Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Soumitra Chatterjee

উত্তমকুমার হয়ে ওঠেননি, কিন্তু বেলাশেষে তিনি সৌমিত্র

কেবল শারীরিক ভাবে বেঁচে থাকা ছিল তাঁর কাছে মূল্যহীন। সৃষ্টির সব ক্ষেত্রেই মগজাস্ত্রের আলোকিত নির্মাণ রেখে গেলেন তিনি।

সৃষ্টির সব ক্ষেত্রেই মগজাস্ত্রের আলোকিত নির্মাণ রেখে গেলেন তিনি।

সৃষ্টির সব ক্ষেত্রেই মগজাস্ত্রের আলোকিত নির্মাণ রেখে গেলেন তিনি।

স্রবন্তী বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১৫ নভেম্বর ২০২০ ১২:৩০
Share: Save:

চলে গেলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়
তিনি পছন্দ করতেন না উৎসবের পর বিসর্জনের দিন। ছোটবেলায় জলঙ্গী নদীর পাড়ে বিসর্জনের কোলাকুলির মাঝেও বিসর্জিত প্রতিমার মুখে অনিবার্য ‘শেষ’ সবকিছু থেকে পালিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে জাগিয়ে রেখেছিল তাঁর মনে। পুরনো সেই ইচ্ছেপূরণে ছুট দিলেন বাঙালির অহংকার সৌমিত্র।

লম্বা ছুট! একবার বিসর্জনের কথা বলতে গিয়ে বলেছিলেন তিনি, “আমার মধ্যে বিসর্জনের অন্ধকার রয়েছে। যেটা এক আততায়ীর মতো বসে আছে। সে আর আমাকে ধরতে পারবে না। অতএব পালাও। দে ছুট, দে ছুট!’’

নিজের সঙ্গে প্রায়ই কথা বলতেন ‘অপু’। পৃথিবী থেকে সরে যাওয়ার আগে প্রশ্ন রেখেছিলেন নিজের কাছে, “এই যে এত কিছু করলে। এ সব কেন? তুমি পাশ দিয়ে গেলে ওই যে ছেলেগুলো আজও চিৎকার করে, দ্যাখ-দ্যাখ, স-উ-মি-ত্র! স-উ-মি-ত্র যাচ্ছে, তার জন্য তো নয়। এটা নিশ্চয়ই লক্ষ্য ছিল না? আমি তো চেয়েছিলাম, আমি হেঁটে গেলে লোকে বলবে, ওই যে যাচ্ছে! ওর মতো অভিনয় কেউ করতে পারে না। আদারওয়াইজ এই জীবনের কী মানে? মানুষের কী উপকার করতে পারলাম? তখন নিজেকে বোঝাই, অভিনয়ের মাধ্যমে যেটুকু আনন্দ বিতরণ করতে পেরেছি, সেটাও তো এক অর্থে মানুষের সেবা। সেটাও তো একটা উপকার।’’

লাইফ ইজ দি আনসার টু লাইফ। বাঙালির সংস্কৃতি প্রবহমানতার ইতিহাসে থেকে গেল তাঁর জীবন। মনে করতেন সৃষ্টি-সংস্কৃতি-নির্মাণের মধ্যে যে মানুষ নেই সে মৃতপ্রায়। কেবল শারীরিক ভাবে বেঁচে থাকা ছিল তাঁর কাছে মূল্যহীন। সৃষ্টির সব ক্ষেত্রেই মগজাস্ত্রের আলোকিত নির্মাণ রেখে গেলেন তিনি।

সত্যজিতের সঙ্গে তাঁর মানসপুত্রের আলাপ ১৯৫৬ সালে। যাঁর পরিচালনায় মোট ১৪টি ছবিতে কাজ করেছেন সৌমিত্র। ফাইল চিত্র।

নাহ্, উত্তমকুমার হয়ে ওঠেননি তিনি। দেব বা অন্যান্য তারকার মতো কমার্শিয়াল ছবিতে দাপিয়ে কাজ করেছেন এমনও নয়। তবু বেলাশেষে তিনি সৌমিত্র! তাঁর একমাত্র সম্পদ ‘অ্যাকাডেমিক ইনটেলিজেন্স’। অভিনয়ে বুদ্ধির সংযত ঝলক। ওই মগজ দিয়েই শিখেছিলেন তিনি সিনেমার লাগসই মাপ। ক্যামেরার সামনে অবিচল থাকার বোধ। বাংলার আর কোন অভিনেতা স্বাভাবিক আলাপে ‘প্রতিস্পর্ধী’, ‘মনোগঠন’, ‘দার্ঢ্য’, ‘দ্বিত্ব’ বা ‘বিদ্যাবত্তা’র মতো শব্দ ব্যবহার করেন? কার বাচনভঙ্গিতে থাকে গভীর অধ্যয়নের ছায়া? কখনও তিনি রবীন্দ্রনাথের ‘রাজা’ আবার কখনও সত্যজিৎ রায়ের প্রদোষচন্দ্র মিত্র। ‘ময়ূরবাহন’ থেকে ‘ময়ূরাক্ষী’। ‘ক্ষিদ্দা’ থেকে ‘উদয়ন পণ্ডিত’। বাঙালি তাঁকে ঘিরে সব আশা দু’হাত ভরে মিটিয়েছে।

আরও পড়ুন: প্রয়াত সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, চল্লিশ দিনের লড়াই শেষ একটু আগে

সৌমিত্র একই সঙ্গে অভিনেতা, নট ও নাট্যকার, বাচিক শিল্পী এবং কবি। তার চিত্রশিল্পী পরিচয় অনেককে মুগ্ধ করলেও তিনি নিজে তাঁর ছবি আঁকা নিয়ে বরাবর সংশয়ী ছিলেন। একসময় ‘এক্ষণ’ সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনার কাজেও গভীরভাবে যুক্ত ছিলেন সৌমিত্র । সেই কাজে তাঁর পাশে ছিলেন তাঁর ‘মানসপিতা’ সত্যজিৎ। তবে অভিনয়ই তাঁর রক্তে, স্মৃতিতে, জীবনের রোজনামচায়। বলেছিলেন, “সেই শৈশবকাল থেকে আজ অবধি অভিনয় ছাড়া অন্যকিছু ভাবিনি। অভিনয়টা সবসময় বুকের মধ্যে লালন করতাম। অন্য যা কিছু করেছি সবই ছিল ভালোলাগার বহিঃপ্রকাশ।”

গোড়ার কথা অবশ্য অন্য।

শুধু ছবি আঁকা ঘিরে সংশয় নয়, চেহারা নিয়ে আশৈশব হীনন্মন্যতা ছিল সৌমিত্রের। খুব সঙ্কুচিত বোধ করতেন। ছোটবেলায় দীর্ঘ ৬৩ দিন টাইফয়েডে ভুগে হাঁটতে ভুলে গিয়েছিলেন। সুস্থ হওয়ার পর নতুন করে হাঁটা শিখতে হয়েছিল। ‘আমাকে লোকে নেবে তো?’ এই ভীতি, শঙ্কা এবং প্রশ্ন ‘অপুর সংসার’-এ আবির্ভাব পর্যন্ত তাঁকে তাড়া করেছে। একজন পারফর্মার হিসাবে ছটফটিয়ে উঠত তাঁর মন। তাই সেলুলয়েডের পাশাপাশিই মঞ্চে, সাহিত্যে, গানে নিজের অন্তরের ক্ষুধা মিটিয়ে ফিরেছেন তিনি।

নিজের অভিনয় শুরুর দিনগুলো নিয়ে তিনি নিজেই বলেছিলেন, “বাবা সংস্কৃতিমনা মানুষ ছিলেন। অভিনয় ও আবৃত্তির প্রতি ঝোঁক ছিল। কিন্তু তখন অভিনয়কে পেশা হিসেবে নেওয়ার প্রশ্ন ওঠেনি। সে কারণেই হয়তো বেঁচে থাকার অবলম্বন হিসেবে ওকালতি পেশায় নিযুক্ত ছিলেন। কিন্তু একান্ত নিমগ্নতায় বাবাকে অভিনয় আর আবৃত্তিটাই করতে দেখেছি। এ সব দেখেই এক সময় অভিনয় ও আবৃত্তির প্রতি আগ্রহ বাড়ে আমার।’’ বাবা সৌমিত্রকে বোঝাতেন কী ভাবে অভিনয় করতে হয়। আবৃত্তি করতে হয়। এ ভাবে চিন্তার ক্রমাগত উৎকর্ষতায় পরবর্তীকালে কলকাতায় শিশিরকুমার ভাদুড়ির অভিনয় দেখে আগ্রহ বাড়ে। কিন্তু সেখানেও সংশয়, “আপনারা নিশ্চয়ই এই প্রতিষ্ঠিত সৌমিত্রকে দেখে ভাবছেন, এমন একজন লোকের অভিনয়ে আসার ক্ষেত্রে হীনন্মন্যতা কেন? কারণ, ছেলেবেলায় আমি দেখতে তেমন সুদর্শন ছিলাম না। ভাবতাম সংকোচ ও রুগ্ন দেহ নিয়ে কী ভাবে আমি এই পথ পাড়ি দেব?” মনে হয় সেই হীনন্মন্যতাই তাঁর কাজের রাস্তাকে আরও লম্বা করেছে। আরও কাজ। আরও কাজ। আরও। দেখা গেল অভিনেতা সৌমিত্র, লেখক সৌমিত্র, নাট্যকার সৌমিত্র, কবি সৌমিত্র, গায়ক সৌমিত্র, একলা ঘরে নিজের সঙ্গে কথা বলার সৌমিত্রকে। জীবনের ধুলোবালিতে ঘুরতে থাকলেন তিনি।

সৃষ্টি-সংস্কৃতি-নির্মাণের মধ্যে যে মানুষ নেই সে মৃতপ্রায়। কেবল শারীরিক ভাবে বেঁচে থাকা ছিল তাঁর কাছে মূল্যহীন। ফাইল চিত্র।

জন্ম ১৯৩৫ সালে। কলকাতার মির্জাপুর স্ট্রিটে। ছেলেবেলা কেটেছিল ‘ডি এল রায়ের শহর’ কৃষ্ণনগরে। মা আশালতা চট্টোপাধ্যায়। গৃহবধূ। বাবা মোহিত চট্টোপাধ্যায়। পেশা ওকালতি। নেশা শখের থিয়েটারে অভিনয়। নদিয়া থেকে হাওড়া। হাওড়া জেলা স্কুলে পড়াশোনা। তারপর সিটি কলেজ থেকে বাংলার স্নাতক। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর। হাইস্কুল থেকেই অভিনয় শুরু। সত্যজিতের সঙ্গে তাঁর মানসপুত্রের আলাপ ১৯৫৬ সালে। যাঁর পরিচালনায় মোট ১৪টি ছবিতে কাজ করেছেন সৌমিত্র। কথিত যে, সৌমিত্র–সত্যজিতের অভিনেতা–পরিচালকের রসায়ন বিশ্ব সিনেমার ক্যানভাসে তোশিবো মিফুনে–আকিরা কুরোসাওয়া, মার্সেলো মাস্ত্রিওনি–ফেদেরিকো ফেলিনি, রবার্ট ডি নিরো–মার্টিন স্করসিসি, লিওনার্দো ডি ক্যাপ্রিও–মার্টিন স্করসিসির কেমিস্ট্রির সঙ্গে তুলনীয়।

‘অশনি সংকেত’-এর শুটিংয়ের আগেই বীরভূমের গ্রামে হাজির হয়েছিলেন সৌমিত্র। সত্যজিতের সঙ্গে। সেখানকার মানুষজন আর তাদের জীবনযাপন দেখার ইচ্ছে নিয়ে। সত্যজিৎ গিয়েছিলেন নিজের অভ্যাসবশত লোকেশন খুঁটিয়ে দেখতে। আর সৌমিত্র নিজের নোটবুকে নানা ধরনের নোট নিচ্ছিলেন। গ্রামের লোকের ‘কমন ম্যানারিজম’, কী ভাবে তারা গা চুলকোয়, হাঁটে, কাঁধে গামছা রাখে, উবু হয়ে বসে ইত্যাদি। সঙ্গে নিজের কিছু চিন্তাভাবনাও লিখে রাখছিলেন। যা একজন অভিনেতার কর্মপদ্ধতির পরিচয় দেয়। পরিচয় দেয় মানসিকতারও। লোকেশন দেখার সময় লিখছেন, ‘অদ্ভুত সব গ্রাম— সুন্দর...’। আবার পরে যখন শুটিং করতে যাচ্ছেন, তখন লিখছেন ‘সামনে অনাহার। এই কোমল শ্যামল নিস্তরঙ্গতার মধ্যে মৃত্যুর পদসঞ্চার শোনা যায়’। পড়তে-পড়তে মনে হয় উপনিবেশের কালে জন্মানো সৌমিত্র আমাদের পরাধীন অস্তিত্বের ভিতর সঞ্চারিত স্বদেশজিজ্ঞাসার কোনও পাঠ তৈরি করছেন। ‘অশনি সংকেত’-এর শুটিং শেষ করে যখন ফিরছেন, তখন তাঁর কেবলই মনে হচ্ছে, ‘‘এই এতদিনে শারীরিক ভাবে মানসিক ভাবে গঙ্গাচরণের জন্য যেন পুরোপুরি তৈরি হতে পেরেছি। অথচ ঠিক এখনই শেষ হয়ে গেল অভিনয়।’’

আরও পড়ুন: আমার প্রথম নায়ক

সৌমিত্রের এই মনন, নিরন্তর অতৃপ্তিই তাঁকে সত্যজিতের সারাজীবনের সঙ্গী করে তুলেছিল। ‘‘সৌমিত্র নিজে থেকেই বুঝতে পারত আমি কী চাই’’, সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন সত্যজিৎ। আর লিখেছিলেন, ‘তার প্রতি আমার নির্ভরশীলতা আমার শিল্পীজীবনের শেষ দিন পর্যন্ত বজায় থাকবে’। উল্টোদিকে সৌমিত্র লিখেছিলেন, ‘সারাজীবনে মানিকদার ছবিতে আমি প্রাণ খুলে যথেষ্ট স্বাধীনতা নিয়ে অভিনয় করতে পেরেছি। স্বাধীনতা গ্রহণ করার যে আত্মবিশ্বাস, তা ওঁর কাছেই পেয়েছি’। অপু হয়ে-ওঠার জন্য সৌমিত্রকে ‘অপুর সংসার’-এর চিত্রনাট্য দিয়েছিলেন সত্যজিৎ। তার আগে তিনি কোনও অভিনেতাকে চিত্রনাট্য দিতেন না। সঙ্গে দু’টি ফুলস্কেপ পাতায় লিখে দিয়েছিলেন অপু চরিত্রটি নিয়ে নানা দৃষ্টিকোণে দেখা নিজস্ব ভাবনা। পাশাপাশি সৌমিত্রও লিখেছিলেন ‘অপুর ডায়েরি’ এবং অপু সম্পর্কিত নিজের অভিজ্ঞতায় ভর-করা কল্পনা। এখনও যখন সে ছবি তৈরির স্মৃতিতে ফেরেন সৌমিত্র, তখন তিনি লেখেন, ‘বাস্তবতাকে মাপকাঠি করে অভিনয়ের ওই যে চেষ্টা, ওটাই অভিনয়ের আসল অভিপ্রায়’।

অপুর সংসার। তাঁর চেহারা সম্পর্কে তখন এতটাই মুগ্ধতা ছিল সত্যজিতের, যে বলেছিলেন, ‘‘তরুণ বয়সের রবীন্দ্রনাথ।’’

সত্যজিতের কাছে আসার আগে যখন অভিনেতা হিসেবে আত্মপ্রস্তুতির ভিত তৈরি করছিলেন নাট্যাচার্য শিশিরের ভাদুড়ির কাছে, তিনি বলেছিলেন, ‘‘যখন পড়বে তখন গোয়েন্দার মতো পড়বে।’’ শিক্ষার্থী সৌমিত্র কখনও ভোলেননি সে কথা। বলেছিলেন, ‘‘গোয়েন্দার মতো খোঁজা এখনও আমার ধ্রুবমন্ত্র হয়ে আছে।’’ সৌমিত্রর এই শিল্প অভিপ্রায়ই তাঁর দু’খণ্ডের বিপুল গদ্যসংগ্রহে বিবিধ বিষয়ে বিন্যস্ত। সৌমিত্রর স্বতন্ত্র স্বরের মূলে তাঁর আজীবনের আধুনিক মন। যখন নাটক রচনা করছেন, তা ‘সমকালের জীবনযন্ত্রণার অনুভবে’ বুনছেন। কারণ হিসেবে জানাচ্ছেন, ‘যা সমসময়ের স্বদেশের ক্ষেত্রেও সত্য বলে প্রত্যয় হয় সেইটাকেই রাখার চেষ্টা’। একই কারণ তাঁর রবীন্দ্রনাথ চর্চার ক্ষেত্রেও, “আজকের এই ছিন্নভিন্ন কর্তিত কুরুযুদ্ধের মতো কালে আমাকে ন্যায়-অন্যায়ের, হিত-অহিতের জ্ঞানে স্থিত রাখতে পারে। শুভকর্মে মানবমুক্তির পথে চালিত করতে পারে।” তাঁর এই গদ্যাদির একটি বাক্যাংশই যেন সত্য হয়ে ওঠে নাটক, গদ্যের পাশাপাশি তাঁর কবিতা বা ছবি আঁকাতেও। ‘অস্পষ্ট হলেও কোনও প্রচ্ছন্ন ইতিহাসের ক্ষীণ পদচিহ্ন দেখতে পাওয়া যায়’ সেখানে। দেখা যায় দীর্ঘ ৬০ বছরে উপনীত তাঁর অভিনয় জীবনেও। সেখানে অভিনীত চরিত্রগুলিতেও প্রচ্ছন্ন হয়ে থাকে ইতিহাসের স্বর। যে ইতিহাস বড় বিষাদময়। দেশকালের বিষণ্ণতা লেগে থাকে তাতে। এ দেশে এখন ভাল অভিনেতা অনেকেই আছেন, ছিলেনও। কিন্তু সৌমিত্রর মতো শিল্পীর দেখা কম পাওয়া যায়।

১৯৫৬ সালে সত্যজিৎ যখন ‘অপরাজিত’ বানাচ্ছেন, তখন সৌমিত্র ২০ বছর। আলাপ হলেও তখন তাঁর মধ্যে অপুর ‘কৈশোর’ দেখতে পাননি সত্যজিৎ। কিন্তু দু’বছর পর ‘অপুর সংসার’-এ সত্যজিতের ‘অপু’ হলেন তিনি। ‘জলসাঘর’-এর শ্যুটিং–ক্লান্ত বিশ্বম্ভর রায়ের সামনে দাঁড় করিয়ে সটান বললেন সত্যজিৎ, ‘‘এই হল সৌমিত্র চ্যাটার্জি। আমার পরের ছবির অপু।’’ তাঁর চেহারা সম্পর্কে তখন এতটাই মুগ্ধতা ছিল সত্যজিতের, যে বলেছিলেন, ‘‘তরুণ বয়সের রবীন্দ্রনাথ।’’

আর সৌমিত্র? তিনি বলেছেন, “আমি তখন অল ইন্ডিয়া রেডিওতেও কাজ করি। অভিনয়ের প্রতি বেশ আগ্রহী। তা জেনেই তিনি আমাকে ডাকলেন। গেলাম। সত্যজিৎবাবু আমাকে দেখামাত্র বললেন, ‘আরে না-না! তোমার বয়সটা একটু বেশি মনে হচ্ছে।’ প্রথমে না বললেও পরে নিজেই আগ্রহভরে নিলেন। সুধীজনের আগ্রহ ও দর্শকপ্রিয়তা পাওয়ায় ছবিটির পর তিনি আবার পরবর্তী সিনেমা নির্মাণের কাজে হাত দেন। সেটির নাম ‘অপুর সংসার’। আমার সঙ্গে কোনওরকম কথা না বলেই তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, অপুর সংসারে আমার কাজ করতে হবে। এভাবেই শুরু। তার পর একের পর এক হাঁটা অভিনয় জগতে।”

আরও পড়ুন: সৌমিত্রকাকুকে মডেলের মতো বসিয়ে ছবি এঁকেছিলেন বাবা

আড়াইশোরও বেশি ছবিতে অভিনয় করেছেন সৌমিত্র । মনে থেকে যায় ‘সাত পাকে বাঁধা’, ‘ক্ষুধিত পাষাণ’, ‘ঝিন্দের বন্দী’, ‘একটি জীবন’, ‘কোনি’, ‘হীরক রাজার দেশে’, ‘দত্তা’ । নায়ক হিসেবে তিনি তাঁর সমসাময়িক সব নায়িকার বিপরীতেই সাফল্য পেয়েছেন। সম্ভবত তাই তেমন করে কারও সঙ্গে ‘জুটি’ গড়ে উঠেনি। সুচিত্রা সেনের সঙ্গে ‘সাত পাকে বাঁধা’, ‘দত্তা’ ছবিতে সৌমিত্র হয়ে উঠেছিলেন অনন্য। তেমনই সাবিত্রী, সুপ্রিয়া, অপর্ণারাও সৌমিত্রের সঙ্গে মিশেছেন অবলীলায়।

‘ঝিন্দের বন্দী’। এমন এক নিষ্ঠুর ভিলেনের চরিত্রে সৌমিত্রকে যে কেউ ভাবতে পারেন, সেটাই ছিল আশ্চর্যের।

১৯৬১ সাল সৌমিত্রের অভিনয় জীবনে মাইলফলক। ওই বছরই মুক্তি পায় তপন সিনহা পরিচালিত ‘ঝিন্দের বন্দী’। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঐতিহাসিক উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত সেই ছবিতে সৌমিত্রকে দর্শক প্রথম পেয়েছিলেন একটি খলচরিত্রে। নাম ‘ময়ূরবাহন’। যে অভিনেতা ‘অপু’ হিসেবে দর্শকের মনে জায়গা করে নিয়েছেন। ‘ক্ষুধিত পাষাণ’, ‘দেবী’ বা ‘সমাপ্তি’-তে যে নায়ক ঝড় তুলেছেন, সেই অভিনেতাকে তপন সিন্‌হা দিলেন এক নিষ্ঠুর ভিলেনের চরিত্র। তখনও বাংলার দর্শকের সাহিত্য পড়ার অভ্যাস ছিল। উপন্যাসে ময়ূরবাহনকে একজন অত্যন্ত ‘সুদর্শন ও লম্পট’ যুবক হিসেবে বর্ণনা করেছেন শরদিন্দু। এমন একটি চরিত্রে সৌমিত্রকে যে কেউ ভাবতে পারেন, সেটাই ছিল আশ্চর্যের।

কিছু সংলাপ অথবা কয়েকটি দৃশ্য বাংলা চলচ্চিত্র জগতে কিংবদন্তি হয়ে আছে সৌমিত্রের অভিনয়ের গুণে। তার প্রথমটি ‘কোনি’ ছবির বিখ্যাত সংলাপ, ‘‘ফাইট! কোনি ফাইট!’’ আরও একটি সংলাপ দর্শকের মুখে মুখে ফেরে। যে সংলাপটি তাঁর নয়। কিন্তু সেটি বলা হয়েছিল সৌমিত্র অভিনীত চরিত্রের উদ্দেশে। ছবিতে সেই সংলাপটি যত বার এসেছে, ততবারই সৌমিত্র নীরব থেকেছেন। তাঁর সেই নীরবতা যে কতটা মর্মভেদী, চরিত্রটি যে কত অসহায়, যাঁরা ছবিটি দেখেছেন, তাঁরা ভুলতে পারবেন না। ছবির নাম ‘আতঙ্ক’। সংলাপ, ‘‘মাস্টারমশাই, আপনি কিন্তু কিছু দেখেননি!’’ ঘটনাচক্রে এই দু’টি ছবিই মুক্তি পেয়েছিল ১৯৮৬ সালে।

বাংলা ছবির দর্শকরা এক সময় ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান সমর্থকদের ভাগাভাগির মতো উত্তম–শিবির ও সৌমিত্র–শিবিরে বিভাজিত ছিলেন। যদিও সৌমিত্র নাটকের মঞ্চে থেকে গিয়েছেন নিজস্ব ধারায়। হাতিবাগানের বাণিজ্যিক থিয়েটার এবং গ্রুপ থিয়েটারের পাশাপাশি তৃতীয় একটি স্বতন্ত্র ধারার জনক বলা যায় নাট্যকার ও নাট্য পরিচালক সৌমিত্রকে। সেই পথ থেকে তিনি কখনও বিচ্যুত হননি। সাম্প্রতিক কালের ‘হোমাপাখি’, ‘ছাড়িগঙ্গা’, ‘আত্মকথা’-তেও সেই ধারা স্পষ্ট। ‘কারুবাসনা’-য় সতত আলোড়িত শুধু মঞ্চের বা সিনেমারই থাকেননি, কবিতাও লিখেছেন নিরন্তর। তাঁর ‘দ্রষ্টা’ গ্রন্থের ভূমিকায় কবি শঙ্ঘ ঘোষ লিখেছিলেন, ‘সৌমিত্র নিজে যে দীর্ঘকাল অন্তর্নিবিষ্টভাবে কবিতা লিখে চলেছেন, তাঁর অভিনয় ক্ষমতার আড়ালে সে কথাটা অনেকখানি চাপা পড়ে গেছে’।

২০০৪ সালে ‘পদ্মভূষণ’, ২০০৬ সালে ‘পদক্ষেপ’ ছবিতে জাতীয় পুরস্কারে সম্মানিত সৌমিত্র ২০১১ সালে ভারতীয় সিনেমার সর্বোচ্চ সম্মান ‘দাদাসাহেব ফালকে’ পান। ঘটনাচক্রে, তার ছ’বছর পর ২০১৮ সালে তিনি ভূষিত হন ফরাসি সরকারের সেরা নাগরিক সম্মান ‘লিজিয়ঁ দ’নর’-এ। তাঁর মানসপিতা সত্যজিতের ঠিক ৩০ বছর পর।

‘দাদাসাহেব ফালকে সম্মান’ নিচ্ছেন সৌমিত্র। ফাইল চিত্র।

অতৃপ্তি থেকে অভিনয়ের খিদে, জীবনের অপূর্ণতা থেকে লড়াইয়ের রাস্তা ক্রমশ এগিয়ে নিয়ে গিয়েছে তাঁকে। অন্যচোখে দেখা তাঁকে শুধু অভিনেতাই নয়, একজন শিল্পী করে তুলেছে। যাঁর সবচেয়ে পছন্দের চেহারার হিন্দি সিনেমার হিরোর নাম বলরাজ সাহনি। কারণ, বলরাজের বোধি আর দীপ্তি। এত দীর্ঘসময় কেন অভিনয় করে গেলেন তিনি? আত্মপ্রদর্শনের তাগিদে? না কি গ্ল্যামারের হাতছানিতে? না কি মুদ্রারাক্ষসীর মোহিনী মায়াজালে পড়ে?

কোনওটাই নয়। আসলে তাঁর অভিনয় তাঁর জীবনকে পেরিয়ে গিয়েছিল। যখন অর্থ নয়, কীর্তি নয়, সচ্ছলতা নয়। উন্নততর মানুষ হওয়ার সাধনা যাত্রাপথের লক্ষ্য হয়ে উঠতে থাকে। উৎকৃষ্ট অভিনেতা হওয়ার পথ এবং উন্নত মানুষ হওয়ার পথ তখন অভিন্ন হয়ে যায়। সেই যাত্রার প্রধান প্রেরণা একটি চার-অক্ষরি শব্দের মধ্যে অনন্ত শয়ানে এলায়িত হয়ে থাকে। ভালবাসা। চলে গেলেও সৌমিত্র বলে যান—

‘পুরস্কার তিরস্কার কলঙ্ক কণ্ঠের হার
তথাপি এ পথে পদ করেছি অর্পণ,
রঙ্গভূমি ভালোবাসি হৃদে সাধ রাশি রাশি
আশার নেশায় করি জীবন যাপন’।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy