বাঙালি পরিবারে বিয়ে হয়েছিল তার, কিন্তু মনে-প্রাণে কি আজও সে গোঁড়া বিহারি পরিবারের সন্তান? ছেলে নিজের পছন্দে বিয়ে করেছে বলে আত্মঘাতী হতে চায় লাজ্জো!
ধারাবাহিকের নাম ‘তেতুঁলপাতা’। পরিবারের সকলে যে সুজন তা নতুন করে বলে দেওয়ার অপেক্ষা রাখে না। না হলে আর বাড়ির নাম কেন ‘তেঁতুলপাতা’ রাখা হবে! তা বলে কি অশান্তি নেই? নিত্য ঝামেলা লেগেই রয়েছে ঘরে। সে সব অশান্তিই বাইরের লোকের বয়ে আনা, যা কখনও কখনও এলোমেলো করে দেয় গেরস্থালি। যেমন এ বার। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় সম্প্রচারিত হতে চলেছে সেই পর্ব, যেখানে লাজ্জো মেনে নিতে রাজি নয় ছেলে ঋজুর বিয়ে। কারণ, যে মেয়েকে বিয়ে করে আনছে ঋজু, সে নাকি অন্য কারও ঘরনি! এ দিকে গল্পের নায়িকা ঝিল্লির উৎসাহেই সম্পন্ন হয়েছে বিয়ে। তাই অভিমানী খুড়শাশুড়ি ঝিল্লির সঙ্গেই নিজের নববিবাহিত পুত্রবধূকে বার করে দিতে চায় বাড়ি থেকে। কুয়োর পাড়ে উঠে লাজ্জো বলে বসে, “হয় ঝিল্লি ওই মেয়েটাকে নিয়ে এ বাড়ি থেকে বেরোবে, না হলে আমি এই কুয়োয় ঝাঁপ দিয়ে মরে যাব।”
শেষ পর্যন্ত কি কুয়োয় ঝাঁপ দিতে হবে লাজ্জোকে, না কি সত্যিই বাড়িছাড়া হবে ঝিল্লি? এ সব জানতেই আনন্দবাজার অনলাইন ফোন করেছিল লাজ্জো চরিত্রাভিনেত্রী আভেরী সিংহরায়কে। অভিনেত্রীর সাফ জবাব, “কী হবে, সেটা নিয়েই তো উত্তেজনা— দর্শকের যেমন, আমাদেরও তেমন। এই টানাপড়েনেই ধারাবাহিক এগোচ্ছে। ফলে লাজ্জো বা ঝিল্লির কী হবে, কে পাশে দাঁড়াবে, কী ভাবে হবে সমাধান, তা দেখতে হবে। তবে এমন একটা চরিত্রে অভিনয় করতে দারুণ লাগছে।”
তেঁতুলপাতা বাড়ির ছোটকাকিমা লাজ্জো। একদিন সে নিজেও এক বাঙালি পুরুষকে ভালবেসে বিয়ে করে এসেছিল প্রগতিশীল বাঙালি পরিবারে। কিন্তু নিজের রীতি-রেওয়াজ কখনও ত্যাগ করেনি, করতে বাধ্য করেনি কেউ। তাই অন্য বৌয়েরা যখন পরিপাটি বাঙালি সাজে, তখন লাজ্জোর শিফন শাড়ির আঁচল দিব্য ঝোলে ডান কাঁধ থেকে। সিঁথি ভরা তার মেটে সিঁদুর। আভেরী বলেন, “প্রাথমিক ভাবে, এই জায়গাটায় আমার একটু সমস্যা হয়েছিল, মেটে সিঁদুর পরলে আমাকে কেমন দেখাবে! কিন্তু চরিত্রের খাতিরে সবই করতে হয়। আর দেখলাম আমার ওই চেহারাও দর্শকের বেশ পছন্দ হয়ে গেল, যেন আমাকে খুব মানিয়ে গিয়েছে!”
তাঁর কথাবার্তায় দেহাতি টানও বেশ বাস্তবসম্মত। আর এ প্রসঙ্গেই আভেরী ফাঁস করলেন আসল রহস্য। এই চরিত্রে অভিনয়ের জন্য বোধহয় সবচেয়ে বেশি সাহায্য করেছেন তাঁর নিজের মা। আভেরীর কথায়, “আমার মায়ের ছোটবেলা কেটেছে বিহারে। মা এখনও ভোজপুরিতে কথা বলতে পারে। এই চরিত্রের জন্যই মায়ের কাছে সে সব জিজ্ঞেস করেছিলাম। মা শিখিয়ে দিচ্ছিলেন একটু একটু করে। কিন্তু তার পর এমন হল, আমি বাড়ি ফিরলেই মা দেখি ভোজপুরি বলতে শুরু করেন। এক দিন বলেই ফেললাম, ‘মা, আমি বাঙালি!’ কিন্তু বিষয়টায় আমি আর আমার মা দু’জনেই খুব মজা পেয়েছি।”

লাজ্জোর চরিত্রে আভেরী সিংহরায়। ছবি: সংগৃহীত।
এ ধারাবাহিকের প্রেক্ষাপট শিমূলপুরা। আদতে সে বাঙালির বড় চেনা ‘পশ্চিম’। এক সময় বাংলার পশ্চিমে, অধুনা বিহার-ঝাড়খণ্ডের একাংশে বসতি গড়েছিল তারা। শিমূলতলা, মধুপুর, গিরিডি বা তেমনই কোনও অংশের স্মৃতি নিয়ে ছোট পর্দায় ধরা দেয় ধারাবাহিকটি। এক যৌথ পরিবারের কাহিনি। তবে শুধু পর্দায় নয়, আভেরীর দাবি, ‘তেঁতুলপাতা’র সমস্ত কলাকুশলীও এমন এক শক্তপোক্ত যৌথ পরিবার। পরিচালক থেকে সমস্ত অভিনেতা— সকলের মধ্যে রয়েছে সুন্দর বোঝাপড়া। সকলেই সকলের পাশে দাঁড়ান, সকলের আনন্দে পাশে থাকেন। ঠিক যেমন তেঁতুলপাতা বাড়ি।
আভেরী জানান, সারা বছর লাজ্জো মেটে সিঁদুর পরলেও বিজয়ার দিনে লাল পাড় সাদা শাড়ির সঙ্গে, শাঁখা-পলা, লাল সিঁদুরে নিজেকে সাজায়। শুধু তা-ই নয়, বাড়ির নতুন বৌ ঝিল্লিকে সে বার সে-ই শিখিয়ে দিয়েছিল দুর্গাবরণের পারিবারিক রীতি। আবার, দু’সপ্তাহের মধ্যেই তেঁতুলপাতা বাড়িতে শুরু হয়েছিল ছটপুজো। সে দিন সকলেই লাজ্জোর সঙ্গে পুজো দিয়েছিল ভোরবেলায়।
এমন চিত্রনাট্যের পিছনে কি কোনও ভাবে বাঙালির ঘরের পাশে বিহারি প্রতিবেশীর সংখ্যাবৃদ্ধির প্রভাব রয়েছে? বাংলা ধারাবাহিকের প্রতি তাঁদেরও আকৃষ্ট করার প্রয়াস কাজ করছে? প্রশ্ন করায় অভিনেত্রী সাফ জানালেন, তাঁর এমন মনে হয় না। আভেরীর কথা, “বাংলা সাহিত্যে তো অনেক দৃষ্টান্ত রয়েছে যা ‘পশ্চিম’-এর প্রেক্ষাপটে, সেখানে অনেক দেহাতি চরিত্র রয়েছে। সতীনাথ ভাদুড়ি প্রধান পুরুষ। তাঁর সঙ্গে কোনও ভাবেই তুলনীয় নয়, তবু এ ধারাবাহিকের কাহিনি পরম্পরায় উঠে এসেছে আশপাশের সংস্কৃতি। সে তো স্বাভাবিক।”