একজনের বয়স মাত্র ৮৭।
কিন্তু এনার্জিতে যে কোনও কিশোরকেও হার মানিয়ে দেবেন।
অপর জনের মনের বয়স মাত্র আঠারো। কাঠখোট্টা হিসেবের খাতায় যদিও তিনি আজকে পা দিয়েছেন ৮১তে। প্রথম জন মহম্মদ জাহুর খৈয়াম। আর ৮১ বছরের তরুণী আশা ভোঁসলে।
৮১ তম জন্মদিনে তিনি চিরযৌবনা। তবে এ নাগাদ খৈয়ামের শরীর তেমন ভাল যাচ্ছে না। কিন্তু আশার জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানানোর ব্যাপারটা শুনে ফোনে কথা বলতে রাজি হলেন।
একটাই শর্তে। একটু সময় দিতে হবে তাঁকে। “এত বড় মাপের শিল্পীকে নিয়ে কথা বলতে গেলে তো একটু ভেবেচিন্তে বলতে হবে।”
সময়মতো দেড় ঘণ্টা পরে আবার ফোন করা হল। ফোন তুলেই এক নিঃশ্বাসে বলে গেলেন, ‘‘উনি তো সবে ৮১। আমি ৮৭। যত দিন ইচ্ছে, যা যা ইচ্ছে তাই যেন করে যেতে পারেন আশাজি। আমি ভগবানের কাছে এই প্রার্থনাই করি ওঁর জন্য। আপকা যো দিল কহে আপ করতি রহে।”
এক সময় শোনা গিয়েছিল যে প্রথমবার আশার সঙ্গে যখন তাঁর দেখা হয় তিনি নাকি একটা মারাত্মক ভুল করেছিলেন। চিনতেই পারেনননি আশাজিকে! এমনও শোনা যায় যে পরিচারিকা ভেবে আশাকে গুলিয়ে ফেলেছিলেন তিনি! বলেওছিলেন যে ভেতরের ঘরে গিয়ে যেন আসল আশা ভোঁসলেকে ডেকে নিয়ে আসেন!
“কী আর বলব এই নিয়ে? তবে আশাজি এই গল্পটা আরও মজা করে বলতে পারেন। আপনি বরং ওঁর থেকেই সেটা শুনে নেবেন।” গলার স্বরে তাঁর হাসির আভাস।
সে অনেক বছর আগেকার কথা। তবে যেটা বলতে খৈয়ামের একটুও বাধে না তা হল ‘উমরাও জান’য়ে আশাকে দিয়ে গজল গাওয়ানোর তাঁর দুঃসাহসিক প্রচেষ্টা। এ ছবিতে গাওয়ার আগে পর্যন্ত হিন্দি সিনেমার দর্শক আশাকে মূলত ক্যাবারে আর দ্রুত লয়ের গান গাইতেই শুনতে অভ্যস্ত ছিলেন। কিন্তু রেখা-অভিনীত ‘উমরাও জান’ সে সব ধারণা পাল্টে দিল। জন্ম হল গজল গায়িকা আশা ভোঁসলের।
এর আগে ‘পাকিজা’র মতো ছবি মুক্তি পেয়েছে। গুলাম মহম্মদ আর নৌশাদের সুর। সে ছবিতে লতা মঙ্গেশকরের গাওয়া ‘চলতে চলতে ইউ হি কোই মিল গয়া থা’ তখন জনপ্রিয়তার শৃঙ্গে। ‘পাকিজা’ আর ‘উমরাও জান’য়ের পটভূমিকার মধ্যে মিল অনেক। এমন একটা পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে গজলে সুর করা মানে মারাত্মক একটা চ্যালেঞ্জ। আজও সে কথা স্বীকার করেন খৈয়াম। বলেন, “মেরে সামনে ‘পাকিজা’ খাড়ি থি। কিতনি বড়ি হিট থি ওহ ফিল্ম। কামাল অমরোহির মেকিং। মীনাজির অনবদ্য অভিনয়!” তবে কমল অমরোহির ‘পাকিজা’, মীনাকুমারীকে দিয়ে যত বড় হিট হোক না কেন, মুজফফ্র আলির ট্রাম্প কার্ড ছিলেন রেখা।
‘পাকিজা’তে লতা মঙ্গেশকরকে দিয়ে গুলাম মহম্মদ প্রায় সব কটা গজল গাইয়েছিলেন। তা সে ‘ঠরে রহিও’ হোক বা ‘ইনহি লোগো নে’। তা হলে খৈয়ামও একই রাস্তায় হাঁটলেন না কেন? হিট কম্বিনেশন রিপিট করলে রিস্ক নিতে হয় না। এ ছাড়া লতার সঙ্গে খৈয়ামের সম্পর্ক ভাল। হিট গানের সুর দিয়েছিলেন। তবু ‘উমরাও জান’য়ের গজলগুলো লতা গাইলেন না কেন?
“সাঙ্ঘাতিক দোটানার মধ্যে আমি! তখন আমার স্ত্রী জগজিৎ কৌর আমায় এসে বলেন, ‘অত চিন্তা কোরো না। তুমি নিজের রং লাগিয়ে সুর করো’। গায়িকা বাছার সিদ্ধান্তটাও আমাকে জগজিৎ নিতে সাহায্য করেছিল। আজও মনে আছে জগজিৎ বলেছিল, ‘খৈয়াম সাব, রেখাজির গলার সঙ্গে আশাজির গলাটা মানাবে ভাল। আশাজির একটা বেস আওয়াজ আছে। সেটা রেখাজির সঙ্গে বেশ ভাল মিলে যাবে।’ ভেবে দেখলাম যে জগজিৎ ভুল বলেনি। রাজি হয়ে গেলাম। ভাগ্য ভাল যে সেটা শুনে পরিচালক মুজফ্ফর আলি আর তাঁর স্ত্রী সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে যান।”
খবরটা পেয়ে লতা অভিমান করেননি? “না তা কেন হবে? উনি খুব বড় মাপের শিল্পী,” খৈয়ামের স্ত্রী জগজিৎ জানান।
এর পর শুরু হল উমরাও জানকে নিয়ে পড়াশোনা। কী ভাবে উমরাও নিজের তালিম নিয়েছিলেন। গান শেখা থেকে শুরু করে কথকের তালিম। তার সঙ্গে উর্দু কালাম লেখা। “যেমন গুণ, তেমনই রূপ। শুনেছিলাম বাস্তবের উমরাও শ্যামবর্ণা ছিলেন। রেখাও তো তাই। তখনকার দিনে যখন মুজরা হত লোক এসে গান শুনে খুশি হয়ে টাকা ছুড়ে দিতেন। কিন্তু উমরাও ছিলেন একমাত্র ব্যতিক্রম। শুনেছিলাম ওঁর জন্য থলিতে করে আশরফিয়া অর্থাৎ সোনার মুদ্রা দেওয়া হত। কত মূল্যের মুদ্রা দেওয়া হত তা ঈশ্বরই জানেন। এই রকম সম্মানের হকদার ছিলেন উমরাও... ইতিহাস থেকে তা জেনেছি। পরিচিত হয়েছি উমরাওয়ের অনুভূতিগুলোর সঙ্গেও...”
রেকর্ডিংয়ের আগে সে অনুভূতির সঙ্গে আশাকেও পরিচয় করাতে হয়েছিল। সেটা নিয়ে সমস্যা ছিল না। সমস্যা হয়েছিল কোন নোটে গজলগুলো গাওয়া হবে তা নিয়ে! “সিচুয়েশন এমন জায়গায় চলে গিয়েছিল যে এক সময় মনে হয়েছিল আশাজি হয়তো গানগুলো গাইবেনও না!” বলেন খৈয়াম।
কিন্তু কেন এমন ঝামেলা?
যে গজল (‘দিল চিজ কেয়া হ্যায়’)-এর জন্য আশার প্রথম জাতীয় পুরস্কার, তা গাওয়া নিয়ে এত কীসের দ্বিধা?
গজলগুলো সুর করার পর খৈয়াম ঠিক করেছিলেন যেহেতু আশাকে দিয়ে একদম নতুন আন্দাজে গাওয়াবেন, তাই আরও কিছু পরীক্ষানিরীক্ষা করবেন। যে নোটে আশা সাধারণত গেয়ে থাকেন, তার থেকে দেড় নোট নীচে করে গাওয়াতে চেয়েছিলেন এই ছবির জন্য।
সেই মতোই রিহার্সাল করা হয়। তবে রিহার্সাল দ্বন্দ্ব থেকেই গিয়েছিল আশার মনে। “জগজিৎ আমাকে এসে সেটা বলে। তখন আমি গিয়ে আশার সঙ্গে কথা বলি। উনি বলেন: ‘রিহার্সালের সময় তো আমি ঠিকই গেয়েছিলাম। তবে এখন মনে হচ্ছে যে নোটে আপনি গাইতে বলছেন, সে নোটে আমি গাইতে পারব না। সুর খুব নীচে হয়ে যাচ্ছে। আমাকে ছেড়ে দিন। এটা ঠিক হচ্ছে না...’”
স্টুডিয়োতে তখন একদম থমথমে পরিবেশ। আশ্বাস দিয়ে খৈয়াম বলেন যে চিন্তার কোনও কারণ নেই। সারা দিন স্টুডিয়োর বুকিং রয়েছে। মিউজিশিয়ানদেরও বুকিংও রয়েছে সারাদিনের জন্য। সময় বেশি লাগা নিয়ে চিন্তা করার প্রয়োজন নেই। তবে হাল ছাড়া যাবে না। “দু-তিনটে রেকর্ডিংয়ের পর ওকে টেক বলেছিলাম। তবে আজও মনে আছে রেকর্ডিংয়ের ওই কাচের ঘরে আশাজির সেই মুখ... মিউজিশিয়ানরা তৈরি... শুরুর মিউজিক বেজে ওঠে... আশাজির চোখ তখন বন্ধ। মনে হল যেন একটা ঘোরের মধ্যে চলে গিয়েছেন। চুপচাপ শুনছেন। কেউ টুঁ শব্দ করছেন না। বুঝতে পারছিলাম না উনি টেক-টা অ্যাকসেপ্ট করবেন না রিজেক্ট করে দেবেন!”
দেড় মিনিট কারও মুখে রা নেই। তার পর রেকর্ডিং রুমের বেল বেজে ওঠে। ঘোর থেকে বেরিয়ে আসেন আশা। চোখ খুলে প্রশ্ন করেন: ‘খৈয়াম সাব, কেয়া ইয়ে ম্যয় গা রহি থি? ম্যয়নে তো আপনি আওয়াজ কভি অ্যায়সি নহি শুনি’।
জাতীয় পুরস্কারের সম্মান আসতে তখন অনেক দেরি। তবে কোনও সুরকারের কাছে যে এটা বিরাট এক প্রাপ্তি তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
পরে বড় পর্দায় ছবিটা দেখে মনে হয়েছিল উমরাওয়ের চরিত্রে যেন জিয়নকাঠি ছুঁয়ে দিয়েছিলেন রেখা। “আশাজির গলা তো নয়, এ যেন উমরাওয়ের নিজের আওয়াজ শুনতে পেয়েছিলাম ছবিতে। আর রেখাজি যে ভাবে চরিত্রটা অভিনয় করেছিলেন... আজও দেখলে মনে হয় যেন উমরাও আর রেখাজি মিলে মিশে একাকার হয়ে গিয়েছেন। উসমে রু আ গয়ি থি...।”
পর্দায় তাই রেখার লিপে আশার গাওয়া ‘ইন আঁখো কে মস্তিকে/ মাস্তানে হাজারো হ্যায়....’ শুনে আজও অনেকেই মনে মনে ভাবেন ‘ইস আওয়াজ কি মস্তিকে/ মস্তানে হাজারো হ্যায়....’
সেই থেকেই আশার কেরিয়ারে এক অন্য দিশা খুলে যায়। শুধু মাত্র দ্রুত লয়ের গায়িকা হিসেবে নয়, শ্রোতারা আশাকেও পুরোদস্তুর এক ভার্সেটাইল গায়িকা হিসেবে মানতে শুরু করেন। খৈয়াম অবশ্য নিজে ক্রেডিট না নিয়ে বরং বলেন,“গর্ব হয় যে আশাজির আওয়াজ আমার কম্পোজিশনের জন্য ব্যবহার করতে পেরেছিলাম। বলতে দ্বিধা নেই যে আমার সাফল্যের পেছনে আশাজির একটা বিশাল বড় হাত রয়েছে।” এর পরে ‘আশা অউর খৈয়াম’ বলে একটা গজলের অ্যালবামও করেছিলেন দু’জনে।
আশাকে গজল গাওয়ানোর পেছনে খৈয়ামের অবদান অনেকে জানলেও খুব কম মানুষই জানেন যে গায়িকার প্রথম ক্যাবারে গানটির সুরকারও ছিলেন এই খৈয়াম। ১৯৫৩র ছবি। নাম ‘ফুটপাথ’। গানের নাম ‘আর রা রা রাম’। এখনও ইউটিউবে গেলে সে গানের লিঙ্ক পাওয়া যাবে। অদ্ভুত লাগে না এটা ভেবে যে সারাটা জীবন ওপি নায়ার ও আর ডি বর্মনকেই আশা ভোঁসলের ক্যাবারে গানের সুর করার সব ক্রেডিট দেওয়া হয়ে এসেছে? “কী আর বলব এই নিয়ে? আসলে আমরা তো কবিতা বা গজলই বেশি পছন্দ করে এসেছি। তাই ওই সৃষ্টিগুলোই কালজয়ী হয়ে থেকেছে...”
শুধু ক্যাবারে নয়। হিন্দি চলচ্চিত্রে মহিলার গলায় গাওয়া প্রথম ভাংড়া গানটির সুর করেছিলেন খৈয়াম। গেয়েছিলেন আশা। “‘১৯৪৮’য়ে সেই গান রেকর্ড করেছিলাম। ‘শহরো মে শহর সুনা থা। শহর থা মুলতান।’”
‘উমরাও জান’য়ের পরেও আবার মুজফ্ফর আলির সঙ্গে কাজ করেছিলেন খৈয়াম। ছবির নাম ছিল ‘জুনি’। “কী ভাল গান রেকর্ড হয়েছিল। কিন্তু সেই ছবি শেলভড! কোনও দিন গানগুলো বেরোলে ভাল লাগবে। তবে প্রকাশ করার উদ্যোগ খৈয়াম সাব নিতে পারবেন না। কিছু দিন আগে মুজফ্ফর এসেছিলেন। বলেছিলেন দু’মাসের মধ্যে ছ’টা গান সুর করে দিতে। রাজি হননি। বলেছিলেন যাঁরা তাড়াতাড়ি গানের সুর করতে পারেন তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে,” জগজিতের মুখে শোনা। আর আশা? তাঁর সঙ্গে দেখা হয়? “হ্যা।ঁ বাড়িতে আসে। আজকাল সিনেমাতে সেই রকম গজল হয় না। তবে আমাদের ভাল-মন্দ খোঁজ নেয়।”
দু’ বছর আগে যখন খৈয়ামের ছেলে মারা যান সে দিনও আশা এসে সারাটা দিন কাটিয়ে গিয়েছিলেন শোকসন্তপ্ত পরিবারের সঙ্গে। “সন্তানশোক যে কী তা বলে বোঝানো যাবে না। আশাজিও এই বয়সে এসে সন্তান হারানোর দুঃখটা পেয়েছেন...”
মন ভারাক্রান্ত হয়ে আসে। মুখে বলেন বার্ধক্য আর অসুস্থতার জন্য আর বেশি কথা বাড়াতে চান না। ফোন রাখার আগে শুধু বলেন, “আজ আশাজির জন্মদিন। ওঁর জন্য রইল আমাদের শুভেচ্ছা। ওঁর বিশ্বজোড়া খ্যাতির পরেও বলছি, নিজের মতো করে বাঁচুন। ভাল থাকবেন, আশাজি।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy