করুণাময়ী রানি রাসমণি।
সন্ধে হতে না হতেই ড্রয়িংরুমে চায়ের কাপ হাতে সিরিয়াল দেখা বাঙালির রোজনামচা। সিরিয়াল ইন্ডাস্ট্রির অন্দরের গল্পও কম মুখরোচক নয়। তবে সব কিছু ছাপিয়ে ক্রমশই বড় হয়ে উঠেছে টেলি-পাড়ার সঙ্কটের গল্প। শিল্পী, কলাকুশলী থেকে সাপ্লায়ার্স— প্রত্যেকেরই অভিযোগ, দীর্ঘদিন ধরে পাওনা বাকি। বিশেষ দু’-একটি প্রযোজনা সংস্থার বিরুদ্ধে আঙুল উঠেছে। হঠাৎ কী এমন হল যে, পরিস্থিতি এতটা জটিল হয়ে উঠল?
গত এক বছরে...
জনপ্রিয়তা এবং ব্যবসা, দুইয়ের নিরিখেই সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিকে দশ গোল দেবে টেলি ইন্ডাস্ট্রি। অথচ গত এক বছরের মধ্যে সবটা ওলটপালট হয়ে গেল। শিল্পীরা অভিযোগ তুললেন, মাসের পর মাস প্রযোজকেরা পারিশ্রমিক বাকি রেখেছেন। দাবি আদায়ের জন্য তাঁরা ধর্মঘটও করেন। মুখ্যমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে সেই ধর্মঘট উঠলেও সমস্যা মেটেনি। প্রযোজক রানা সরকারের বকেয়ার অঙ্ক এতটাই বেড়ে যায় যে, নিজের ধারাবাহিকগুলি অন্য প্রযোজককে দিয়ে দেন তিনি। সেই বকেয়া আদায়ের প্রক্রিয়া এখনও চলছে। এর মধ্যেই আর এক প্রযোজক সুব্রত রায়ের বিরুদ্ধে পারিশ্রমিক বাকি রাখার অভিযোগ ওঠে। ‘করুণাময়ী রানি রাসমণি’-র শিল্পীরা কাজ বন্ধ রাখেন। সংশ্লিষ্ট চ্যানেল বাধ্য হয়ে শো নিজেদের আওতায় নেয়। সুব্রত রায়ের প্রোডাকশনের সব পেমেন্ট এখন সরাসরি চ্যানেলের মাধ্যমে হচ্ছে।
অন্দরকাহিনি
একটু লক্ষ করলে দেখা যাবে, যে সব হাউস ড্রয়িংরুম ড্রামা প্রযোজনা করেছে, তাদের বিরুদ্ধে টাকা বাকি রাখার তেমন অভিযোগ নেই। রানা সরকার এবং সুব্রত রায় দু’জনেই মূলত পিরিয়ড শো প্রোডিউস করতেন। সে ক্ষেত্রে সেট, প্রপ্স, মেকআপ, কস্টিউমের বাজেট বিরাট। রানার বক্তব্য, ‘‘সরকারি নির্দেশে শিল্পীরা ১৪ ঘণ্টার বেশি শুট করতে পারবে না। কিন্তু পিরিয়ড শোয়ে মেকআপ, কস্টিউমে অনেকটা সময় যায়। এ সব করতে গিয়ে এপিসোডের খরচ বেড়ে যায়। চ্যানেলের বাজেটের চেয়ে যা অনেকটাই বেশি। আমি নিজে এখনও চ্যানেলের থেকে টাকা পাই।’’
কিন্তু ১৪ ঘণ্টার নিয়মে বাকিরাও কাজ করে থাকেন। তাঁরা কী করে পারছেন? ম্যাজিক মোমেন্টসের লীনা গঙ্গোপাধ্যায় বলছিলেন, ‘‘আমাদেরও বাজেটের মধ্যেই কাজ করতে হয়। একটু কড়া হাতে ফ্লোর সামলাতে হবে। আমরা সপ্তাহে পাঁচ দিন শুট করি। তার মধ্যেই ডেলিভারি দিই। পেমেন্টও একদম ঠিক সময়ে করি।’’
এক-একটি ধারাবাহিকের জন্য এক এক রকম বাজেট চ্যানেলের। সূত্র বলছে, সুব্রতর ‘করুণাময়ী রানি রাসমণি’র জন্য এপিসোড প্রতি এক লক্ষ ৮০ হাজার টাকা বরাদ্দ ছিল। রানার বন্ধ হয়ে যাওয়া ধারাবাহিক ‘আমি সিরাজের বেগম’-এর বাজেট ছিল নাকি এপিসোড প্রতি সাড়ে তিন লক্ষ টাকা। দুই প্রযোজকেরই দাবি, এই টাকায় এত বড় প্রোডাকশন সামলানো যায় না। অন্য দিকে এ বক্তব্যও উঠে আসে যে, টাকা নয়ছয় না করলে ওই বাজেটেই কাজ করা সম্ভব। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক প্রযোজকের কথায়, ‘‘বাজেট অনুযায়ী তারাই কাজ করতে পারে না, যাদের ম্যানেজমেন্ট দুর্বল। একটি দৃশ্যে অনেক সময়ে এত বেশি শিল্পী থাকেন, যাঁদের প্রয়োজন নেই। যাঁদের পাওনা নিয়ে অভিযোগ উঠেছে, সেখানে এই সমস্যা দেখা গিয়েছে।’’
অব্যবস্থার কারণেই নাকি ভরাডুবি হয়েছিল ‘ভূমিকন্যা’ সিরিজ়ের। শুটিং করতে গিয়ে ছাড়িয়ে গিয়েছিল বরাদ্দ বাজেট। সেই চাপ সামলাতে গিয়ে অরিন্দম শীল ব্যর্থ হন শিল্পী-কলাকুশলীর পেমেন্ট দিতে। বলা হয়, অন্যান্য শোয়ের জন্য শিল্পীরা যতটা পারিশ্রমিক পেয়ে থাকেন, ‘ভূমিকন্যা’র ক্ষেত্রে সেই টাকা অনেকটাই বেশি ছিল। এ দিকে প্রত্যাশিত টিআরপি ওঠেনি। বিরাট অঙ্কের বাজেটে তৈরি হওয়া ‘মহানায়ক’-এর ভরাডুবিও একই ভাবে হয়েছিল।
চ্যানেল-প্রযোজক দ্বন্দ্ব
কোনও প্রযোজক যখন প্রথম শো শুরু করেন, তাঁকে অন্তত চার মাসের বাজেট নিয়ে নামতে হয়। প্রাথমিক সব খরচ প্রযোজকের। টেলিকাস্ট শুরু হওয়ার ৬০ দিন পর থেকে চ্যানেল পেমেন্ট শুরু করে। প্রি-প্রোডাকশনের কস্ট ধরলে, কম করে তিন-চার মাসের বাজেট থাকা প্রয়োজন প্রযোজকের। কিন্তু অনেক প্রযোজকই এই জায়গায় ব্যর্থ। চটজলদি লাভের আশায় যথেষ্ট টাকা না নিয়েই নেমে পড়েন অনেকে। এ প্রশ্নও ওঠে, আর্থিক বেনিয়মের অভিযোগ যে প্রযোজকের বিরুদ্ধে উঠেছে, তাঁকে কী করে বারবার কাজ দেয় চ্যানেল?
পেমেন্ট বাকি থাকলেই প্রযোজকেরা চ্যানেলের দিকে আঙুল তোলেন। অনেক ক্ষেত্রে তা সত্যিও বটে। টিআরপি-র বিচারে এগিয়ে থাকা এক চ্যানেলের পেমেন্ট অনিয়মিত বলে শোনা যায়। এক চ্যানেল মাসের ৭ এবং ২২ তারিখে পেমেন্ট করে। আর একটি চ্যানেলের টাকা আসে মাসের ১৫ আর ৩০ তারিখে। মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে, মাসের ১৫ তারিখের মধ্যে প্রযোজককে সকলের পারিশ্রমিক দিয়ে দিতে হবে। কিন্তু মাসখানেক আগে আর্টিস্ট ফোরাম জানায়, কিছু প্রযোজকের আর্থিক সমস্যার জন্য অগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসের পেমেন্টের দিন পিছিয়ে ২২ তারিখ করা হচ্ছে। সূত্রের খবর, প্রভাবশালী এক প্রযোজক আর্থিক সমস্যায় পড়েছিলেন বলেই, ফোরাম তড়িঘড়ি ওই সিদ্ধান্ত নেয়।
বকেয়া আদায় নিয়ে এত টালবাহানার কারণে চ্যানেল নিয়মেও কিছু বদল এনেছে। অনেক অভিনেতা-অভিনেত্রীর সরাসরি চ্যানেলের সঙ্গে চুক্তি ছিল, যা আর্থিক কারণে সম্প্রতি বাতিল করেছে চ্যানেল।
আর্টিস্ট ফোরামের দাদাগিরি?
প্রযোজক আর আর্টিস্ট ফোরামের সমীকরণও কম জটিল নয়। মাঝেমধ্যেই ফোরাম থেকে শিল্পীদের মেসেজ করে জিজ্ঞেস করা হয়, তাঁরা ঠিকমতো পারিশ্রমিক পাচ্ছেন কি না। এতেই ক্ষোভ প্রযোজকদের। এক প্রযোজকের কথায়, ‘‘কবে এবং কত টাকা দেওয়া হবে, তা নিয়ে শিল্পীর সঙ্গে প্রযোজকের চুক্তি থাকে। এর মধ্যে আর্টিস্ট ফোরাম নাক গলাচ্ছে বলেই সমস্যা হচ্ছে।’’ তার উপরে পাওনা বাকি রাখার প্রতিটি ঘটনার ক্ষেত্রে ফোরাম নিরপেক্ষ নয়। রানা সরকারের শোগুলি নিয়ে ফোরাম যতটা সক্রিয় ছিল, ‘ভূমিকন্যা’র ক্ষেত্রে ততটা তৎপরতা দেখা যায়নি।
সুব্রত রায়কে বকেয়া মেটানোর দিন নির্দিষ্ট করে দিয়েছিল ফোরাম। প্রযোজক কিছু টাকা মিটিয়েছেন। বাকি রাখা টিডিএসও অনেকটা জমা দিয়েছেন, জানালেন আর্টিস্ট ফোরামের সাধারণ সম্পাদক অরিন্দম গঙ্গোপাধ্যায়।
টাকা বাকি রাখার অভিযোগ রয়েছে আরও কয়েক জন প্রযোজকের বিরুদ্ধে। কিন্তু শক্তিশালী খুঁটির জন্য প্রকাশ্যে কেউ তাঁদের নাম করছেন না। ছোট-বড় দুই পর্দাতেই কাজ করে এমন এক নামী সংস্থা ২-৩ মাস পিছিয়ে পেমেন্ট করে। এক নামী অভিনেতা প্রযোজিত কিছু ওয়েব শোয়েও পেমেন্টে সমস্যা রয়েছে।
ছোট পর্দার আড়ালে অনেক সমস্যাই ঢাকা। অপেক্ষা সমাধানসূত্রের।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy