প্রায়শই সাহিত্য তাদের নিয়ে রচিত হয় যারা সাহিত্যের সঙ্গে কোনও সম্পর্ক রাখে না। চর্চার ক্ষেত্রে তারা বহু দূর দ্বীপের বাসিন্দা। অথচ তারাই অজ্ঞাতসারে সাহিত্যকে পাঠযোগ্য জীবন দান করে চলেছে বহু যুগ ধরে।
এই কথাটা আগেও মনে হয়েছে। আবার মনে হল প্রথিতযশা সাহিত্যিক সমরেশ মজুমদারের উপন্যাস অবলম্বনে তৈরি অনিরুদ্ধ রায় চৌধুরীর ছবি ‘বুনো হাঁস’ দেখে। ছবি দেখে বেরোনোর সময় ‘এক্সিট’য়ের বাঁ হাতের এক আলো আঁধারি কোনায় দেখলাম ঝাঁকড়া চুল, শ্যামবর্ণ, হাতে একসঙ্গে অনেকগুলো রিস্টব্যান্ড (যেগুলো সাধারণত হংকং-ব্যাংককে পাওয়া যায়) পরা এক যুবকের টি শার্টের বুকটা খামচে ধরে মাথা নাড়ছে এক ঝকমক পোশাক পরা কিন্তু দীপ্তিহীন চেহারার যুবতী। দেখা মাত্র মনে হল ছেলেটা খিদিরপুরের দিকে কোথাও থাকে। ‘ক্যারিয়ার’। ‘বুনো হাঁস’ যেখানে শেষ হচ্ছে ঠিক সেখান থেকেই শুরু হচ্ছে সামনের দৃশ্যটা। ছবির এক অশেষ ‘ট্রেল’। হংকং, ব্যাংকক, যাঁরা গিয়েছেন তাঁরা জানেন রাতে আমাদের এয়ারপোর্ট থেকে ‘সুবর্ণভূমি’‘হংকং ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট’য়ের উদ্দেশ্যে প্লেন ধরার জন্য এক শ্রেণির যাত্রীদের কী ধস্তাধস্তিই না চলতে থাকে। এ দেশ থেকে ও দেশ, ও দেশ থেকে এ দেশ হইহল্লা করতে করতে, খিস্তি-খেউড় করতে করতে, কাড়ি কাড়ি সেলোটেপ আঁটা পেটিকালাগেজ হিসেবে চেক ইন করিয়ে যারা যায় আর আসে, আসে আর যায় সেই ক্যারিয়ারদের চেহারাগুলো ঠিক রবিনের মতো। বা ওই সামনে দাঁড়ানো যুবকটির মতো। হয়তো যুবকটি শুনেছে ক্যারিয়ারদের নিয়ে তৈরি হয়েছে একটা সিনেমা। তাই প্রেমিকাকে নিয়ে দেখতে এসেছে। সিনেমা দেখে বেরিয়ে হয়তো মেয়েটি আতঙ্কিত হয়ে অনুরোধ করছে ‘এই পেশা ছেড়ে দাও।’ বলা বাহুল্য, সাহিত্য যেখানে পৌঁছতে অক্ষম সিনেমা সেই উপেক্ষাগুলোকে সাপটে টেনে নেয় নিজের ভেতর।
নিখুঁত লিভিং রুমের সেটের মধ্যে মধ্যবিত্ত আর উচ্চ মধ্যবিত্তের জীবনের সূক্ষ্ম টানাপড়েন, নায়িকার অশ্রুত একটি বাক্য, চোখের পলক পড়ার প্রোলঙ্গড শট আর ফোনেই হয়ে যাওয়া অর্ধেক ভাববিনিময় নিয়ে তৈরি ছবি বাঙালি দর্শককে একেবারে ক্লান্ত করে তুলেছিল। কিন্তু চতুর্থ ছবিতে নিজের সিনেমাভাষার খোলনলচে বদলে ফেলে পুরনো স্টাইল নিজেই বর্জন করে অনিরুদ্ধ রায় চৌধুরী ফিরে এলেন একটা রক্তমাংসের ছবি নিয়ে। যে ট্রেন্ডটা চলছিল তাতে, সিনেমা ফ্লোর্রে যাওয়ার আগেই নায়িকার পোশাক আর লুক নিয়ে তিন পাতার ইন্টারভিউ পড়ার পরে হলে বসে পরিচালককে একটি আঁতেল মূষিক প্রসব করতে দেখাটা দর্শকের অভ্যেসে পরিণত হয়েছিল।
এই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে দর্শকের চোখে ‘বুনো হাঁস’ সামগ্রিক ভাবে অভিনয়, পরিচালনা, ক্যামেরা, এডিটিং সব দিক থেকেই একটা ভাল ছবি হিসেবে বিবেচিত হওয়াটাই স্বাভাবিক। ‘বুনো হাঁস’য়ে সেই প্রকরণ রয়েছে। রক্ত, ঘাম রয়েছে। হাওয়াই চটির উচ্চাশা রয়েছে। সেই ক্যারিয়ারদের গন্ধকের মতো ঝাঁঝালো উপস্থিতি রয়েছে, যাদের ব্যাংকক এয়ারপোর্টে দেখে ভয় হয় এখুনি অনুরোধ আসবে, ‘ম্যাডাম, এই ব্যাগটা একটুু ক্যারি করে দিন না! আপনার তো হাতে তেমন লাগেজ নেই।’ থাই এয়ারলাইন্সে একবার আমার পাশে বসেছিলেন যে মারকাটারি সুন্দরী পঞ্জাবি মহিলা, অঙ্গুলিহেলনে নিয়ন্ত্রণ করছিলেন তিরিশ জন ক্যারিয়ার ছেলেকে, আর যার বিশাল টিফিন কেরিয়ার থেকে প্রসাদ পাওয়ার জন্য হুড়োহুড়ি পড়ে গেল এমন যে মনে হল প্লেনের ভেতরেই উঠে এসেছে গোটা খিদিরপুর ফ্যান্সি মার্কেটসেই পঞ্জাবনকেই তো দেখে এলাম মুনমুন সেনের মধ্যে। এই প্রসঙ্গে বলে নেওয়া যাক মুনমুন সেনের উপস্থিতি এবং অভিনয় ম্যাডাম চরিত্রটিকে অন্য মাত্রা দেয়। দর্শকের মনে যে ঔৎসুক্য তৈরি হয়, প্রত্যাশা জেগে ওঠেতাতে মনে হয় ম্যাডাম ছবির একটা প্রধান চরিত্র হয়ে উঠতে পারত। এবং সেদিক থেকে মুনমুন অভিনীত ম্যাডাম এবং গার্র্গী অভিনীত অদ্রিজা চরিত্র দুটো পরষ্পরকে কমপ্লিমেন্ট করে। এক দিকে বেগমসাহিবা-তুল্য অভিজাত এক নেগেটিভ চরিত্র, আর অন্য দিকে চটুল ইশারা ইঙ্গিত আহ্বানে ভরা এই সময়ের এক অন্ধকার জগতের নারী।
‘বুনো হাঁস’য়ে সেই গল্প বলাটা রয়েছে যা দর্শককে পর্দার সঙ্গে সেঁটে রাখে। আর সেই সঙ্গে অনিরুদ্ধ সেই কাজটা করিয়ে নিয়েছেন দেবকে দিয়ে, যাকে নতুন ধারার বাংলা ছবির মেদ বর্জিত অভিনয় বলা হয়। সেই জন্যই সুদীপ্তা চক্রবর্তীর ওই রকম আটপৌরে কিন্তু তীক্ষ্ন অভিনয়ের পাশে দেবকে একটুও ফিল্মি লাগেনি। গ্লসি লাগেনি। ভবিষ্যতে দেব আরও দাপটের সঙ্গে অভিনয় করবেন, টলিউড সে আশা করতেই পারে। শুধু পর্দায় দেবের চেহারাটা এত বড়সড় লাগছে যে কোথাও গিয়ে ইউথফুলনেসটা ব্যাহত হচ্ছে। ওদিকে নজর না দিলে অচিরেই পর্দায় তাঁকে একটা ডাকাবুকো লোক মনে হবে। সোহাগের চরিত্রে শ্রাবন্তীর অভিনয় মহুয়া রায় চৌধুরীর কথা দারুণ ভাবে মনে পড়াল বহু যুগ পরে। ঋজুলার চরিত্রে তনুশ্রী তাৎপর্যপূর্ণ অভিনয় করেছেন ঠিকই কিন্তু এই ধরনের চরিত্রেই তাঁকে বার বার দেখছি আমরা (‘বেডরুম’, ‘কয়েকটি মেয়ের গল্প’)।
ইন্টারভ্যালের পরে ছবিটাকে তনুশ্রীই টেনে নিয়ে গিয়েছেন।
শঙ্কর চক্রবর্তীদের মিলিত অভিনয় দেখলে এটাই মনে হয় এই মুহূর্তে বাংলা চলচ্চিত্রে এত দুর্দান্ত সব ক্যারেক্টার আর্টিস্ট রয়েছেন যে মননশীল সাহিত্য নিয়ে ছবি করার কথা না ভাবাটাই ছবিকরিয়েদের ভুল।
শুধু রাইমাকে কেন বারডান্সার হিসেবে রাখা হল ছবিতে তা বোধগম্য হল না। একবারও আপাদমস্তক রাইমাকে দেখা যায় সেই আইটেম নাম্বারে এই রকম একটাও শট নেই।
‘বুনো হাঁস’ সবিশেষ কোনও আর্ট ফলনের চাপ থেকে বানাননি অনিরুদ্ধ। বানিয়েছেন যেন ভাললাগা থেকে, অনেকটা নিজেকেই বোঝাবার মতো এক অন্তরের তাগিদে। হয়তো সেই কারণেই ছবির প্রতি ফ্রেমে একটা ধৈর্যকে চিহ্নিত করা যায়। ফলে ‘বুনো হাঁস’ এমন একটা ছবি হয়ে ওঠে যা একবার দেখার পর দর্শকদের পক্ষে দ্বিতীয়বার দেখার ইচ্ছে হওয়াটা অসম্ভব নয়।
শেষ কোন বাংলা ছবির ক্ষেত্রে এমনটা ঘটেছে বলা মুশকিল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy