও মুসলমানেরাও আমোদ-প্রমোদে মেতে উঠতেন। লখনউর নির্বাসিত নবাব ওয়াজেদ আলি শাহ যখন মেটিয়াবুরুজে এলেন, তিনিও তাঁর মিত্র-পারিষদদের নিয়ে হোলি খেলতেন সাড়ম্বরে। এমনকী, হোলি উপলক্ষে রচনা করতেন নতুন গানও।
দোল উপলক্ষে এক কালে কলকাতার বিভিন্ন রাজবাড়িতে বসত বাঈনাচের আসর। এমনই এক আসরে ছিলেন সে কালের বিখ্যাত বাঈজি গহরজান। মেঝেতে পুরু করে আবির বিছিয়ে তার উপর কাপড় ঢেকে সেখানে হয়েছিল নাচ। নাচের শেষে আবিরের উপর থেকে কাপড় সরিয়ে দেখা গেল, সেই আবিরের উপর পদ্মের আকৃতির নকশা হয়ে গিয়েছে। পাথুরিয়াঘাটার রাজবাড়িতে বসত ধ্রুপদী সঙ্গীতের আসর। সেখানে গাইতেন অঘোর চক্রবর্তী, পিয়ারা সাহেব, কিংবা আহমদ খান।
গবেষকদের মতে সাবেক কলকাতার দোল উৎসব প্রাচীন কালের মদনোৎসবের আদলে গড়া। বর্তমানে যাঁরা দোলের সময় রাস্তাঘাটে চটুল পরিবেশের কথা বলে রে-রে করে ওঠেন, তাঁরা শুনলে অবাক হবেন সে কালেও দোলে চটুলতা ছিল। প্রমাণ মেলে ইতিহাসের পাতায়। ‘...মিছিলওয়ালারা সুশ্রাব্য ও অশ্রাব্যগীতিতে পাড়া মাতাইয়া এবং নরনারী যাহাকে সম্মুখে পাইত, তাহাকে আবির ও পিচকারিতে ব্যতিব্যস্ত করিয়া চলিয়া যাইত। এমন অশ্রাব্য গীত এবং কুৎসিত সং প্রকাশ্যে পথে বাহির করিতেন যে, এখনকার লোকে তাহা কল্পনা করিতে পারে না। কর্তারা কিন্তু তাহা লইয়া আমোদ করিতেন। গৃহিনীও বালক-বালিকাদের সহিত শ্রবণ ও দর্শন করিতেন।’
তবে বিলাসিতা কিংবা আমোদ-প্রমোদ যতই হোক না কেন, এই সব বিলাসী বাবুরা ছিলেন সাবেক হিন্দু ধর্মে বিশ্বাসী। তাই দোল উপলক্ষে এই সব বাড়িতে বিশেষ পুজোআচ্চা হত। তৈরি হত বিশেষ মিষ্টি এবং সরবতও। কিছু কিছু পুরনো পরিবারে আজও এই সব রীতি দেখা যায়।
বাবু-বিলাসের দিন ফুরলেও ফুরোয়নি সেই ঐতিহ্যের রং। কালের গরিমায় অনেক কিছু হারালেও বনেদি পরিবারগুলিতে আজও অটুট এবং অক্ষুণ্ণ দোল বিলাসের সেই মেজাজটা। সময়ের স্রোতে বাঙালির দোলযাত্রায় পড়েছে প্রাদেশিকতার ছাপ। তবু তার মাঝেই পুরনো কলকাতার দোল বিলাস স্মৃতির সুরভি নিয়ে অতীত আর বর্তমানের মাঝে একটা রঙিন যোগসূত্র।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy