অডিয়ো ক্লিপে শোনা যাচ্ছে, মাহিয়া মাহির সঙ্গে অশ্রাব্য ভাষায় কথা বলছেন বাংলাদেশের তথ্য প্রতিমন্ত্রী মুরাদ হাসান।
পরীমণির পর ফের এক নায়িকার সঙ্গে অবমাননার অভিযোগ ঘিরে উত্তাল বাংলাদেশ। গত রবিবার রাতে ভাইরাল হওয়া একটি অডিয়ো ক্লিপে শোনা যাচ্ছে, নায়িকা মাহিয়া মাহির সঙ্গে অশ্রাব্য ভাষায় কথা বলছেন বাংলাদেশের তথ্য প্রতিমন্ত্রী মুরাদ হাসান। তক্ষুনি হোটেলে আসার জন্য জোর করা, ধর্ষণ-হুমকি এবং পুলিশ পাঠিয়ে তুলে নিয়ে আসবার ভয় প্রদর্শন---সব কিছুই রয়েছে তাতে। ইতিমধ্যেই এ নিয়ে ক্ষোভে ফেটে পড়েছেন বিশিষ্টরা। পদক্ষেপ করেছে বাংলাদেশ সরকারও।
অডিয়ো ক্লিপ ফাঁসের কয়েক দিন আগে বাংলাদেশের বিরোধী দলনেত্রী খালেদা জিয়ার পরিবারের এক সদস্যার উদ্দেশে কুরুচিকর মন্তব্য করে এই মুরাদই সমালোচনার মুখোমুখি হয়েছিলেন। পরোয়াহীন মুরাদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কেও অসম্মানজনক মন্তব্য করেন। সেখানকার হোস্টেলের ছাত্রীরা পাঁচতারা হোটেলে রাত কাটায় বলতেও বাধেনি তার।
ফোনালাপ ফাঁসের পরে মুরাদকে পদত্যাগের নির্দেশ দিয়েছেন ক্ষুব্ধ প্রধানমন্ত্রী। মন্ত্রিত্ব খোয়ানোই শুধু নয়, দলীয় পদ থেকেও তিনি অপসারিত। আওয়ামী লীগ মুরাদের সঙ্গে আর কোনও সম্পর্ক রাখবে না বলেই খবর। ঘোরালো পরিস্থিতিতে এখন ক্ষমা চাইছেন মুরাদ। কিন্তু ইতিমধ্যেই তাঁর কঠিন শাস্তির দাবিতে সরব অনেকেই।
বাংলাদেশের লেখিকা সেলিনা হোসেন স্থানীয় সংবাদমাধ্যমে বলেছেন, “প্রতিমন্ত্রী কেন, কেউই এমন ঘৃণিত মন্তব্য করতে পারেন না।পদত্যাগের মাধ্যমে তাঁকে শাস্তি দেওয়া একটা দৃষ্টান্ত হতে পারে। তবে এটাই চূড়ান্ত সমাধান নয়। আমাদের আইনি ব্যবস্থার আরও পরিবর্তন করা প্রয়োজন। এ ধরনের অপরাধীদের শাস্তি দিতে হবে এবং তাদের কঠোর আইনে শাস্তি হওয়া উচিত। এমন অপরাধ আর কেউ যেন করতে সাহস না করে।”
অভিনেত্রী তারানা হালিমও সংবাদমাধ্যমে বলেছেন, "মুরাদ হাসান যে ভাষায় কথা বলেছেন, তা বিকৃত রুচির, অশালীন, নারীর প্রতি অবমাননাকর। শাস্তি তাঁর প্রাপ্য। এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে কঠিন, কঠোর হতে হয়েছে। ভবিষ্যতে সব লুটেরা, ঘুষখোর, লম্পটের বিরুদ্ধে এমন কঠোর পদক্ষেপ অব্যাহত থাকুক।"
দু’বছরের ব্যবধানে একই ধরনের অভিযোগ। নারীর সঙ্গে কুরুচিকর ব্যবহার করেও ক্ষমতার অলিন্দে টিকে যাওয়া স্তম্ভিত করেছে অনেককেই।
বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের নাট্যনির্মাতা ও চলচ্চিত্রকার আশফাক নিপুণ ফেসবুকে লিখেছেন, “দু’বছর আগে লোকটা নারীদের এ সব কুৎসিত কথা বলত ফোনে, দু’বছর পরে লাইভে এসে বলে। এই দু’বছরে উচ্চপর্যায়ের কেউ কি জানত না এই লোকের নারীর প্রতি মনোভাব আর মুখের ভাষা এ রকম?”
বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ছবি নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর ক্ষোভ— “আগের দিন দেখলাম, প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার নাতনিকে নিয়ে অশ্লীলতম ভাষায় কথা বললেন। তার পরদিন সেই একই লোক এক অনুষ্ঠানে গিয়ে পুলিশ ভাইদের বললেন তাঁরা যেন কারও সঙ্গে ব্যবহার খারাপ না করেন। তার পরদিন শুনলাম, উনি ধর্ষণের হুমকি দিচ্ছেন কাউকে। এমন দেশটি কোথায় খুঁজে পাবেন?”
লেখক তসলিমা নাসরিনের বক্তব্য— "বাংলাদেশের তথ্য প্রতিমন্ত্রী কথা বলছেন একজন ভদ্রমহিলার সঙ্গে। অথবা ক্ষমতা কথা বলছেন এক নারীর সঙ্গে। দম্ভ কথা বলছেন এক রমণীর সঙ্গে। রাজা কথা বলছেন তাঁর প্রজার সঙ্গে। পুরুষ কথা বলছেন এক মেয়ের সঙ্গে। ধর্ষক কথা বলছেন তাঁর শিকারের সঙ্গে।"
বাংলাদেশ সংবাদমাধ্যমে সে দেশের সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এবং ইউনিভার্সিটি অফ এশিয়া প্যাসিফিক-এর আইনের শিক্ষক শাহদীন মালিক লিখেছেন, "বঙ্গবন্ধু তাঁর ৭ মার্চের বক্তৃতায় আমাদের মুক্তি ও স্বাধীনতাসংগ্রামের কথা বলেছিলেন। স্বাধীনতার ৫০ বছর হয়ে গিয়েছে এবং এর অনেক সুফল আমরা পেয়েছি। কিন্তু মুক্তির সংগ্রামের সুফল আমরা পাইনি বললেই চলে। আমাদের গণতন্ত্র দুর্বল হয়েছে। মূল প্রতিষ্ঠানগুলো, অর্থাৎ বিচার বিভাগ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, প্রশাসন, নির্বাচন কমিশন, জবাবদিহি, ভোটের অধিকার এবং সেই সঙ্গে শিক্ষার মান, স্বাস্থ্যসেবার সহজলভ্যতা, ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ—এই ধরনের লক্ষ্য অর্জনের মাপকাঠিতে আমাদের অভীষ্ট মুক্তি থেকে আমরা ক্রমাগত পিছিয়ে পড়ছি। এই পিছিয়ে পড়ার জলজ্যান্ত উদাহরণ হচ্ছে মুরাদ হাসানের মতো ব্যক্তিরা সংবিধানে বিবৃত শপথ নিয়ে এই দেশের মন্ত্রী হচ্ছেন।”
আগেই সংবাদমাধ্যমের কাছে ওই ফোনের সত্যতা স্বীকার করেছেন বাংলাদেশেরই নায়ক ইমন। অভিনেতার দাবি, দু’বছর আগে তাঁকেই ফোনটি করেছিলেন মুরাদ হাসান। সেই সময়ে সহশিল্পী মাহিয়ার সঙ্গে বনানীর এক রেস্তোরাঁয় ছিলেন ইমন। নতুন ছবির শ্যুটিং বিষয়ে কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে আলোচনায় বসেছিলেন তাঁরা। মুরাদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে তিনিই ফোন এগিয়ে দেন মাহিয়াকে। তার পরেই মুরাদ এমন কাণ্ড ঘটান বলে অভিযোগ। যা শোনা গিয়েছে ওই অডিয়ো ক্লিপে। ইমন জানিয়েছেন, মাহিয়াকে মুরাদ যে এমন অশ্লীল কথা বলেছেন, তা ঘটনার সময়ে জানতে পারেননি তিনি। এখন বিষয়টি জেনে স্তম্ভিত অভিনেতা।
মাহিয়া বর্তমানে মক্কায় আছেন। একটি অডিয়ো বার্তায় তিনিও ফোনালাপের সত্যতা স্বীকার করেছেন। বলেছেন, "সেদিনও বিব্রত হয়েছিলাম। আত্মসম্মানে আঘাত লেগেছিল। আজ আবার বিব্রত হয়েছি। নিজে তো ছোট হয়েইছি, দেশবাসীর কাছেও ছোট হলাম। এই ভাষা ও ব্যবহারের প্রত্যুত্তর আমার কী দেওয়ার ছিল? কিছু বলার ভাষা ছিল না। সে জন্যই প্রতিবাদ করিনি। আমার মতো করে পাশ কাটিয়েছি। দু'বছর আগের ঘটনা। সর্বশক্তিমানের কাছে বলেছিলাম আমার কষ্টের কথা, তিনি বিচার করেছেন।"
তবে নতুন ফেসবুক পোস্টে মক্কা থেকে মাহিয়া লিখেছেন, দেশে ফিরেই ৩০ সেকেন্ডের জন্য হলেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে কথা বলতে চান। কী বলবেন তিনি প্রধানমন্ত্রীকে? কোন ভয়ে তিনি সহশিল্পী ইমনকেও সেদিন বলেননি মুরাদের নোংরা হুমকির কথা? তা স্পষ্ট হবে হাসিনার সঙ্গে অভিনেত্রীর সাক্ষাতের পরে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy