Advertisement
০৪ নভেম্বর ২০২৪

এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ

এমন উদাসীন মেজাজেই শ্রাবণী সেন কাটিয়ে দিতে চান বাকি জীবন। লিখছেন সংযুক্তা বসু।সাল ১৯৯৪। পার্ক স্ট্রিটের এক পত্রিকা অফিসের টেবিলের ওপর তবলা বাজিয়ে হিন্দি গান গাইতেন। আর সাংবাদিকতা করতেন। দিগন্তে কোনও গায়িকা হওয়ার স্বপ্ন ছিল না। সাল ২০১৪। সেই পত্রিকার অফিস উঠে যাওয়ার পর কেটে গিয়েছে অনেকগুলো বছর। এখন বাজারে অজস্র সিডি। মাসে বারো থেকে তেরোটা আসরে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতে যাবার বরাত। সেই সঙ্গে নিজস্ব মিউজিক কোম্পানি। এবং এই রকমই আরও কত উদ্দীপনা।

ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল।

ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল।

শেষ আপডেট: ০৭ নভেম্বর ২০১৪ ০০:০০
Share: Save:

সাল ১৯৯৪। পার্ক স্ট্রিটের এক পত্রিকা অফিসের টেবিলের ওপর তবলা বাজিয়ে হিন্দি গান গাইতেন। আর সাংবাদিকতা করতেন। দিগন্তে কোনও গায়িকা হওয়ার স্বপ্ন ছিল না।

সাল ২০১৪। সেই পত্রিকার অফিস উঠে যাওয়ার পর কেটে গিয়েছে অনেকগুলো বছর। এখন বাজারে অজস্র সিডি। মাসে বারো থেকে তেরোটা আসরে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতে যাবার বরাত। সেই সঙ্গে নিজস্ব মিউজিক কোম্পানি। এবং এই রকমই আরও কত উদ্দীপনা।

‘শ্রাবণী সেন মিউজিক অ্যাকাডেমি’র ছ’টি শাখা কলকাতা শহর জুড়ে। যে শ্রাবণী সেন একদা সাংবাদিক ছিলেন আজ তিনি সুগায়িকা। জনপ্রিয়তা তুঙ্গে।

এক কথায় যাকে বলে ছিল রুমাল। হয়ে গেল বিড়াল।

সাংবাদিকতার শখ

কিন্তু শ্রাবণী সেনের মতো চরিত্র যাঁর মা বিখ্যাত রবীন্দ্রসঙ্গীত গায়িকা সুমিত্রা সেন, দিদি ইন্দ্রাণী সেন তিনি গান ছেড়ে সাংবাদিকতায় গিয়েছিলেন কেন? আসলে দিদি ইন্দ্রাণীই তাঁকে এক খবরের কাগজের অফিসে নিয়ে যান বাবা মারা যাবার পর। শ্রাবণী বললেন, “এম এসসি পাশ করেছি। গায়িকা হওয়ার স্বপ্ন দেখি না। হয় বিয়ে করতে হবে, নয়তো চাকরি। শেষমেশ ঠিক করলাম চাকরিই করব। দিদি যে সংবাদপত্রের অফিসে নিয়ে গিয়েছিল সেখানে সংস্কৃতির পাতায় গান নিয়ে লিখতে শুরু করলাম। ফ্রিলান্সিং থেকে পাকা চাকরিতে যোগ দেওয়া তার পর। পার্ক স্ট্রিটে অফিস ছিল সেই ম্যাগাজিনের। সকালে অফিসে ঢুকেই এক ঘণ্টার গানের আসর বসত। আমি একের পর এক গান গাইতাম। ‘ভুলে বিছরে’ হিন্দি গান। সহকর্মীদের অনুরোধে একের পর এক গান যেন অনুরোধের আসর।’’

দিদির সঙ্গে কোনও প্রতিদ্বন্দ্বিতা নেই

গানই শুধু নয়, সেই সঙ্গে টেবিল চাপড়ে তবলা বাজানো। তাও ছিল ওই ম্যাগাজিন অফিসে। তবলা বাজানোটা শিখলেন কী ভাবে? আসলে শ্রাবণী যে কোনও চামড়ার বাদ্যযন্ত্রই ছোটবেলা থেকে ভাল বাজান। “পুজোর সময় আমাদের ফ্ল্যাটবাড়ির দুর্গাপুজোয় কলকাতায় থাকলে একদিন গিয়ে ঢাক বাজিয়ে আসি। এবার অবশ্য সেটা হয়নি। কারণ দিল্লি আর ভদোদরাতে অনুষ্ঠান ছিল,” বলছেন শ্রাবণী। তাঁর ফ্ল্যাটবাড়ির পুজোয় একবার সেক্রেটারি হয়ে কুমোরটুলি যাওয়া থেকে চাঁদা তোলা, হিসেবনিকেশ রাখা সবই করেছেন শ্রাবণী। দাবি করলেন “আমি ভাল অর্গানাইজারও। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে টিকিট বিক্রি করার কাজও করেছি।” কিন্তু সে তো পুরনো দিনের কথা। আজ কান পাতলেই শোনা যায় শ্রাবণী আর ইন্দ্রাণীর গান নিয়ে প্রতিযোগিতার কথা। দুই বোনের মধ্যে কে বেশি ভাল গান? কার গায়কি সুন্দর তা নিয়ে বিতর্ক বাধে শ্রোতা মহলে। কিন্তু সেই বিতর্কের কথা ফুত্‌কারে উড়িয়ে দিলেন শ্রাবণী। বললেন, “দিদি কত দিন ধরে কত রকম সাধনা করেছে। কত রকম গান শিখেছে। আমি ওর নখের যোগ্য নই। কীসের তুলনা আমার সঙ্গে দিদির? দিদির সঙ্গে আমার দারুণ ভাব। একটা সময় ছিল বিভিন্ন ফাংশানে যখন দিদি যেত, আমি চা-কফি ফ্লাস্কে করে বয়ে নিয়ে যেতাম। দিদি আমাকে গায়িকা হওয়ার ক্ষেত্রে অনেক সাহায্য করেছে। অনেক সময় নিজের অনুষ্ঠানে আমাকে দিয়ে গান গাওয়ানোর ব্যবস্থা করেছে। সেই সব দিনের কথা ভোলার নয়। আমাদের মধ্যে কোনও প্রতিযোগিতা নেই। দেখা হলে গান নিয়ে কথাও হয় খুব কম।”

এ হেন দিদি-অন্ত প্রাণ শ্রাবণী সেনের গানের গুরু কে? প্রশ্ন উঠতেই পারে। শ্রাবণী এক কথায় বলেন, “মা, আমার চলন্ত স্বরলিপি। আজও তাঁর কাছে গান শিখে চলেছি। মায়া সেনের কাছেও তিন বছর গান শিখেছি। গীতবিতানে একটা অ্যাকাডেমিক শিক্ষা হয় পাঁচ বছরের। এ ছাড়া দেবব্রত বিশ্বাস, সাগর সেন এঁদের গানেরও প্রভাব আছে আমার গানে।”

সফ্ট গানে বাজিমাত কেন

কড়া কড়া গায়কদের নাম করলেও শ্রাবণী সেনের গান মানে সফ্ট বা কোমল রবীন্দ্রসঙ্গীত। কেন তিনি টপ্পাঙ্গের গান করেন না? যেখানে তাঁর দিদি ইন্দ্রাণী আধুনিক, নজরুলগীতি, পুরাতনী সবই গেয়ে থাকেন? শ্রাবণীর চাঁচাছোলা জবাব, “আমি মিক্সড প্রোগ্রামে গান গাই। সেখানে ফোক থেকে ব্যান্ড সব রকম গানই চলে। ওই ধরনের শ্রোতার কাছে নরম এবং জনপ্রিয় রবীন্দ্রসঙ্গীতের কদর বেশি। সেই জন্যই উচ্চাঙ্গের রবীন্দ্রসঙ্গীত গাই না। তা ছাড়া আমি যে সব গান জানি না তা নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করতে চাই না।” কিন্তু শ্রাবণীর গলায় গজল, হিন্দি গান খেলে ভাল এ কথা অনেকেই বলেন, কিন্তু সে দিকেও তো তিনি গেলেন না? “দিনের শেষে আমি একজন রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী এটা ভেবেই সব চেয়ে আনন্দ পাই বলে আর অন্য কোনও গানে তরি ভেড়াইনি। রবীন্দ্রনাথের গানের মধ্যে এমন কিছু খুঁজে পাই যেটা অন্য কোনও গানে খুঁজে পাই না। লোকে যদি বলে শ্রাবণী একজন রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী তাতেই আমি আনন্দ উপভোগ করি।” কিন্তু রবীন্দ্রসঙ্গীতে এখন যে সব পরীক্ষানিরীক্ষা হচ্ছে সেগুলো কেমন লাগছে? “পরীক্ষানিরীক্ষা অনেক করেছি গান নিয়ে আমিও। কিন্তু সেটা মিউজিক অ্যারেঞ্জমেন্টের দিক দিয়ে। কখনও কথা বা সুর পাল্টাইনি। কিন্তু আজকালকার বাংলা সিরিয়ালে বিনা দ্বিধায় কথা আর সুর পাল্টে দেওয়া হয়। সিরিয়ালে এই সব যে হচ্ছে তা দেখার জন্য অভিভাবক থাকা দরকার। তা না হলে গোল্লায় যাবে রবীন্দ্রসঙ্গীত,” প্রতিবাদী সুরে বলেন শ্রাবণী।

বিয়েটা করছি না

রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পীরা কেউ কেউ বলে থাকেন রবীন্দ্রনাথ তাঁদের জীবনদেবতা, কেউ বলেন প্রাণের ঠাকুর। শ্রাবণীর কাছে রবীন্দ্রনাথ কিন্তু পরিপূর্ণ এক জন মানুষ। বন্ধু, সখা। সুখদুঃখের সঙ্গী। বললেন, “সুখের সময় তো বটেই, দুঃখের সময় রবীন্দ্রনাথের গান বিশেষ ভাবে কাছে টানে জীবনকে।”

নিঃসঙ্গ লাগে না? বিয়ে করবেন না? প্রশ্ন শুনে প্রায় হেসে গড়িয়ে পড়লেন শ্রাবণী। “বর? সে তো বর্বর। বিয়ে করার কথা ভাবিই না। আমার অ্যাকাডেমির সাড়ে তিনশো ছাত্রছাত্রী আছে। তারাই আমার ছেলেমেয়ে। ওদেরকে নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে চাই।” পরমুহূর্তে শোনালেন বিয়ে নিয়ে এক মজার গল্প। এক দিন তিনি নিজস্ব অ্যাকাডেমিতে ক্লাস নিচ্ছেন। এমন সময় এক ভদ্রলোক এসে হাজির। শ্রাবণীকে বললেন, “আপনার সঙ্গে একটু পার্সোনাল কথা বলতে চাই।” শ্রাবণী বললেন, “দাঁড়ান। আমি ক্লাসটা সেরে নিই। তার পর কথা হবে।” তিনি ভেবেছিলেন ভদ্রলোক হয়তো তাঁর ছেলে বা মেয়েকে ভর্তি করাতে চান গানের ক্লাসে। তাই এত উত্‌সাহ। কিন্তু ক্লাস শেষ হওয়ার পর যা ঘটল তা দেখে শ্রাবণীর চক্ষু চড়কগাছ। ভদ্রলোক সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে বসলেন। “তা শুনে আমার তো অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার জোগাড়। আমি স্পষ্ট করে বললাম আমি বিয়ের কথা ভাবছিই না। আমার বিয়ে নিয়ে কোনও প্ল্যানিংও নেই। ভদ্রলোক ভগ্নমনোরথে ফিরে গেলেন,” হাসতে হাসতে বলছিলেন শ্রাবণী।

এই রকম ভাবে বিয়ের প্রস্তাব বেশ কয়েক বার এসেছে। আর শ্রাবণী তা ফিরিয়ে দিয়েছেন। তাঁর জীবনের সব চেয়ে বড় লক্ষ্য এখন ‘শ্রাবণী সেন মিউজিক অ্যাকাডেমি’র কাজকর্ম পরিচালনা করা। আর মিউজিক কোম্পানি পিকাসো এন্টারটেনমেন্টের মাধ্যমে উদীয়মান শিল্পীদের হাত ধরা। এই বছর পুজোয় বেশ কিছু নতুন সিডি বেরিয়েছে এই কোম্পানি থেকে। শিল্পীদের মধ্যে রয়েছেন ইন্দ্রাণী সেন, শ্রীকান্ত আচার্য, ব্রততী বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রবুদ্ধ রাহা প্রমুখ।

আমজনতার সঙ্গে থেকে যেতে চাই

কিন্তু ১৯৯৪য়ের জার্নালিজম থেকে আজকের বিখ্যাত গায়িকা হওয়ার পথটা কি সত্যিই খুব মসৃণ ছিল? শ্রাবণীর মতে একেবারেই নয়। প্রথম দিকে বিভিন্ন ক্যাসেট কোম্পানিতে নিজের গান গাওয়া স্যাম্পল ক্যাসেট জমা দিয়ে প্রত্যাখ্যাত হতে হয়েছে। তাঁরা বলেছেন শ্রাবণীকে, ‘আরও শিখতে হবে’। রবীন্দ্রসদনে অডিশনেও প্রথমবার ফেল। সেই সব ছিল দুঃখের দিন। সেই সব দিন পেরিয়ে গিয়ে আজ খ্যাতি যশ পেয়ে কেমন লাগে? শ্রাবণী বললেন, “আমি চিরকালই খুব ক্যাজুয়াল। কাল কী হবে তা নিয়ে ভাবি না। তাই দুঃখ-শোক আনন্দগুলো তেমন গায়ে লাগে না। আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ। এটাই আমার জীবন উপভোগের গান।”

গায়িকা না হয়ে জার্নালিস্ট হওয়ার স্বপ্ন দেখার আর একটা কারণ ছিল শ্রাবণীর। গায়িকারা যে ভাবে রোজ সাজগোজ করে অনুষ্ঠানে যান সেটা শ্রাবণীর পছন্দ ছিল না। আর আজ? “আজও তো আমি তেমন সাজি না। যেটুকু সাজগোজ তা ওই তসরের শাড়ির ওপর দিয়েই হয়ে যায়, মা অনুষ্ঠানে যাবার আগে আমাকে সাজতে সাহায্য করেন। শাড়িটা, গয়নাটা এগিয়ে দেন। নিজে থেকে আমি সাজতেই পারি না,” বলেন শ্রাবণী। গড়িয়াহাট বাজারের সমস্ত দোকানদারের সঙ্গে তাঁর মধুর সম্পর্ক। “গেলে পরে আমায় তাঁরা চা খাওয়ান। গল্প করেন,” বলেন শ্রাবণী।

আমজনতার সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলে চলেই তিনি কাটিয়ে দিতে চান বাকি জীবনটা।

অন্য বিষয়গুলি:

ananda plus sanjukta basu srabani sen
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE