সীমানা পেরিয়ে শঙ্খচিল উড়তে উড়তে চলে যায় অনেক দূরে।
আর মাটিতে দাঁড়িয়ে থাকে সীমান্তের কাঁটাতার।
‘ফ্যান’ এবং ‘জাঙ্গল বুক’য়ের পাশাপাশি মুক্তিপ্রাপ্ত ‘শঙ্খচিল’ যে মানুষের মন এই ভাবে ছুঁয়ে যাবে এটা প্রথম দিকে ভাবতে পারেননি পরিচালক গৌতম ঘোষও।
আমরা এক ভাষায় কথা বলি, একই রকম জীবনযাত্রা। তবু দুই দেশ এক ঐতিহাসিক ভুলে ভাগ হয়ে গিয়েছে। ভারত আর বাংলাদেশ। মাঝখানে নিষেধের বেড়া। আমরা শঙ্খচিলের মতো পেরোতে পারি না সেই কাঁটাতার। এই মানবিক বক্তব্যই গৌতম ঘোষের ‘শঙ্খচিল’ ছবিকে মানুষের কাছাকাছি নিয়ে এসেছে। দেশ ভাগের যাতনা জল এনেছে আবার দর্শকের চোখে।
ছবির এই জনপ্রিয়তার একটা বড় কারণ প্রসেনজিতের হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া অভিনয়, একটা অসাধারণ গল্প, অনবদ্য পরিচালনা। এমনটাই মনে করেন ছবির অন্যতম প্রযোজক মৌ রায় চৌধুরী। কোনও কোনও দর্শক হল থেকে বেরোতে বেরোতে বলছিলেন, মুন্তাসির চৌধুরী বাদলের চরিত্রে প্রসেনজিতের অভিনয় ‘মনের মানুষ’য়ে লালনের অভিনয়কেও ছাপিয়ে গিয়েছে নাকি। এ কথা শুনে প্রসেনজিৎ বললেন, ‘‘আমি আমার সেরাটা দেওয়ার চেষ্টা করেছি এই ছবিতে। সংলাপ কম থাকলেও কোনও কোনও চরিত্রে প্রচুর স্তর থাকে। বাদলের চরিত্রটার মধ্যেও অনেক স্তর আছে। আমি সেই গভীর জায়গাগুলোকে ছোঁয়ার চেষ্টা করেছি। গৌতমদা (ঘোষ) বলেছিলেন, ‘মনের মানুষ’য়ের পরে যদি কোনও চরিত্র দিতে হয়, তা হলে অনেক ভেবে চিন্তে তাকে সৃষ্টি করতে হবে।’ সেই মতোই উনি বাদল চরিত্রটাকে অনেক ভেবেচিন্তেই তৈরি করেছেন। আমি এখন এমন সব ছবিতেই কাজ করতে চাই যেটা অনেক দিন থেকে যাবে।’’
বাংলাদেশ থেকে মেয়ে রূপসাকে (সাঁঝবাতি) দুরারোগ্য অসুখের জন্য চিকিৎসা করাতে কলকাতায় নিয়ে আসে ছবির নায়ক মুন্তাসির চৌধুরী বাদল (প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়) এবং তার স্ত্রী লায়লা (কুসুম শিকদার)। কলকাতা শহর, যেখানে শুকনো গাছে উড়ে বেড়ায় অজস্র কাক। শহরের রুক্ষ, রূঢ় পরিবেশে হারিয়ে যায় বাবার আর্তি, মায়ের কান্না। তাদের হাহাকার মিশে যায় কাকেদের কর্কশ চিৎকারে। রাস্তায় পড়ে থাকা নিকাশি পাইপের অতলান্ত গভীরে যেন ঢুকে যায় বাদলের জীবন। তার পরেও বাদল স্বপ্ন দেখে।
এই ভাবেই ‘শঙ্খচিল’ এক মানুষের দুরন্ত উড়ানের গল্প বলে। যে গল্পের উৎসে রয়েছে পরিচালক গৌতমের কিছু অভিজ্ঞতা। ২০১৪ সালে দুই বাংলার সীমান্ত রক্ষীদের একটি যৌথ উৎসবে গিয়ে বাংলার দু’পারের মানুষজনের জীবন নিয়ে কিছু গল্প শোনেন তিনি। যে গল্পগুলোয় হিন্দু-মুসলমান বিভেদের ঊর্ধ্বে বাঙালির একটা সার্বিক জীবনের ছবি উঠে এসেছিল তাঁর কাছে। ‘‘তখনই ঠিক করি ধর্মের বিভাজনের বাইরে দুই বাংলায় যে বাঙালি ছড়িয়ে আছে তাঁদের নিয়ে একটা ছবি করব। এবং চেষ্টা করব সীমান্তের কাঁটাতারের বেড়াটাকে মুছে দেওয়ার। সেই জন্যই এই ছবি বানানো। আমার মনে হয় ছবির মানবিক দিকটাই দর্শকদের আকৃষ্ট করছে। আরও মনে হয় ‘শঙ্খচিল’য়ের রূপক ভাবনাটা দর্শকদের ভাল লাগছে। এই ছবিতে রূপসার চরিত্রটা তো মুক্ত শঙ্খচিলের মতোই। যে কিনা সব সীমানা পার হয়ে মুক্ত আকাশে উড়ে যেতে চায়, রূপসার মধ্যে একটা উচ্ছ্বাস আছে, যেটা শঙ্খচিলের উড়ানের মতোই দুরন্ত,’’ বলছেন গৌতম।
ভারত বাংলাদেশ যৌথ প্রযোজনায় জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্ত শ্রেষ্ঠ বাংলা ছবি ‘শঙ্খচিল’য়ের অন্যতম প্রযোজকও প্রসেনজিৎ। কেন প্রযোজনায় গেলেন? ‘‘এই ছবিটা এতটাই ভাল, যে আমার মনে হয়েছিল ছবিটার খানিকটা মালিকানা আমারও থাক। আমি এই ছবিটাকে আন্তর্জাতিক উৎসবগুলোতে নিয়ে যাবার পরিকল্পনাও করছি।’’
ছবি হিট করার পেছনে আর একটা বড় কারণ আছে বলে মনে করছেন ট্রেড অ্যানালিস্ট পঙ্কজ লাডিয়া। তিনি বলছেন, ‘‘গত সপ্তাহের শুক্র, শনি, রবি প্রতিটা হল ৭৫% ভরা ছিল। দর্শকদের সঙ্গে কথা বলে বুঝেছি এর একটা বড় কারণ সিনেমাটোগ্রাফি। অসাধারণ ভাবে দেখানো হয়েছে বাংলাদেশের প্রকৃতি।’’
ইছামতী নদী, কুয়াশা ভরা আকাশ, মেঠোপথ, জলজঙ্গল, পাখ-পাখালি— সবই যেন জলছবির মতো ফুটে উঠেছে গৌতম ঘোষের পুত্র ঈশান ঘোষের ক্যামেরায়। সেই সঙ্গে এসেছে বাক্স প্যাঁটরা মাথায় উদ্বাস্তুদের চেনা ছবি। ছবির সঙ্গে মিশে গিয়েছে সব হারানোর বেদনা। ‘‘এই বেদনা বাঙালির খুব চেনা। দশটার মধ্যে ন’টা বাঙালি পরিবার দেশভাগের যন্ত্রণার শিকার। ছিন্নমূল বাঙালি আজও দেশভাগ নিয়ে ছবি হলে তার সঙ্গে একাত্ম বোধ করে। বেদনার সেই একাত্মতা তৈরি হয়েছে ‘শঙ্খচিল’য়ের সঙ্গেও,’’ বলছেন প্রসেনজিৎ।
কাঁটাতারে রক্তাক্ত হওয়ার পাশাপাশি এই ছবির উপস্থাপনায় রয়েছে কাব্যিক মেজাজ। প্রায় প্রতিটা দৃশ্য কবিতা হয়ে উঠেছে যেমন, তেমনি চরিত্রের মুখে মুখে উচ্চারিত হয়েছে বাংলাকে ঘিরে জনপ্রিয় সব কবিতা। রয়েছে অসাধারণ সব সংলাপ যা কিনা কখনও কখনও দৈনন্দিন বেঁচে থাকার বাইরে গিয়ে কবিতার মতো শোনায়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy