শ্রীজাত।
সকাল সাড়ে ৮টা
চাকরির সঙ্গে আমি দীর্ঘ দিন যুক্ত নই। তাই খুব সকালে ওঠার অভ্যেস আমার নেই। তবে এই লকডাউন আমি কেন, আমার পূর্বপুরুষেরাও দেখেনি। আজ সহজে লিখতে বসলেও এই নতুন পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে ওঠার অনেকটা সময় আমার নিজেকে দিতে হয়েছিল। এর অভিঘাত প্রথম পর্যায়ে একেবারেই নন প্রোডাক্টিভ ছিল। চারপাশ যেন চেনা যায় না। প্রথম দশ দিন লেগেছিল এই পরিস্থিতি বুঝতে।
কেমন করে বাজারহাট জারি রাখব? টাকাপয়সা তুলব? দেখছিলাম চারপাশে যে কাজ থেকে আমাদের উপার্জন হয়, সেই কাজের অনেক ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে। তা হলে চলব কী করে? সেটা ভাবতে দশ-বারো দিন এলোমেলো ভাবে চলে গেছে। কখন যে খেয়েছি? কী করেছি? জানি না...
লকডাউনে সব ডোমেস্টিক হেল্পকেও সবেতন ছুটি দেওয়া হল। ফলে আমরা কাজ ভাগ করে নিলাম কে কী করব? এটাও অভ্যস হতে সময় লেগেছে আমাদের। বিদেশে দেখেছি লোকে অফিস থেকে ফিরে বাসন মাজে, রান্না করে। এখানে তো সেই অভ্যেস নেই। প্রথম দশ দিন বাড়ির কাজ করতে অনেক সময় চলে গিয়েছে। আমি তো আর বাড়ির কাজে দক্ষ ছিলাম না। যাই হোক, বেশ কিছু দিন যাওয়ার পর এখন নিজেকে বুঝিয়েছি, এই সময় থেকে দ্রুত উন্নতির দিকে এখন যাব বলে মনে হচ্ছে না। এর মধ্যেই পুরনো কাজ চালিয়ে যেতে হবে। যাপনকে ঠিক রাখতে হবে। নয়তো অবসাদ গ্রাস করবে। নয়তো মনে হবে, সারাদিন কাপড় কাচছি, ভাবছি কী করে চাল-ডাল আসবে? তা হলে আমার জীবনে কী রইল?
এগুলো করেও অন্য কাজ করা যায়। সেই জায়গায় নিজেকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছি আমি। আগে সাড়ে ৮টায় ঘুম থেকে উঠতাম। আজ তাই উঠেছি। শুতে শুতে গত কাল তিনটে হয়েছে। আগের দিন রাতেই আমি আর দূর্বা কাজ ভাগ করে নিয়েছিলাম। আজ আমার ভাত বসানোর দিন। আমেরিকায় ওয়ার্কশপ করতে গিয়ে ৬ মাস নিজে রেঁধেবেড়েই খেয়েছি। ওইটুকু অভ্যেস আছে। তবে রান্নাটা তো আর আমার প্যাশন নয়, খুব যে ভাল লাগে তা নয়। বরং মনে হয় আবার ভাত বসাতে হবে, তার চেয়ে একটা গান শুনলে ভাল হত। দূর্বা আজ কাপড় কাচল। ওকে কাপড় মেলতে সাহায্য করলাম।
সকাল সাড়ে ৯টা
সকালে আমি যেখানেই থাকি একটাই মেনু। দু’পিস টোস্ট, একটু স্প্রেড আর দু’কাপ কফি। আমি সব সময় নিজের ব্রেকফাস্ট আর কফি নিজে বানাতে পছন্দ করি। আজও তাই করলাম। এ বার লেখার দিকে যাব। চিকিৎসকের পরামর্শে এই মাস থেকে একটা ভিটামিন সি যোগ করেছি খাওয়ায়। তবে হঠাৎ হলুদ বা মধু খেতে পারব না। স্বাদের ব্যাপারে আমি রেস্ট্রিক্টেড।
বেলা ১১টা
দশ-বারো দিন কিচ্ছু লিখিনি। পারিনি। চারপাশে এত অনিশ্চয়তা! কাল কী হবে? লকডাউন উঠলে সারা পৃথিবীতে যে চূড়ান্ত অর্থনৈতিক বিপন্নতা তৈরি হবে। কী করব তখন? এখন বুঝছি না আমরা। চাল, ডাল পেয়ে যাচ্ছে কলকাতার মানুষ, কিন্তু পৃথিবীর অর্থনীতি পড়ে গিয়েছে। তার মাশুল আমাদের সব্বাইকে দিতে হবে। এখন চেষ্টা করছি যেটুকু কাজ হাতে আছে সেটা নিয়ে ছন্দে ফেরার। অনুষ্ঠান সব বাতিল। সামনে কতগুলো বিদেশ সফর ছিল, সেগুলো আর হবে না। আমার ধারণা, বছরখানেক বাইরে অনুষ্ঠানে আর যেতে পারব না। এই মুহূর্তে দেশে যা কাজ আছে সেটা করতেই হবে। তাই জোর করে নিজেকে কাজে বসাচ্ছি। নিজেকে বোঝাতেই হবে। কোনওমতেই ‘নন প্রোডাক্টিভ’ থাকা যাবে না। আজ সুনীলদার কথা মনে পড়ছে। সুনীলদা বলতেন, ‘লেখা আসুক না আসুক প্রত্যেক দিন সাদা পাতার সামনে চুপচাপ বসবে। জানবে, ওটাই তোমার মেডিটেশন।’ লকডাউনের প্রথম দিকে আমি কিচ্ছু লিখতে পারিনি। কিন্তু ল্যাপটপে ওয়ার্ড ডকুমেন্ট খুলে বসে থাকতাম। হাঁ করে তাকিয়ে থাকতাম। ব্ল্যাঙ্ক লাগত। এটা করতে করতে আজ গান এল। এখন সৃজিতের ‘ফেলুদা’ আর ‘কাকাবাবু’
স্ত্রী দূর্বার সঙ্গে শ্রীজাত
দুপুর দেড়টা
স্নান সেরে খাওয়া। রান্না করতে ভাল না লাগলে কী হবে? আমি ডাল, ভাত আর ডিমের ঝোল রেঁধে খাইয়েছি দূর্বাকে। ছোটবেলার অভ্যেস দুপুরে গান শোনা বা নাটক শোনা। এখন ইউটিউবে পুরনো নাটক চালিয়ে ঘর অন্ধকার করে আমি আর দূর্বা শুনি। আজও শুনলাম। তার পর সোজা দিবানিদ্রা। আমি তো চাকরি ছেড়েছিলাম দুপুরে ঘুমবো বলে। আমার বন্ধুরা কথাটা বললে হাসে। কিন্তু এটাই সত্যি। চাকরি ছেড়ে অন্য কোনও ভাবে রোজগার করে দুপুরে ঘুমোই। আমায় দুপুরে কোনও ইভেন্টে দেখা যায় না। ফোন বন্ধ থাকে। দুপুরের প্রেম নিয়ে গল্পও সব রাতেই লেখা।
বিকেল ৫টা
চা বানালাম। আমার লেখার ঘরে এখন। এই লকডাউনে একটা অন্য কাজ চলছে আমার। বাইরে বলিনি। দীর্ঘ দিন ধরে একটা উপন্যাস মাথায় ঘুরছিল।আগে এত বাইরে যেতে হচ্ছিল যে ক্লান্ত হয়ে পড়ছিলাম। লেখা হচ্ছিল না। আমি এখন উপন্যাস লেখার চেষ্টা করছি। না, লিখছি বলতে পারি না ও ভাবে। তবে একটা ধাঁচ তাড়া করছিল আমায় বেশ কিছু দিন ধরে। সেটা নিয়েই কাজ চলছে। জানি না শেষে কী হবে? কিন্তু উপন্যাস লেখার চেয়ে মজাদার কাজ খুব কম আছে। আমি বছর চার-পাঁচ উপন্যাস লিখছি। উপন্যাসে একটা প্রেমাইস ক্রিয়েট হয়। এখন যেমন করছি। চরিত্র তৈরি করছি। একটা অঞ্চল তৈরি হয়েছে যা সেলিমপুর হতে পারে আবার প্যারিসও হতে পারে। এই যে ৫টায় আমি দরজা বন্ধ করে ল্যাপটপ খুলে ফাইলটায় ঢুকছি, আমি কিন্তু এই লকডাউন পরিস্থিতির কলকাতার সেলিমপুরে আর বসে নেই তখন। আমি বাইরে চলে যাচ্ছি... আমার চরিত্রদের সঙ্গে থাকছি। এই চার ঘণ্টা আমার মানসভ্রমণ। এই পরিস্থিতিতে এটা আমাকে কোথাও বাঁচিয়ে দিচ্ছে। আসলে, এটাই তো আমার কাজ। তপন সিংহ তাঁর ছবি ‘গল্প হলেও সত্যি’-তে রবি ঘোষের মুখে একটা সংলাপ বসিয়েছিলেন, ‘যার যেখানে কাজ তার সেখানে মুক্তি’। উপন্যাস লিখতে বসে বুঝতে পারছি এটাই আমার কাজ।
আমার মুক্তি এখানেই।
রাত ৯টা
আমার ল্যাপটপ বন্ধ। আমার তৈরি করা প্রেমাইস থেকে ছুটি। উপন্যাস লিখলে বড্ড কায়িক পরিশ্রম হয়। সৃজিত, রুদ্র, যিশু, নীলাঞ্জনা, ইন্দ্রদীপ, দূর্বা সবাই ভিডিয়ো কলে আড্ডা দিলাম আজ। তার পর দেখি শ্রীকান্তদা হারমোনিয়াম নিয়ে বসেছে, জয় কিবোর্ড নিয়ে… তিনটে গজল হয়ে গেল!
রাত ১টা
গান শুনছি। ভাবছি…
‘সুরে কোথাও কম কিছু আজ, কথারও তাল কাটা/আসছে বোশেখ এবার বুঝি হবে না হালখাতা’।
পৃথিবীর অনেক বয়স। আর মানুষ? এই তো সবে এল!
ক’দিন থেকেই বুঝে গেল মানুষ পৃথিবীটা বুঝি শুধুই তাদের। তা তো নয়! তাই যদি হত, তা হলে ভেনিসে ডলফিন ফিরে আসত না। যাচ্ছেতাই ভাবে পৃথিবীকে ব্যবহার করেছি আমরা। শুনলাম কলোরাডোর এক গ্রসারি স্টোরে গতকাল হরিণ এসেছিল খাবার খেতে। তাকে খেতে দেওয়া হলে সে আরও ১২টা হরিণকে সঙ্গে নিয়ে আসে! পৃথিবীটা তো এদের। এটা আমাদের বুঝতে হবে। এর পর যে ক’জন আমরা বেঁচে থাকব তারা যেন মনে রাখি পৃথিবীটা একা আমাদের নয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy