Advertisement
০২ নভেম্বর ২০২৪
Bathroom Condition of Tollywood Studios

অভিনেতা হলে আলাদা বাথরুম, না হলেই স্টুডিয়োর হাতেগোনা শৌচালয়ে গুঁতোগুঁতি! কী বলছে টলিউড?

টলিগঞ্জের বড় অংশ জুড়ে স্টুডিয়োপাড়া। প্রত্যেক স্টুডিয়োতেই প্রতি দিন একাধিক সিরিয়ালের শুটিং চলে। ১৪ ঘণ্টা কাজ করতে গিয়ে কি পরিচ্ছন্ন শৌচালয় পান কলাকুশলী? খোঁজে আনন্দবাজার অনলাইন।

What are the bathroom condition of film studios in Tollygunge, do they maintain proper hygiene of washrooms

টালিগঞ্জের স্টুডিয়োপাড়ায় শৌচ ব্যবস্থার পরিকাঠামো কেমন? খোঁজ নিল আনন্দবাজার অনলাইন। প্রতীকী ছবি।

আনন্দবাজার অনলাইন সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৪ মে ২০২৩ ১০:০৯
Share: Save:

‘‘আশিকোঁ নে আশিকিকে লিয়ে তাজ মহল বনা দিয়া, হম এক শৌচালয় বনা না সাকে’’! অক্ষয় কুমারের সেই বিখ্যাত সংলাপের কথা মনে আছে? শৌচালয় যে মানুষের জীবনে কতটা গুরুত্বপূর্ণ, সমাজের পিছিয়ে পড়া শ্রেণির জন্য সেই বার্তাই দিতে চেয়েছিলেন পরিচালক শ্রী নারায়ণ সিংহ। শৌচালয়ের প্রয়োজনীয়তার বার্তা সিনেমার মাধ্যমে দর্শক পেয়েছিলেন। তবে যে মানুষগুলি এই ছবির সঙ্গে যুক্ত থাকেন, তাঁরা কি যথাযথ শৌচালয়ের সুবিধা পান? মুম্বই সব সময়েই কলকাতার চেয়ে পরিকাঠামোর দিক থেকে এক ধাপ এগিয়ে। তাঁদের স্টুডিয়োপাড়া অনেক বেশি ঝাঁ-চকচকে। তবে কলকাতার স্টুডিয়োগুলিও খুব পিছিয়ে নেই। কিন্তু টালিগঞ্জের স্টুডিয়োপাড়ায় শৌচ ব্যবস্থার পরিকাঠামো কেমন? কতগুলি শৌচালয় রয়েছে এক একটি স্টুডিয়োয়? সেগুলি কতটা নিয়মিত ভাবে পরিষ্কার করা হয়?

শুধু টালিগঞ্জ চত্বরেই প্রায় ১০ থেকে ১২টা স্টুডিয়ো। প্রতিটি স্টুডিয়োয় প্রতি দিন অন্তত ৩টি করে সিরিয়ালের শুটিং চলে। শুধু সিরিয়াল বললে ভুল হবে। সেখানে অনেক সময় সিনেমা এবং ওয়েব সিরিজ়েরও শুটিং হয়। আর একটা সিরিয়াল, সিনেমা, সিরিজ়ের শুটিং মানে শুধুই তো পরিচালক এবং শিল্পীরা নন। সেই কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকেন কয়েকশো মানুষ। শিল্পীদের জন্য তা-ও বরাদ্দ থাকে বেশ কিছু মেকআপ রুম। কিন্তু যাঁরা ক্যামেরার পিছনে থাকেন? তাঁদের জন্য কী ব্যবস্থা রেখেছে শহরের স্টুডিয়োগুলি? বিশেষত ইউনিটের মেয়েদের জন্য কী কী পরিকাঠামো রয়েছে? খোঁজ নিল আনন্দবাজার অনলাইন।

Do they really have proper facilities?

স্টুডিয়োপাড়ার শৌচালয়গুলির পরিকাঠামো নিয়ে কী বললেন ‘খেলনা বাড়ি’র মিতুল? ছবি: সংগৃহীত।

সৌমি পালিত। পেশায় ইপি (এগ্‌জ়িকিউটিভ প্রোডিউসার)। সিরিয়ালে এগ্‌জ়িকিউটিভ প্রোডিউসারদের দায়িত্ব, যেন প্রতি দিন সিরিয়ালের শুটিং সুষ্ঠুভাবে মিটে যায়। এই কাজটাই বিগত ১৪ বছর ধরে টানা সামলে আসছেন সৌমি। বহু সিরিয়াল এবং প্রযোজনা সংস্থার সঙ্গে কাজ করেছেন তিনি। সৌমির কথায়, “অনেকগুলো বছর কাটিয়ে ফেললাম এই পেশায়। আগের তুলনায় পরিকাঠামো অনেকটাই বদলেছে। বর্তমানে আমরা অনেকটাই স্বাস্থ্যকর পরিবেশে কাজ করি। শিল্পীরা তো আলাদা শৌচালয় পান। মানে তাঁদের মেকআপ রুমের সঙ্গে শৌচালয় থাকে। আমরা যাঁরা টেকনিশিয়ান, তাঁদের তো কোনও আলাদা ঘর থাকে না। এখানে যেটা থাকে, তা হল মেয়েদের জন্য বরাদ্দ একটি বাথরুম আর ছেলেদের জন্য থাকে একটি। তবে আমরা মেয়েরা মেকআপ রুমের বাথরুমই বেশির ভাগ সময় ব্যবহার করে থাকি। আসলে টেকনিশিয়ানদের মধ্যে বেশির ভাগ ছেলে তো। তাই আমাদের জন্য আলাদা তেমন কোনও ব্যবস্থা নেই। ফ্লোরে একটা বাথরুম থাকে। সেটা ছেলেরাই ব্যবহার করে থাকে। তাই একটু নোংরা হয়ে থাকে। তবে শিল্পীদের মেকআপ রুম দিনে দু’বার পরিষ্কার করা হয়। সত্যি বলতে, স্টুডিয়োগুলোয় মেয়েদের জন্য ধার্য আলাদা কোনও বাথরুম নেই। মেকআপ রুমের বাথরুম না থাকলে অসুবিধাই হত। বিশেষত ঋতুস্রাবের সময়। তবে তা-ও আগের থেকে পরিকাঠামো কিছুটা হলেও উন্নত হয়েছে।”

What floor producers are saying.

ইন্ডাস্ট্রিতে সাড়ে চার বছর কাটানোর পরেও রয়ে গিয়েছে পরিচ্ছন্ন শৌচাগার না পাওয়ার আক্ষেপ। ছবি: সংগৃহীত।

এই দিক থেকে শিল্পীরা বর্তমানে অনেকটা নিশ্চিত। একটা সময় ছিল, মেকআপ রুমও বরাদ্দ থাকত না শিল্পীদের। না ছিল এসি, না ছিল আলাদা শৌচালয়। সে ক্ষেত্রে সব কিছুর মধ্যেই নিজেদের সামলে নিতে হত শিল্পীদের। সেই সময়ের চেয়ে বর্তমানের পরিস্থিতি অনেক ভাল, এমনটাই বলছেন অভিনেত্রী অনুশ্রী দাস। এই ইন্ডাস্ট্রিতে তিনি প্রায় ৩৬ বছর কাটিয়ে ফেলেছেন। এতগুলি বছরে দেখেছেন বহু পরিবর্তন। এ প্রসঙ্গে অভিনেত্রীর মত, “এখন আমাদের স্টুডিয়োয় খুব ভাল ব্যবস্থা। বিশেষত করোনা পরিস্থিতির পর থেকে আরও বেশি করে স্বাস্থ্যকর শৌচালয়ের উপর বেশি জোর দেওয়া হচ্ছে। নিয়মিত পরিষ্কার করা হয়। এ বিষয়ে কোনও অভিযোগ জানাতেই পারব না।”

অন্য দিকে, এই ইন্ডাস্ট্রিতে আর এক নায়িকার বয়স মাত্র আড়াই বছর। এই পরিবর্তিত ইন্ডাস্ট্রিতেই তাঁর কেরিয়ার শুরু। আরাত্রিকা মাইতির ইন্ডাস্ট্রিতে এই মুহূর্তের পরিচয় অবশ্য মিতুল নামেই। ‘খেলনা বাড়ি’ সিরিয়ালে তাঁকে প্রতি দিন দেখেন দর্শক। তাঁর মতে, দিনে দু’বার বাথরুম পরিষ্কার করানো হয় স্টুডিয়োর তরফে। কিন্তু পাশাপাশি শিল্পীদেরও দায় বর্তায়, তাঁরা যেন নিজেরাও বাথরুম পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখেন। আরাত্রিকা বলেন, “আমরা সব সময় আলাদা মেকআপ রুম পাই না। হয়তো একটা বাথরুম তিন জন ব্যবহার করি। এ ক্ষেত্রে আমাদেরও দায়িত্ব থাকে, যেন আমরা বাথরুমগুলো পরিচ্ছন্ন রাখি।”

টলিপাড়ার আর এক এগজ়িকিউটিভ প্রোডিউসার তনিমা চট্টোপাধ্যায়ের গলায় খানিকটা অভিযোগের সুর। তাঁরও প্রায় এই পাড়ায় বয়স হয়ে গেল সাড়ে চার বছর। ইন্ডাস্ট্রির নামী প্রযোজনা সংস্থার সঙ্গে যুক্ত তিনি। এই মুহূর্তে তাঁর দায়িত্বে টালিগঞ্জের এক চর্চিত সিরিয়াল। তনিমার কথায়, “আমি নিজে শিল্পীদের মেকআপ রুমের বাথরুমই ব্যবহার করে থাকি। কারণ সত্যিই আমাদের জন্য সঠিক পরিকাঠামো নেই। যে বাথরুমটি বরাদ্দ আছে টেকনিশিয়ানদের জন্য, তা দিনে এক বারই পরিষ্কার করা হয়। অন্তত দু’বার যদি পরিষ্কার না করা হয়, তা হলে তা ব্যবহারযোগ্য হয়ে ওঠে না। অনেক সময় বাথরুম এতটাই ছোট হয় যে, নোংরা ফেলার একটি বালতিও রাখা যায় না। ঋতুস্রাবের সময় খুবই অসুবিধা হয়।”

স্টুডিয়োপাড়ার অধিকাংশের মতে, শিল্পীরা তা-ও পরিষ্কার শৌচালয়ের ব্যবস্থা পান। কিন্তু টালিগঞ্জের টেকনিশিয়ানদের এখনও বেশ কিছু সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। বিশেষত তিনি যদি কোনও মহিলা টেকনিশিয়ান হন। এই দায়িত্ব কার? ‘ফেডারেশন অফ সিনে টেকনিশিয়ান্‌স অ্যান্ড ওয়ার্কার্স অফ ইস্টার্ন ইন্ডিয়া’র না কি স্টুডিয়ো মালিকদের? এ প্রসঙ্গে ফেডারশনের সভাপতি স্বরূপ বিশ্বাসের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে, তাঁর কণ্ঠে অনুযোগের সুর। স্টুডিয়ো মালিকদের প্রতি তাঁর ক্ষোভ খানিকটা উগরে দিলেন তিনি। স্বরূপ বলেন, “কয়েকটা স্টুডিয়ো ছাড়া বাকি সব স্টুডিয়োর বাথরুম ব্যবহারের অযোগ্য। ‘টেকনিশিয়ান স্টুডিয়ো’ বেশ কিছু দিন আগে নতুন ভাবে তৈরি হয়েছে। আরও কিছু স্টুডিয়ো নতুন ভাবে তৈরি করা হচ্ছে। সেগুলো ছাড়া আর কোনও স্টুডিয়োয় টেকনিশিয়ানদের বাথরুম মোটে ব্যবহারযোগ্য নয়। মহিলাদের জন্য আলাদা বাথরুম নেই।” স্টুডিয়ো মালিকদের দিকেই আঙুল তুলেছেন স্বরূপ। তিনি আরও যোগ করেন, “এই পরিকাঠামোর সম্পূর্ণ দায় বর্তায় স্টুডিয়ো মালিকদের উপর, যাঁরা লক্ষ লক্ষ টাকা রোজগার করছেন এই স্টুডিয়োগুলো থেকে। এক বার আমি নিজে উদ্যোগী হয়ে স্টুডিয়ো মালিকদের সঙ্গে মিটিং করেছিলাম। অনুরোধ করেছিলাম, স্বাস্থ্যকর বাথরুম তৈরির জন্য। কেউ কোনও কর্ণপাত করেননি। আমার কাছে মেলও আছে। স্টুডিয়ো মালিকরা চাইলেই বাথরুম ঠিক হয়ে যাবে। ফেডারেশন থেকে আমরা অনুরোধ করতে পারি, তার থেকে বেশি কিছু করতে পারব না।”

স্টুডিয়ো মালিকরা কি শুধুই আর্টিস্টদেরই কথা ভাবেন? তাঁরা স্বচ্ছন্দে কাজ করলেই কি সব দায়িত্ব শেষ? না কি স্টুডিয়ো মালিকরা টেকনিশিয়ান অর্থাৎ একটি সিরিয়াল বা সিনেমার সঙ্গে যুক্ত বাকি লাইটম্যান, ক্যামেরাম্যান, ইপি, জুনিয়র অ্যাসিসট্যান্ট ডিরেক্টর বা অন্য বিভাগের সহকারীদের কথাও ভাবছেন? ফেডারেশনের সভাপতির অভিযোগ খানিকটা হলেও কি সত্যি? তা জানতেই আনন্দবাজার অনলাইনের তরফে যোগাযোগ করা হয় টালিগঞ্জের বেশ কিছু স্টুডিয়ো মালিকের সঙ্গে। পার্পল স্টুডিয়োর প্রাক্তন অধিকর্তা প্রীতিময় চক্রবর্তী এই বক্তব্যের সঙ্গে মোটেই সহমত নন।

প্রীতিময় বললেন, “বাকি স্টুডিয়োর কথা বলতে পারব না। কিন্তু এই মুহূর্তে পার্পল স্টুডিয়ো সারা দেশের মধ্যে সেরা স্টুডিয়ো। যাঁরা এখানে কাজ করে গিয়েছেন, তাঁদের জিজ্ঞেস করলেও জানতে পারবেন। এক দিকে যেমন টেকনিক্যাল দিক থেকে বাকি স্টুডিয়োগুলোর থেকে এগিয়ে, তেমনই এই স্টুডিয়োর বাথরুমও ভীষণ ভাবে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার চেষ্টা করা হয়। সব সময় নজর দেওয়া হয়। মহিলাদের জন্য আলাদা ব্যবস্থা আছে। পুরুষদের জন্যও রয়েছে আলাদা বাথরুম। আবার ভিআইপিদের জন্যও সুব্যবস্থা রয়েছে। আমাদের স্টুডিয়োয় অনেক বড় বড় রিয়্যালিটি শোয়ের শুটিং চলে। সুতরাং তেমন ব্যবস্থা না থাকলে নিশ্চয়ই সে সব শুটিং হত না। বাকিদের কথা বলতে পারব না, ‘পার্পল স্টুডিয়ো’ শিল্পীদের পাশাপাশি টেকনিশিয়ানের কথাও ভাবে।”

টালিগঞ্জের অন্যতম পুরনো শুটিংয়ের ঠিকানা হল ‘ইন্দ্রপুরী স্টুডিয়ো’। বহু বিখ্যাত সিনেমার শুটিং হয়েছে এই স্টুডিয়োয়। বর্তমানে একাধিক সিরিয়ালের সেট পড়ে এই চত্বরে। ‘নিউ থিয়েটার্স’, ‘ইন্দ্রপুরী’, ‘টেকনিশিয়ান’— এই সব স্টুডিয়োয় এককালে যাতায়াত ছিল নামজাদা শিল্পীদের। সেই ঐতিহ্য এখনও বহন করে চলেছেন তাঁরা। নতুনদের ভিড়ে এখনও এই সব স্টুডিয়োতে গেলে পাওয়া যায় সেই পুরনো মাটির গন্ধ। নতুনদের প্রতিযোগিতায় পরিকাঠামো কতটা উন্নত করতে পেরেছেন ইন্দ্রপুরী স্টুডিয়োর মালিক তেজেশ দোশি। স্বরূপের অভিযোগ কি সত্যিই ঠিক? তেজেশ বলেন, “প্রতি দিন পরিষ্কার করা হয় আমাদের স্টুডিয়োর বাথরুম। তবে যাঁরা ব্যবহার করছেন, তাঁদেরকেও পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। তবে ইন্দ্রপুরীকে আমরা নতুন ভাবে সাজানোর চেষ্টা করছি। আমরা চিন্তা করি। অনেক সময় সবটা করে উঠতে পারি না। আমার স্টুডিয়োয় একটা বাথরুম আছে। সেটা সুন্দর ভাবে গড়ে তোলার জন্য তা হলে সেই বাথরুমটা বন্ধ করতে হবে। সেটা যদি এক মাস বন্ধ থাকে, সেই সময়টা টেকনিশিয়ানরা কোন শৌচালয়ে যাবেন? পুরনো স্টুডিয়োয় বিকল্প কোনও ব্যবস্থা নেই। অনেক বাস্তবিক সমস্যা আছে। যা সাধারণ মানুষের পক্ষে বোঝা কঠিন। তবে আমাদের মাথায় আছে। ধীরে ধীরে ইন্দ্রপুরীতে কাজ শুরু হয়েছে। আগামী দিনেও সবাইকে ভাল পরিকাঠামো দিতে পারব আশা করছি। সবার জন্য ভাল বাথরুমও তৈরি করব। আমায় একটু সময় দিতে হবে। নিশ্চিত, পরবর্তী কালে কারও কোনও অভিযোগ থাকবে না। ”

অন্য বিষয়গুলি:

Tollywood Studio bathroom
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE