শমিত ভঞ্জ।
তখনকার ভাষায় বললে, ডানপিটে। এখন, একটু ‘দাদাগিরি টাইপের’। তবে ভঞ্জদের বাড়ির ছোট ছেলেটার মতিগতি বোঝা ভার। নাটক, তবলা, ফুটবল, ভলিবল নিয়ে মেতে থাকে। তারপরেই কিছু একটা ঝামেলায় ‘অ্যাকশন’এর মুডে। বন্ধুরা একটু তটস্থও থাকে।
তখন মানে পঞ্চাশের দশক। মেদিনীপুরের তমলুকে পদুমবসান এলাকায় হরিসভার মাঠের কাছে বাড়ি ছিল ভঞ্জদের। বর্ধিষ্ণু পরিবার। পাড়ার লোকে অবশ্য ‘বুবু’ নামেই বেশি চেনেন। তমলুকের পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে বেড়ানো ছেলেটাই হবে ‘আপনজন’এর ছেনো, ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’র হরি, ‘জবান’এর বিনু, কিংবা ‘গুড্ডি’র নবীন।
তমলুকে শমিত ভঞ্জকে কাছ থেকে দেখা মানুষ অনেক। তাঁরা তাঁর ‘বুবুদা’ থেকে ‘ছেনো’য় রূপান্তর দেখেছেন। প্রতিভাবান অভিনেতার প্রস্তুতি পর্বটি তাঁরা দেখেছেন সামনে থেকে। সেই সময় শহরে গুটিকয়েক নাট্যপ্রেমীর উদ্যোগে গড়ে উঠেছে ‘বর্গভীমা নাট্য সমাজ’। কাজের ফাঁকেই নাটক নামান তাঁরা। হরিসভা মাঠের কাছে ‘কল্পতরু ফ্রেন্ডস ক্লাব’ও নাটক চর্চা শুরু করে। ক্লাবের বার্ষিক অনুষ্ঠানে গান ও নাচের সঙ্গে নাটকের অভিনয় ছিল শহরের বাসিন্দাদের কাছে অন্যতম আকর্ষণ। এখানে নাটক করতেন বুবু। ভঞ্জরা কিন্তু তমলুকের আদি বাসিন্দা নন। আদতে ঘাটালের চন্দ্রকোনার বাসিন্দা। ওকালতির সূত্রে শমিতের দাদু এসেছিলেন তমলুকে। বাবা প্রীতিময় ভঞ্জ ছিলেন ‘বাগভী ট্রান্সপোর্ট’ সংস্থার মালিক। এই সংস্থা সেই সময়ে বেঙ্গল নাগপুর রেলওয়ের রেল ও বাসের টিকিট বিক্রি করত। প্রীতিময় ও শীলাদেবীদের তিন ছেলে ও এক মেয়ে। শমিত ছেলেদের মধ্যে ছোট। জন্ম ১৯৪৪ সালের ২ জানুয়ারি। বাড়িতে গান-বাজনার চর্চা ছিল। পারিবারিক সূত্রে গান-বাজনা চর্চার সঙ্গে শমিতের অভিনয়ে ঝোঁক ছিল। স্কুলে পড়ার সময় থেকেই কল্পতরু ফ্রেন্ডস ক্লাবের নাটকে অভিনয় শুরু।
তমলুকের এই বাড়িতেই থাকতেন।
প্রথম নাটকে অভিনয় ১৯৬০-৬১ সাল নাগাদ। ‘সাঁওতাল বিদ্রোহ’ নাটকে নায়কের চরিত্রে অভিনয় করেন শমিত। তখন ১৬-১৭ বছর বয়স। পরের বছর কল্পতরু ক্লাবের অনুষ্ঠানেই ‘বর্বরবাসী’ নাটকে গুন্ডার চরিত্রে অভিনয় করেছিল। অভিনেতার ঘনিষ্ঠদের মতে, ‘আপনজন’ সিনেমায় ছেনো গুন্ডার ওই প্রাণবন্ত অভিনয়ের মূলে রয়েছে ছোটবেলার অভিনয় চর্চা। শমিতের ছোটবেলার সঙ্গী জয়দেব মালাকার। নিজেকে বুবুদার ‘চ্যালা’ বলেন। একসঙ্গে পাড়ার ক্লাবের নাটকে অভিনয়ও করেছেন। জয়দেবের কথায়, ‘‘ছোটবেলা থেকেই খুব ডানপিটে ছিল। পায়ে পা তুলে ঝগড়া করত। আবার এলাকায় কারও বিপদ হলেই সাহায্য করতে ঝাঁপিয়ে পড়ত। আমরা চার-পাঁচজন ছিলাম বুবুদার চ্যালা।’’ জয়দেবের স্ত্রী বনানীও শমিত ভঞ্জের সঙ্গে নাটকে অভিনয় করেছেন। বনানী মনে করতে পারেন, ‘‘শহরের অলস্টার ক্লাব চলন্তিকা সিনেমা হলে বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রো নাটক মঞ্চস্থ করেছিল। তাতে দাদা নায়কের চরিত্রে অভিনয় করেছিল। এছাড়া শ্রুতি নাটক করত। কলকাতায় গিয়েও নাটকের দলে অভিনয় করত।’’ সম্ভবত হ্যামিল্টন স্কুলের ছাত্র ছিলেন। কেউ আবার টাউন স্কুলের নামও বলেন।
শমিতের প্রেম পর্বের সাক্ষী বন্ধুরা। প্রেমিকা রঞ্জার পরিবার তমলুকে কংগ্রেস কার্যালয়ের পাশে একটা বাড়িতে ভাড়া থাকতেন। পড়তেন তমলুক কলেজে। দীর্ঘদিনের প্রেম। তারপর তো বিয়ে। এক সময়ে পাড়ার বুবু চলে গেলেন টালিগঞ্জের সিনেমা পাড়ায় কাজ খুঁজতে। লড়াই চলছিল পায়ের তলায় মাটি খোঁজার। সেই পর্বের কথা এখনও মনে করতে পারেন শহরের অশীতিপর বাসিন্দা মাধবকিঙ্কর চক্রবর্তী। মাধববাবু জানান, তমলুক রাজবাড়িতে ‘কেদার রাজা’ ছবির শ্যুটিং হয়েছিল। পরিচালক বলাই সেন। মাধববাবু বললেন, ‘‘বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস কেদার রাজা ছিল এক ক্ষয়িষ্ণু রাজপরিবারের কাহিনি। শ্যুটিংয়ে পুরো ইউনিট এসেছিল তমলুক শহরে। বিখ্যাত পরিচালক তপন সিংহও এসেছিলেন। তমলুক রাজবাড়ি চত্বরে শ্যুটিং হয়েছিল প্রায় একমাস ধরে। তপনবাবুরা দলবল নিয়ে ভঞ্জদের বাড়িতে উঠেছিলেন। তখনও শমিত তেমন অভিনয়ের সুযোগ পায়নি। তপনবাবু কেদার রাজায় শমিতকে পুলিশ ইন্সপেক্টর চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ দেন।’’ সিনেমায় ‘স্টারকাস্ট’ বেশ নামী। কেদার রাজার চরিত্রে অভিনয় করেন পাহাড়ি স্যান্যাল। রাজার মেয়ে লিলি চক্রবর্তী। রাজপুরোহিত অসিতবরণ। মাধববাবু বললেন, ‘‘রাজবাড়িতে শ্যুটিং দেখতে যেতাম। সেই সময় থেকে শমিতকে নিয়ে তমলুকের মানুষের আগ্রহ বাড়তে থাকে।’’ পরে ‘দত্তা’ ছবির শুটিং হয়েছিল মহিষাদল রাজবাড়িতে। শমিত বিলাসবিহারীর চরিত্রে অভিনয় করেন। তাঁর ‘স্ট্রাইকার’ ছবির শুটিং হয়েছিল তমলুক শহরের রাখাল মেমোরিয়াল গ্রাউন্ডে।
তারপর তো এক এক করে টলি-বলিউডের ছবিতে অভিনয়। তারকা জগতের আলোকবৃত্তে ঢুকে পরা। জনপ্রিয়তা। তবে তারকাবৃত্তের বাইরেও অন্য এক শমিত ভঞ্জকে পাওয়া যায়। ঘরোয়া, সাদাসিধে জীবনযাপনে অভ্যস্ত শমিত ভঞ্জ। বলছিলেন তাঁর আত্মীয়া শহরের মালিজঙ্গলপাড়ার বাসিন্দা তুহিনা সিংহ। তুহিনার কথায়, ‘‘আমরা বুবু কাকা নামেই ডাকতাম। বিখ্যাত হওয়ার পরেও বাড়িতে খুব সাধাসিধে থাকতেন। বাড়িতে পাহাড়ি স্যান্যাল, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, উৎপল দত্ত, চিন্ময় রায়, রবি ঘোষ, লিলি চক্রবর্তী, রত্না ঘোষাল ও সন্তু মুখোপাধ্যায়দের মত সব দিকপাল অভিনেতা-অভিনেত্রীরা আসতেন। ১৯৮৫ সালে আমার বিয়ের দিনও ছবির শুটিং সেরে অনেক রাতে বাড়িতে এসে আমাকে আশীর্বাদ করেছিলেন।’’ তুহিনা বালিগঞ্জে অভিনেতার বাড়িতে থেকে কলেজে পড়তেন। সহপাঠীদের কাছে কাকার গল্প করতেন। বান্ধবীরা চাইতেন বাড়ি গিয়ে বন্ধুর চিত্রতারকা কাকার সঙ্গে দেখা করতে। কিন্তু তাঁদের আসার কথা শুনলেই ত্রস্ত হয়ে পড়তেন অভিনেতা। তুহিনাকে মানা করতেন। ডাকাবুকো স্বভাবের মানুষটার এই নম্র দিকটাও ছিল, বলছিলেন তুহিনা। প্রবল ভালবাসতেন বোন কৃষ্ণাকে। কৃষ্ণা ‘জবান’ ছবিতে গানও গেয়েছিলেন। ছোট্ট চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন দাদা অমিত।
তারকা হয়ে কি বদল হয়েছিল ‘বুবুদা’র? পরিচিতরা এক বাক্যে না বলেন। কালীপুজো ও বিভিন্ন অনুষ্ঠানের সময় তমলুকে আসতেন। নিজের অভিনীত সিনেমার উদ্বোধনী ‘শো’য়ে বাড়িতে এলে গাড়িতে করে শহরের ‘রূপশ্রী’ হলে সিনেমা দেখাতে নিয়ে যেতেন আত্মীয়দের। বন্ধুদের সঙ্গে এক সময়ে আড্ডা মারতেন নিতাই ঘোড়ইয়ের ‘হ্যাপি ভ্যালি’ রেস্তরাঁয়। তমলুকে এলে বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে নিয়ে চলে যেতেন সেখানে। বাজারের ব্যাগ হাতে মেছোবাজারে (বড়বাজার) বেছে বেছে মাছ কিনছেন ‘বুবুদা’, এ দৃশ্য এখনও অনেকের মনে আছে।
ছোটবেলার শহর অভিনেতাকে মনে রেখেছে? তমলুকের বাণীপ্রসাদ কর্মকারের আক্ষেপ, ‘‘বাংলা সিনেমার ইতিহাসে উত্তমকুমারের সঙ্গে উচ্চারিত হয় শমিত ভঞ্জের নাম। কিন্তু এতদিনেও তমলুকে তাঁর কোন মূর্তি বসেনি। তাঁর নামে কোন সাংস্কৃতিক মঞ্চ গড়া হয়নি।’’ এখন সুনীল সঙ্গোপাধ্যায়ের ‘কাকাবাবু’কে নিয়ে কত সিনেমা, কত অভিনেতা। প্রথম ‘কাকাবাবু’ কিন্তু শমিত ভঞ্জ। ‘সবুজ দ্বীপের রাজা’য়।
ভঞ্জ পরিবারের ডানপিটে ছেলেটা ‘বুবুদা’, ‘ছেনো’, ‘কাকাবাবু’ হয়ে টুকরো স্মৃতিতে এখনও ছড়িয়ে রয়েছেন তমলুকে।
ছবি: ফাইল চিত্র ও পার্থপ্রতিম দাস
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy