‘নিমফুলের মধু’ ধারাবাহিকে জেঠুর চরিত্রে অভিনয় করে দর্শকের মন জয় করেছেন অভিনেতা সুব্রত গুহরায়। ছবি: সংগৃহীত।
মজার মানুষ সুব্রত গুহ রায়। গত তিন দশকে অভিনয় করেছেন নানা মাধ্যমে। থিয়েটারের পাশাপাশি বড় পর্দায় তাঁকে দেখা যায়, কিন্তু পরিচিতির বড় অংশটাই ছোট পর্দায়। কখনও বদমেজাজি পুলিশ আধিকারিক, কখনও খল চরিত্র, কখনও পরিবারের সর্বেসর্বা হয়ে ওঠার আপ্রাণ চেষ্টা করা জেঠু বা ঠাকুরদা। তবে সেই সব চরিত্রের নানা রঙের মধ্যে পরিস্ফুট হয়ে ওঠে রসিকতা। হাস্যরসের ধারায় তাঁর অনায়াস যাতায়াত। এই মুহূর্তে তাঁকে দেখা যাচ্ছে ছোট পর্দার দু’টি ধারাবাহিকে— ‘নিম ফুলের মধু’র অখিলেশ দত্ত এবং ‘পরিণীতা’য় আশুতোষ বসু চরিত্রে। আনন্দবাজার অনলাইনের মুখোমুখি অভিনেতা।
প্রশ্ন: আপনিও কি অখিলেশ দত্তের (নিমফুলের মধু) মতো খিটখিটে, বদমেজাজি?
সুব্রত: অখিলেশ দত্ত ভালমন্দে মিশিয়ে একজন রুক্ষ প্রকৃতির মানুষ। নিজে যা ভাবে, সেটাই ঠিক মনে করে। মানুষ কিন্তু এ রকমই, ভালমন্দে গড়া। আমি দেখেছি, পুরনো কলকাতার গৃহকর্তারা অনেকেই এ রকম। নিজের বুদ্ধি এবং যুক্তি পরিবারের উপর চাপিয়ে দিতেন বেশির ভাগ সময়। কিন্তু আদতে অখিলেশ মজার মানুষ। দর্শকও কিন্তু তার হম্বিতম্বিতে হেসে কুটিপাটি।
তবে, ব্যক্তিগত জীবনে আমি একেবারেই এ রকম না। আমি মানুষের সঙ্গে মিশতে, সকলকে নিয়ে থাকতে ভালবাসি। কারও উপর আমার মত চাপিয়ে দিই না। মজা করতে আমি খুব ভালবাসি। সারা ক্ষণ মজা করে কাটাই সহ-অভিনেতাদের সঙ্গে।
প্রশ্ন: আপনার স্ত্রী, ছেলেমেয়েও কি তা-ই মনে করেন?
সুব্রত: ওরা তো সেই ব্যক্তি ‘আমি’কেই চেনে, যে নিজের মতামত চাপিয়ে দেয় না। আমার ছেলেমেয়েরা ছোট পর্দায় ধারাবাহিক দেখে না। আধুনিক প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের হাতে অনেক সহজে পৌঁছয় বিদেশি ছবি। সে সবেই মজে রয়েছে তারা। বাবার কাজ দেখেছে, মাঝেমধ্যে।
কিন্তু আমার স্ত্রীর কথা বলতেই হয়। আজ আমি যেটুকু কাজ করতে পারছি তা শুধু ওঁর জন্যই। ১৯৯৮ সালে চাকরি ছেড়ে শুধু অভিনয় করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। এই সফর মোটেও সহজ ছিল না। আর সেখানে আমার পাশে থেকে সংসারের সবটা সামাল দিয়েছেন আমার স্ত্রী।
প্রশ্ন: চাকরি ছাড়লেন কেন?
সুব্রত: ভাল লাগছিল না। পূর্ণ সময়ে অভিনয় করতে চাইছিলাম। কর্পোরেট চাকরি করে সেটা করা সম্ভব নয়।
প্রশ্ন: নিয়মিত বেতনের চাকরি ছেড়ে অসুবিধা হয়নি?
সুব্রত: হয়েছে তো বটেই। ওই যে বললাম, স্ত্রী হাসিমুখে সবটা সামলে নিলেন। আর আমার ছেলেমেয়েরাও খুবই ভাল। ১২-১৪ ঘণ্টা অভিনয় করতে হত। আগে ২৪ ঘণ্টা কাজও করেছি। ওদের সঙ্গে মাঝেমাঝে দেখা হত। কিন্তু তাতে ওরা কখনও অনুযোগ করেনি। আমি যাতে ভাল থাকি, ভাল কাজ করি— সব সময় তাই চেয়েছে।
প্রশ্ন: আপনার স্ত্রী-ও কি অভিনয়ের সঙ্গে যুক্ত?
সুব্রত: পেশাদার অভিনেত্রী নন, তবে নাটকের সঙ্গে যুক্ত। ওঁর দাদা আর আমি একসঙ্গেই ‘বহুরূপী’তে অভিনয় করতাম। সেই সূত্রে ওঁদের বাড়ি যাতায়াত এবং সম্পর্ক।
প্রশ্ন: আপনার ছেলেমেয়েরা না হয় ধারাবাহিক নিয়মিত দেখে না, কিন্তু বাংলা থিয়েটার?
সুব্রত: নিঃসন্দেহে বাংলা সংস্কৃতির প্রতি নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের উৎসাহ, আকর্ষণ কম। তবে আমার ছেলেমেয়েরা থিয়েটারের কথা জানে, আগ্রহী। মেয়ে বিদেশে পড়াশোনা করে। ওখানেও ও নানা রকম অনুষ্ঠান করে।
প্রশ্ন: বাংলা ধারাবাহিকে দেখা যায় পার্শ্বচরিত্রেরা দক্ষ অভিনেতা। কিন্তু নায়ক-নায়িকার হয়তো জিভের আড় ভাঙেনি। কেন এমন হয়?
সুব্রত: এটা স্বীকার করতেই হবে বাংলা ধারাবাহিক দাঁড়িয়ে রয়েছে পার্শ্বচরিত্রের উপর। বাবা, কাকা, দাদা, মা, মাসিমা, শাশুড়ি বা খলনায়কের উপর। কিন্তু সামনে দু’জন থাকেন যাঁরা খুব মিষ্টি দেখতে। সেটাই হয়তো ধারাবাহিকের চালিকা শক্তি হয়ে উঠছে।
প্রশ্ন: এই নবাগতদের জন্য কি উপযুক্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা যায় না?
সুব্রত: অবশ্যই যায়। কয়েক বছর আগে পর্যন্ত ধারাবাহিকের মুখ্যচরিত্র, যাঁরা নবাগত, তাঁদের জন্য নিয়মিত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করাও হত। ইদানীং, বিশেষত করোনার পর সেই ধারা খানিকটা ব্যাহত হয়েছে। আসলে সকলেই ভাবেন, ‘আমি কী দিচ্ছি, আর কী পাচ্ছি’। এটা তো স্বাভাবিক। এখন কোনও ধারাবাহিকের জন্য এক জন প্রশিক্ষক নিয়োগ করতে গেলে অন্তত এক লক্ষ টাকা খরচ। প্রযোজক-পরিচালক হয়তো মনে করছেন, এই টাকাটা খরচ করার প্রয়োজন নেই। নায়ক-নায়িকার মিষ্টি মুখই তাঁদের পাথেয় হতে পারে। হয়তো হচ্ছেও তা-ই। অভিনয়টা গৌণ হয়ে যাচ্ছে।
প্রশ্ন: ঠিক এই কারণেই কি পার্শ্বচরিত্রদের বেশি মনে রাখছেন দর্শক?
সুব্রত: অবশ্যই মানুষের কাছে পৌঁছতে পারছে এই পার্শ্বচরিত্রগুলি। এই যে আমার জেঠুর চরিত্রটি, যে কোনও জায়গায় কিছু সংলাপ বললেই মানুষ চিনতে পারবেন। নতুন প্রজন্মের অভিনেত্রী অরিজিতা মুখোপাধ্যায়, এমন ভাবে গড়েছে নিজের চরিত্রকে যে ‘বাবুর মা’ বলে পরিচিত হয়ে গিয়েছে।
প্রশ্ন: চেয়েছিলেন থিয়েটারের ‘হোল টাইমার’ হতে, কিন্তু এখন বাংলা ধারাবাহিকেই অভিনয় করেন। মনে হয় না, ঠিক মতো মূল্যায়ন হল না?
সুব্রত: একেবারেই যে এমন মনে হয় না, তা নয়। আবার এমন কাজও পাই, যাতে মন ভরে যায়। এই যেমন ‘নিমফুলের মধু’। আমার অভিনয় করার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। পরিচালকের দাবি অনুযায়ী আমি সে কাজে সফলও। তাই তো জনপ্রিয়তা আসছে।
সম্প্রতি শুরু হয়েছে ‘পরিণীতা’। সেখানে আবার রাশভারী এক ঠাকুরদার চরিত্র, যিনি চান যৌথ পরিবার ধরে রাখতে। নাতি-নাতনিরা পিছনে তাঁকে ‘হিটলার’ বলে ডাকে। একেবারে ভিন্ন মেরুর চরিত্র, দারুণ লাগছে আমার কাজ করতে। আমি অভিনয় করতে ভালবাসি।
প্রশ্ন: আর লেখালিখি?
সুব্রত: আমি ধারাবাহিকের জন্য কখনও লিখিনি। মূলত ছায়াছবি আর ওয়েব সিরিজ়ের জন্যই লিখি। হ্যাঁ, সে কাজে যে পরিমাণ সময় লাগে, তা আমি বার করতে পারি না। তাই যখন সময় পাই লিখি। তার পর সেগুলো তুলে রেখে দিই। সুযোগ হলে বার করব। কারণ, আমার পেশা অভিনয়। কাহিনি নিয়ে কোনও পরিচালকের কাছে গিয়ে বসলে অন্তত একটা মাস সময় লাগবে। এই সময়টা আমি পাব কোথায়?
প্রশ্ন: এক সময় অভিনয়ের জন্য চাকরি ছেড়েছিলেন। আজ লেখালিখির জন্য অভিনয় ছাড়তে পারছেন না তত সহজে?
সুব্রত: না, পারছি না। তার কারণ দুটো। এক, আমার সংসার রয়েছে। এই অভিনয়ই আমার পেশা। দ্বিতীয়, অভিনয় আমার ভালবাসা। প্রথম ভালবাসা, যার জন্য বাঁধা মাইনের চাকরি ছেড়েছিলাম। এর পর আমার দ্বিতীয় ভালবাসা লেখালিখি, তৃতীয় পরিচালনা।
প্রশ্ন: নিয়মিত পরিচালনা করবেন?
সুব্রত: কিছু ওয়েব সিরিজ় পরিচালনা আমি করেছি। সময় পেলে আবার করব। কিন্তু এখন সময় নেই।
প্রশ্ন: বহু বছর আগে ছোটদের জন্য একটি ছবি করেছিলেন ‘দূরবীন’। ছোটদের জন্য কাজ করতে চান আপনি?
সুব্রত: ছোটদের জন্যই তো কাজ করতে চাই। আমার লেখালিখি, যা তুলে রেখে দিচ্ছি, তার অনেকটা জুড়েই ছোটরা রয়েছে। ‘দূরবীন’ একটা গোয়েন্দা গল্প, ফেলুদার আদলে। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় এবং সব্যসাচী চক্রবর্তী— দু’জনেই ছিলেন। আর ওই ছবির মুখ্য চরিত্র পুপুল, আমার নিজের ছেলে। ওর প্রথম এবং শেষ অভিনয়।
প্রশ্ন: বাংলায় ছোটদের জন্য ভাল কাজ আর কেন হয় না?
সুব্রত: ব্যক্তিগত ভাবে আমার মনে হয় বাঙালি দর্শক একটা চক্রে পড়ে যায়। একটা সময় ছিল যখন দক্ষিণী ছবির ধাঁচে মারদাঙ্গা ছবি দেখতে ভালবাসছিলেন তাঁরা। তাই তেমন ছবিই তৈরি হচ্ছিল একের পর এক। গত দেড় দশকে সম্পর্কের গল্পই ‘ইন থিং’। এখন একের পর এক সম্পর্কের গল্প নিয়ে ছবি তৈরি হচ্ছে। এর মাঝখানে শিশুরা একেবারে হারিয়ে গিয়েছে। বাস্তবেও শৈশব হারিয়ে যাচ্ছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy