মিঠুন চক্রবর্তী ছবি: পিটিআই।
বাংলার আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রংবদল ও দলবদলের পালা অব্যাহত। সাধারণ নেতা-নেত্রী থেকে সেলেব্রিটি... দলবদলের খেলায় পিছিয়ে নেই কেউ। কিন্তু রবিবার ব্রিগেডের মঞ্চে মিঠুন চক্রবর্তীর বিজেপিতে যোগদান রাজ্য-রাজনীতিতে এক নতুন মাত্রা যোগ করল বলা যায়। প্রকৃত অর্থে, তিনি কোনও দলের সদস্য ছিলেন না। তবে নকশাল-বাম-কংগ্রেস-তৃণমূল বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ছত্রচ্ছায়ায় ছিলেন, সংশ্লিষ্ট দলের হয়ে রাজনৈতিক প্রচার করেছেন। তৃণমূলের মনোনয়নে রাজ্যসভার সাংসদ হয়েছিলেন। সারদা-কাণ্ডে নাম জড়ানোর পরে সেই পদ ত্যাগ করেন। নির্বাচনের ঠিক আগে তাঁর বিজেপিতে যোগদান নিয়ে সরগরম নেট-দুনিয়া। টলিউডের অন্দরেও তাঁর যোগদানকে ঘিরে রয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া।
এক সময়ের মিঠুনের সহ-অভিনেত্রী এবং এ বারে টিকিট না পাওয়া তৃণমূল বিধায়ক দেবশ্রী রায়ের মতে, ‘‘নিশ্চয়ই কোনও খারাপ লাগা রয়েছে, কোনও জায়গায় ধাক্কা খেয়েছেন। যে আশা নিয়ে দলে ছিলেন, তা হয়তো পূর্ণ হয়নি। তবে ঠিক কী কারণে রংবদল করলেন, তা আমার পক্ষে বলা সম্ভব নয়।’’ অন্য দিকে, তৃতীয় বারের জন্য শাসক দলের প্রার্থী চিরঞ্জিৎ এই রংবদলের পিছনে অভিনেতার ব্যক্তিগত সুবিধের সন্ধান পাচ্ছেন। ‘‘শুনেছি, ওঁর ছেলের নামে কেস রয়েছে। ওঁর নামেও সিবিআইয়ে মামলা ছিল। সব মিলিয়ে হয়তো বাধ্যবাধকতা তৈরি হয়েছে। উনি সুবিধে নেওয়া লোক, টিপিক্যাল পার্টি মেম্বার নন। কোনও সুরক্ষা পাওয়ার জন্য হয়তো বিজেপিতে গিয়েছেন। এ ছাড়া এই পার্টিতে যে সম্মানটা হারিয়েছেন, তা তো এখানে ফিরে পাবেন না। সেই খাতিরটা সিপিএমও করবে না। তা হলে আর কোন পার্টিতে যাবেন? যেখানে একটু খাতির পাবেন!’’
এই মুহূর্তে মিঠুনের সঙ্গে সরাসরি যদি কারও যোগাযোগ থাকে, তিনি হলেন তৃণমূল সাংসদ দেব। বাংলার একটি জনপ্রিয় চ্যানেলের রিয়্যালিটি শোয়ে তাঁরা সহ-বিচারক। মিঠুনের বিজেপিতে যাওয়া প্রসঙ্গে তাঁর মত, ‘‘মিঠুনদা বিজেপিতে যোগদান করার পরে আমার সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ কথা হয়েছে। যখন দল পরিবর্তন করেছেন, নিশ্চয়ই কিছু ভেবে করেছেন। কোন দলে থাকবেন, বা কাকে ভোট দেবেন, সেটা ওঁর ব্যক্তিগত ব্যাপার। বিরোধী দলের বলে আমি ব্যক্তিগত আক্রমণ করব না। ভাল না কি খারাপ করেছেন, সেটা উনি বুঝে নেবেন।’’ একই মত ঋতুপর্ণা সেনগুপ্তেরও, ‘‘যা করেছেন, ওঁর ব্যক্তিগত ব্যাপার।’’
তৃণমূল সাংসদ শতাব্দী রায় অবশ্য বললেন, ‘‘এত বার দল বদল করার ফলে উনি রাজনৈতিক বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছেন।’’ বাম মনোভাবাপন্ন অভিনেতা বিপ্লব চট্টোপাধ্যায় বললেন, ‘‘উনি মনে করেছেন বিজেপিতে গেলে ভাল হবে, তাই গিয়েছেন। আসলে দেশের-রাজ্যের এত লোক ভাল চাইছেন বলেই বোধহয় দেশের বা রাজ্যের এই হাল!’’
বাংলা থেকে মুম্বইয়ের প্রথম সারির নায়ক হয়ে ওঠার স্বপ্ন কেউ যদি বাস্তবায়িত করে থাকেন, তিনি মিঠুন চক্রবর্তী। রাজনৈতিক মতাদর্শ ভিন্ন হলেও, এ বিষয়ে সকলেই একমত। সেই অভিনেতা মিঠুনকেই এগিয়ে রাখতে চান পরিচালক কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়। তাঁর কথায়, ‘‘আমি মিঠুন চক্রবর্তীর ফ্যান। এখন প্রশ্ন হল, মতাদর্শগত পার্থক্য। উনি একটা সময়ে বামপন্থী মনোভাব পোষণ করেছেন। পরবর্তী কালে ডানপন্থী শিবিরে গিয়েছেন। সেটা হয়তো ওঁর মতাদর্শগত কোনও পরিবর্তন হয়েছে বা মতপার্থক্য হয়েছে। তবে অভিনেতা মিঠুন চক্রবর্তী আমার কাছে যেমন ছিলেন, তেমনই থাকবেন।’’ মিঠুনকে নিয়ে ‘নোবেল চোর’ ছবিটি বানিয়েছিলেন পরিচালক সুমন ঘোষ। তাঁর দীর্ঘ ফেসবুক পোস্টে তিনিও অভিনেতা মিঠুনেরই জয়গান গেয়েছেন।
টলিউডের আর এক পরিচালক অরিন্দম শীলের বিজেপিতে যোগদান নিয়ে জল্পনা শোনা যায়। এই প্রসঙ্গে তিনি বললেন, ‘‘মিঠুনদা আমার অত্যন্ত কাছের একজন মানুষ। তাঁকে ক্রিটিসাইজ় করতে পারব না। তবে উনি বিজেপিতে যোগদান করায় আমি বিস্মিত। কারণ একটা সময়ে উনিই আমাকে বলেছিলেন যে, ‘দিদিকে ছেড়ে যাস না’...’’
কালের নিয়মে মানুষ বদলায়, বদলায় তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি। তাঁর চেনা ‘মিঠুনদা’র সঙ্গে রবিবারের ব্রিগেডের মঞ্চে দাঁড়ানো মিঠুনকে মেলাতে পারছেন না শ্রীলেখা মিত্র। ‘‘ওঁর ছেলের ঘটনাটি যদি সত্যি হয়, তবে তো সাংঘাতিক ব্যাপার। মনে হয় নিরাপত্তার কারণেই গিয়েছেন। ‘দেবদূত’ ছবির শুটিংয়ে আমরা একসঙ্গে রান্না করেছি। নকশাল আমলের কত গল্প বলতেন। ওঁর বাইরের মোড়কটা বদলে গিয়েছে,’’ বিস্ময় শ্রীলেখার কণ্ঠে। মিঠুনের পাড়ায় এক সময়ে থাকতেন পরিচালক হরনাথ চক্রবর্তী। বিজেপিতে তিনি কতটা কাজ করতে পারবেন, তা নিয়ে সন্দিহান পরিচালক। ‘‘মিঠুনদা ভাল কাজে সব সময়ে পাশে দাঁড়ান। সুপারস্টারসুলভ অহঙ্কার ওঁর নেই। আমার ভয়, এখন যা পরিস্থিতি তাতে ওঁকে কাজ করতে দেওয়া হবে কিনা। কাজ করলে ফাটিয়ে দেবেন,’’ বললেন তিনি।
বিজেপির হয়ে মিঠুনের ভোটে দাঁড়ানো, মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী হওয়ার সম্ভাবনাকে নস্যাৎ করছেন চিরঞ্জিৎ। ‘‘আমি ওঁকে যতটুকু চিনি, ওঁর এমএলএ হওয়ার কোনও দরকার নেই। মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার যে প্রক্রিয়া, সেটাও ওঁর পক্ষে কতটা সম্ভব জানি না। আমার ধারণা, পার্টির হয়ে প্রচার করবেন।’’ নিজের ছবির সংলাপ ‘জাত গোখরো’ মঞ্চে আউড়ে মিম দুনিয়ায় সাড়া ফেলেছেন অভিনেতা। সে প্রসঙ্গে কমলেশ্বরের পর্যবেক্ষণ, ‘‘বিজেপি শিবিরের নেতাদের ভাষণে আক্রমণাত্মক ভঙ্গি থাকে। মিঠুনদার ভাষণেও ছিল। কিন্তু ওটা উপমা হিসেবেই বলেছেন বলে আমার মত।’’
শঙ্খ ঘোষের কবিতার লাইন ধার করে বললে, ‘সে ছিল একদিন আমাদের যৌবনে কলকাতা...’ সত্তরের দশকে যাঁরা মিঠুনকে দেখেছেন, অভিনেতার রাজনৈতিক বৃত্ত সম্পূর্ণ হতে দেখে তাঁরা হয়তো আজ সে কথাই বলছেন। তবে অভিনেতার মঞ্চে বাণী, ‘পিকচার অভি ভি বাকি হ্যায়...’ তাই পর্দা যতক্ষণ না পড়বে, ততক্ষণ তাঁর রাজনৈতিক ‘ডান্স’ বঙ্গ-রাজনীতি আলোড়িত করতে থাকবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy