উস্তাদ জ়াকির হুসেন। —ফাইল চিত্র।
এক জন শিল্পী তাঁর গোটা জীবন ধরে শিল্পের চর্চাকে কোন উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারলে তিনি আর তাঁর শিল্প সমার্থক হয়ে উঠতে পারেন, তার উদাহরণ উস্তাদ জ়াকির হুসেন। অত্যুক্তি মনে হতে পারে, কিন্তু তবু এ কথা লিখতে ইচ্ছে করছে যে, বাদ্যযন্ত্র তবলাকেই যদি আজ জ়াকির বলে সম্বোধন করি, ক্ষতি কী!
উস্তাদ জ়াকির হুসেন সেই বিরল প্রতিভাদের, সেই অকল্পনীয় নক্ষত্রদের গোত্রভুক্ত, যাঁরা নন্দনকলার ঈশ্বরের অবতার হিসেবেই মাটির পৃথিবীতে এসেছিলেন। শাস্ত্রীয় সঙ্গীত হোক বা যে কোনও ধরনের গানবাজনা— শ্রেষ্ঠত্ব সহজে আসে না। তবলা আগেও বাজত, আজও বাজে, কালও বাজবে। কিন্তু জ়াকির হুসেনের মাপের শিল্পীই পারেন ধারাবাহিকতার সাধারণ অর্থের অনেক ঊর্ধ্বে আরোহণ করে দিশারি হয়ে উঠতে। জ়াকির হুসেন সেই দিশা আমাদের দেখিয়ে গিয়েছেন। শতাব্দীতে এক জন জ়াকির হতে পারেন। হয়তো-বা একও নয়, বহু শতকের অপেক্ষাই থাকে এক জন জাকিরকে পাওয়ার জন্য।
ব্যক্তিগত ভাবে অনেক কথা মনে আসছে, আসবে। আজ সেই সব কথাই একটি নির্দিষ্ট প্রত্যয়ের কথা বারে বারে মনে করিয়ে দিচ্ছে— এই ক্ষতি শুধু ব্যক্তির নয়, ব্যক্তিগত নয়, ঘেরাটোপের ভৌগোলিক সীমাখণ্ডেরও নয় শুধু। তাঁর প্রয়াণ গোটা বিশ্বের ক্ষতি, তামাম সঙ্গীতজগতের ক্ষতি।
একটা নাম কী ভাবে প্রজন্মের পর প্রজন্মের কাছে ধ্রুবপদ হয়ে উঠতে পারে, তা জ়াকিরের জীবন জুড়ে ফুটে উঠেছে। গোটা বিশ্বের কাছে তবলা মানেই উস্তাদ জ়াকির হুসেন— কী ভাবে সম্ভব হয়ে উঠল? এখানেই সেই অবতার-তত্ত্বের কথা মনে আসে। সত্যিই মনে হয়, ঈশ্বর-প্রেরিত অবতার ছাড়া এই ভাবে ইতিহাস হয়ে ওঠা সম্ভব নয়।
সর্বার্থেই এক জন বিরল মানুষ জ়াকির। না, সঙ্গীতে তাঁর তুমুল খ্যাতির প্রসঙ্গে নয় এ কথা; সে তো সবাই জানেন। যেটা বলার, তা হল অসাধারণ হয়েও চূড়ান্ত সাধারণ থাকার জাদু! জ়াকির হুসেন সেই বিরল ব্যতিক্রমের নাম। বিশ্বময় যাঁর খ্যাতি, তিনি যখন আড্ডা মারতেন, বিস্ময় জাগত, এত সাবলীল ভাবে সবার সঙ্গে এ ভাবেও মিশে যাওয়া যায়! নানা অনুষ্ঠানে তাঁর সঙ্গে থাকার সুবাদে দেখেছি, মানুষটা ভিতর থেকে কী অবলীলায় সাধারণ থাকার তপস্বী। এমনও হয়েছে, কোনও ছোট অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে, নিজেই গাড়ি ভাড়া করে অনুষ্ঠানের জায়গায় পৌঁছে গিয়ে বলছেন— “বলো,কখন বাজাব?”
আমরা দেশে-বিদেশে অনেক-অনেক গুণী-প্রণম্য শিল্পীর সঙ্গে বহু অনুষ্ঠান করেছি। বিদেশে এমনও হয়েছে, ৩৩ দিনে ৩২টা কনসার্ট। ভোর থেকে রাত যাতায়াত, অনুষ্ঠান। তার মধ্যে মাঝরাতে বিশ্রামের সময় জ়াকিরের সঙ্গে হিন্দি-ইংরেজি সিনেমা দেখা। তখন সম্পূর্ণ অন্য জ়াকির! নানা বিষয়ে আগ্রহ আর পারদর্শিতা। এক বার জ়াকিরের কম্পোজ় করা একটা গজ়ল শুনে মোহিত হয়ে গেলাম। বললাম— আমি গাইতে চাই। উস্তাদজি সঙ্গে সঙ্গে রাজি। মুম্বইয়ের একটা অনুষ্ঠানে গেয়েওছিলাম। সবাইকে অবাক করে দিয়ে শেষে আমি জানিয়েছিলাম, এটা জ়াকির হুসেনের কম্পোজ়িশন।
কিন্তু এ সব সৃষ্টি যাঁর, তিনি জীবনে কখনও খ্যাতির জ্যোতিকে আমল দেননি। অহঙ্কার তো বহু দূরের কথা, গর্ব বলে কোনও বস্তুও জ়াকিরের নয়। রুক্ষ ব্যবহার, ওজন মেপে কথা বলা বা সরাসরি না বলা— কোনওটাই জ়াকিরের নয়। জীবনে কাউকে ছোট করে দেখেননি। খেতে খুব ভালবাসতেন। কেউ কোনও খাবার খেতে দিলে, জ়াকিরের তা পছন্দের খাবার না হলেও, বিষয়টা এমন ভাবে পেশ করতেন, যাতে কেউ দুঃখ না পান। জীবনের সব ক্ষেত্রেই এই অন্যকে কষ্ট না-দেওয়ার ব্রত নিয়েছিলেন জ়াকির।
শিল্পের, সঙ্গীতের সব রং, সব রস, সব গন্ধ লেগে রয়েছে উস্তাদ জ়াকির হুসেনের গায়ে। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম বা নবীনেরা কী পাবেন জ়াকিরের কাছ থেকে? কী শিখবেন? অবশ্যই সঙ্গীত, বাদন, শিল্প। কিন্তু আর এক জন জ়াকির হয়ে ওঠা তো একেবারেই সহজ নয়। কিন্তু শিল্পী জ়াকির হয়ে ওঠা চূড়ান্ত কঠিন হলেও তাঁকে অনুসরণ করতে পারলেও লাভ অল্প নয়। শ্রেষ্ঠ হয়েও নিজেকে বড় না ভাবা, বিনয়-ভালবাসা-সুভদ্র আচরণ— এই সব মানবিক শিল্পের কিছুটাও তো আমরা পেতে পারি তাঁকে অনুসরণ করে।
শেষে একটাই কথা। উস্তাদ জ়াকির হুসেন তবলার আয়না। তিনি সেই নির্মল আয়না, যেখানে ভেসে ওঠে গোটা উপমহাদেশের সংস্কৃতি, সভ্যতা, শিল্প আর পরম্পরা। তাঁর চলে যাওয়া সব দিক থেকেই যুগাবসান।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy