সন্দীপ্তা সেন।
‘অন্তরগ্লানি সংসারভার পলক ফেলিতে কোথা একাকার’’— এই ছিল, এই নেই। মানুষ আজ অবধি যে রহস্যগুলির কোনও সমাধান করতে পারেনি, তার একটি নিঃসন্দেহে মৃত্যু।রহস্যের চেয়েও মৃত্যুর সঙ্গে যা চিরন্তন ভাবে জড়িয়ে আছে তা আসলে এক অপার শূন্যতার বোধ, শূন্যস্থানের ক্ষত। তবু, নিত্য দিনযাপনের ভারও যখন হয়ে ওঠে দুর্বহ, অনেকেই নিস্তারের পথ খোঁজেন মৃত্যুতেই। আত্মহত্যার প্রবণতা বোধ হয় কয়েক গুণ বেড়ে গিয়েছে অতিমারির পরিস্থিতিতে। বেকার যুবক, কর্মচ্যুত কৃষক থেকে সফল অভিনেতা— অনেকেই বেছে নিয়েছেন এই অন্তিম পথ। শুক্রবার অর্থাৎ ১০ সেপ্টেম্বর, মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে সারা বিশ্বে পালিত হচ্ছে আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস। আনন্দবাজার অনলাইন থেকে সেই সূত্রে যোগাযোগ করা হয়েছিল সন্দীপ্তা সেনের সঙ্গে। ছোট পর্দার জনপ্রিয় এই অভিনেত্রীর আর এক পরিচয় তিনি একজন পেশাদার মনোবিদ। কী বললেন তিনি?
আত্মহত্যা নিয়ে জনমানসে অনেক ধারণাই প্রচলিত, কিন্তু তার সব ক’টিই সঠিক নয়। যেমন অনেকে মনে করেন যে, দীর্ঘ দিন ধরে কোনও সমস্যায় ভোগার পর কেউ আত্মহত্যা করার কথা ভাবেন। এ প্রসঙ্গে সন্দীপ্তা বলেন, ‘‘প্রত্যেকে আত্মহত্যাপ্রবণ হয় না, কিছু কিছু মানুষের সেই প্রবণতা বেশি থাকে।’’ আত্মহত্যা নিয়ে সচেতনতা তৈরি করার ক্ষেত্রে প্রথমেই যে বিষয়টির উপর সন্দীপ্তা জোর দিলেন, তা হল আত্মহত্যার বিভিন্ন ধরন বোঝা। মানুষ সচরাচর আত্মহত্যাকে একটি ছাঁচে ফেলে দেখতে অভ্যস্ত। কিন্তু সব ক্ষেত্রে দীর্ঘকাল অবসাদে ভোগার পরেই যে হঠাৎ জীবন শেষ করার কথা মনে হবে, এমন নয়। এর কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে অভিনেত্রী-মনোবিদ বলেন যে, ‘‘বিভিন্ন ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছ্ কিছু কিছু মানুষ ভীষণ ইম্পালসিভ হয়ে পড়ে্ন কিছু কিছু সময়।’’ মূলত কোনও ঘটনার প্রেক্ষিতেই তখন এমন হঠকারী সিদ্ধান্ত নেওয়ার ঝুঁকি নেন তারা, বলছেন তিনি। কখনও সেই আত্মহত্যার চেষ্টা সফল হয়, কখনও হয় না। আবার অনেক সময় আত্মহত্যার প্রবণতা আদৌ জীবনে ইতি টানার ইচ্ছা থেকে আসে না। সন্দীপ্তার মতে, আত্মহত্যা করতে গিয়ে কেউ তাকে বাঁচিয়ে নেবে, এমন এক ক্ষীণ আশা থেকে অনেকে এই দিকে পা বাড়ান। সে ক্ষেত্রে এই প্রবণতা আসলে মৃত্যুর উদ্দেশ্যে নয়। বরং জীবনের প্রতি আশ্বস্ত হতে, চারপাশের মানুষের কাছে নিজের গুরুত্ব সম্পর্কে বোঝাতে এবং বুঝতে এই কাজ করে বসেন তাঁরা।
আর একটি বিষয়ও এ ক্ষেত্রে লক্ষণীয়। সন্দীপ্তা বলছেন, ‘‘অনেক সময় দেখা যায় যে, যে মানুষটা বার বার বলছে আমি জীবনটা শেষ করে দেব, আমার বাঁচতে ভাল লাগছে না, অধিকাংশ সময় দেখা যায় সেই মানুষটি আত্মহননের চেষ্টা করতে পারছে না। সে যখনই বলে দিচ্ছে তার ইচ্ছের কথা, তার মানেই সে মনের ভাব প্রকাশ করতে চাইছে, করতে পারছেও।’’ বলার মাধ্যমে এই প্রবণতা অনেকটাই কমে যায়। তবে অভিনেত্রীর কথায় ‘‘আর এক ধরনের মানুষ হয়, যারা বলতে পারে না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায়, যারা বলতে পারে না বা যাদের দেখে মনেই হয়নি যে, তারা আত্মহত্যা করতে পারবে, সেই মানুষটিই এই পথ বেছে নেয়।’’ এই সব ক্ষেত্রে আমরা খুবই অবাক হয়ে ভাবি যে, কী এমন ঘটল যার জন্য এত বড় এক সিদ্ধান্ত নিতে হল তাকে? সন্দীপ্তা বলছেন, ‘‘এই প্রশ্নটা কিন্তু যারা মারা যায়, তাদের সঙ্গেই চলে যায়।’’ উত্তর জানার উপায় থাকে না অন্যদের।
আত্মহত্যাপ্রবণ যিনি হয়ে পড়েন, তাঁর প্রিয়জনদের ওপরেও অনেকটা দায়িত্ব বর্তায়। সেই প্রসঙ্গে সন্দীপ্তা বলছেন, ‘‘ব্যবহার-ভিত্তিক যদি কোনও পরিবর্তন হয়, তখন সচেতন হতে হবে।’’ সমস্যা বাড়লে অবশ্যই পেশাদার কোনও মনোবিদের কাছে যাওয়া উচিত। যদি দীর্ঘদিন ধরে কারও আত্মহত্যার চিন্তা আসে, তা হলে সতর্ক হতে হবে। আর কেউ যদি কোনও ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ভীষণ ভেঙে পড়ে কয়েক মুহূর্তের জন্য, আত্মহত্যার কথা বলতে থাকে অনবরত, সে ক্ষেত্রে সন্দীপ্তা পরামর্শ দিচ্ছেন তার ভাবনার অভিমুখ ঘুরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতে হবে। সবচেয়ে ভাল হয় যদি তার কাছে সশরীরে যাওয়া যায়। সন্দীপ্তার কথায়, ‘‘সে যেন একা না থাকে সেই সময়। একটা মুহূর্তের জন্যও তাকে যেন একা না ছাড়া হয়।’’ তবে বার বার তিনি জোর দিচ্ছেন নিজেদের হাতে সমস্ত দায়িত্ব না নিয়ে পেশাদার মনোরোগ বিশেষজ্ঞর পরামর্শ নিতে। তিনি বলছেন, ‘‘লকডাউনের সময়, আমায় বলতেই হচ্ছে, সবাই এমন ভাবে কথা বলছিলেন যেন সঙ্কলেই মনোবিদ হয়ে গিয়েছেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায় যে আমরা ভুল কথা অনেক সময় বলে ফেলি।’’
অবসাদের অন্তিম পর্যায়ে পৌঁছে গেলে অনেকে মনে করেন যে, আর কোনও দরজাই খোলা নেই তাঁদের জন্য। নতুন দরজা খোঁজার মতো মনের অবস্থাও সেই সময় থাকে না। তবু, সন্দীপ্তা বলছেন, ‘‘বিশ্বাস রাখা উচিত যে, কোনও একটা দরজা খোলা আছে। কারণ কোনও মানুষের জীবনে সব ক’টা দরজা এক সঙ্গে বন্ধ হয়ে যেতে পারে না। মানুষ বুঝতে পারে না বা মানুষ খুঁজতে পারে না।’’ সন্দীপ্তা মনে করেন, এক জন পেশাদার মনোরোগ বিশেষজ্ঞর কাজ ঠিক এই খানেই— অবসাদে ধুঁকতে থাকা এক মানুষকে নতুন দরজা চিনিয়ে দেওয়া, আবার তাঁকে জীবনমুখী করে তোলা। এ ক্ষেত্রে মা-বাবার ভূমিকাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সন্দীপ্তা বলছেন, অতিমারিতে শিক্ষা এবং চাকরির এই মন্দার বাজারে অবসাদ আসা খুব স্বাভাবিক, সে ক্ষেত্রে সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন মা-বাবাই। সন্দীপ্তার কথায়, ‘‘তাঁদের বলতে হবে, সব সময় সাফল্য নাও আসতে পারে। ব্যর্থতাও গুরুত্বপূর্ণ।’’
অতিমারিতে অদ্ভুত এক শূন্যতা গ্রাস করেছে আমাদের সকলকেই। একাধিক প্রিয়জনের মৃত্যু, ভবিষ্যৎ সম্পর্কে অনিশ্চয়তা জীবন থেকেই আমাদের বিশ্বাসের ভিত নাড়িয়ে দিয়েছে অনেকাংশে। সামাজিক দূরত্বের বিধিনিষেধ বাড়িয়েছে সার্বিক বিচ্ছিন্নতাবোধ। এখনও পরিস্থিতি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক হয়ে যায়নি আগের মতো, উদ্বেগ তাই থেকেই যাচ্ছে। সন্দীপ্তা বলছেন, এমতাবস্থায় কোনও মতেই আত্মবিশ্বাস হারালে চলবে না। ‘‘আমার দ্বারা কিছু হবে না, এই কথাটা কখনই নিজেকে বলা উচিত নয়,’’ বার বার জোরের সঙ্গে বললেন তিনি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy