শ্রেয়া গুহঠাকুরতা।
দক্ষিণ কলকাতার এক নার্সিংহোমে আমার জন্ম। আর বেড়ে ওঠা শরৎ ব্যানার্জি রোডের গুহঠাকুরতা পরিবারে, সাংগীতিক পরিবেশে। যৌথ পরিবারে অনেক ভাইবোনের মধ্যে বড় হয়েছি। আর পাঁচটা যৌথ পরিবারের মধ্যে ছেলে-মেয়েরা যে ভাবে বড় হয়, আমিও সে রকম সাধারণ ভাবেই বেড়ে উঠেছি।
এখন আমাদের ছেলেমেয়েরা নিউক্লিয়ার সেট-আপ-এ বড় হচ্ছে, কিন্তু আমাদের সময় তেমনটা ছিল না। কারণ ঠাকুমা-দাদুরা আমাদের মাথার ওপর ছিলেন। আমরা বাবা-মা, জ্যাঠা-কাকা, পিসি সকলের সান্নিধ্যে বেড়ে উঠেছি। বাড়িতে প্রায় সাত-আট জন ভাইবোনের মধ্যে কে নিজের দিদি, কে জ্যাঠতুতো বোন সেই পার্থক্যগুলোই ছিল না। এই সবার মাঝে বেড়ে ওঠার দিনগুলোকে খুব মিস করি এখন।
ছোটবেলা থেকেই দেখতাম, বাড়িতে বড় বড় শিল্পী, ওস্তাদদের আসা যাওয়া লেগেই থাকত। এখন কলকাতা বলতে যা বুঝি, ‘ইনটেলেকচুয়াল ক্যাপিটাল’—তার সঙ্গে পরিচয় ঘটেছে সেই ছোট বয়সেই। আমার স্কুল ছিল মডার্ন হাই। এখানে একদম ছোট থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়েছি। ছোট থেকেই আমার খুব ইচ্ছে ছিল বাইরে পড়তে যাওয়ার। এডুকেশনের জন্য আমার প্রথম পছন্দ ছিল দিল্লি। আমাদের উচ্চ মাধ্যমিকের রেজাল্ট দেরিতে বেরোনোর জন্য দিল্লিতে চান্স পাইনি। এর পর পুণেতে গিয়ে ইকনমিক্সে মাস্টারস করি।
আরও পড়ুন, নতুন খবর দিলেন সৌরভ-মধুমিতা, কী জানেন?
বাইরে পড়ার সময়েও বাড়িতে ঘন ঘন আসা যাওয়া চলতই। যেহেতু আমাদের পরিবার খুব রক্ষণশীল, সে কারণেই গানবাজনা এ সবের থেকে কখনও বিচ্ছিন্ন হইনি। তা ছাড়া ছোট থেকেই আমার গান-বাজনা খুব ভাল লাগত। আর আমার শোনা কথা, আমার মধ্যে খুব ছোট থেকেই নাকি সেই ট্যালেন্টটা ছিল। খুব ছোট বয়স থেকেই গান গাওয়া এবং অভিনয়ের অনেক সুযোগ পেয়েছি।
পাঁচ বছর বয়সে প্রথম প্লেব্যাক করি। তপন সিংহের ‘দীপার প্রেম’ ছবিতে। যেটা ছিল তপন সিংহের স্ত্রী অরুন্ধতী দেবীরও প্রথম ছবি। তাপস পাল এবং মুনমুন সেনেরও এটা ডেবিউ ফিল্ম ছিল। যাতে আমি অভিনয় করি ছোট দীপার চরিত্রে। যে বড় হয়ে মুনমুন মাসি (সেন) হয়। এর কয়েক বছর পরে আবার তপন সিংহ ওঁর ন্যাশানল অ্যাওয়ার্ড পাওয়া ছবি ‘অন্তর্ধান’-এ সুযোগ দেন। এই ছবিতে আমি গান গাই।
আরও পড়ুন, ‘বিগ বস’-এর ওই ব্যারিটোন গলার মালিক কে জানেন?
ছোট থেকে আমি মোহর দিদার (কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়) গান শুনে বড় হয়েছি। তিনি মায়ের মাসি ছিলেন। তবে আমার গানের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাটা কিন্তু ‘দক্ষিণী’ থেকে। আমি ‘দক্ষিণী’র পুরো কোর্সটাই করেছি। যদিও রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী হিসেবে ফাইনালি ঘষা-মাজা, তৈরি হওয়াটা আমার জেঠু সুদেব গুহঠাকুরতার কাছে। যিনি বর্তমানে ‘দক্ষিণী’র কর্ণধার।
গান শেখা ছাড়াও আমি পিয়ানো বাজানো শুরু করি চার-পাঁচ বছর বয়স থেকে। এর পর ‘ক্যালকাটা স্কুল অব মিউজিক’-এ শিখি অনেক বছর। সব মিলিয়ে পিয়ানো শিখেছি দীর্ঘ ১৪ বছর। পিয়োর ওয়েস্টার্ন ক্লাসিক্যাল মিউজিকটাই শিখেছি। বাবার পিয়ানোতে খুব আগ্রহ ছিল বলেই হয়তো আমার পিয়ানো শেখা সম্ভব হয়েছে।
মায়ের সঙ্গে শ্রেয়া।
আর আমার ভীষণ ভাল লাগার জায়গা ইন্ডিয়ান ক্লাসিক্যাল মিউজিক। আমি গ্ল্যামার ওয়ার্ল্ডে গিয়েছি, অভিনয় করেছি, মুম্বইয়ের মতো জায়গায় মডেলিংও করেছি। কিন্তু এ সবের প্রতি আমার কখনও মোহ ছিল না। আমি ‘সানন্দা’ ম্যাগাজিনের কভারে কম করে ২০ বার এসেছি। এখানে নিয়মিত মডেল মানেই ছিলাম আমি আর স্বস্তিকা। কমার্শিয়ালের জন্য আমি জিঙ্গলসও করেছি। তবুও মানুষের জীবনে কিছু আফসোস তো থেকে যায়। তেমনই আমার জীবনেও রয়েছে। শীতকালে কলকাতায় যখন বড় বড় ক্লাসিকাল কনসার্ট হয়, তখন আমি যাই। আমি ছোট থেকে রাশিদ খানের অন্ধ ভক্ত। আমার এই ইন্ডিয়ান ক্লাসিকাল মিউজিকের দিকে যাওয়ার খুব ইচ্ছে ছিল। বাবারও ইচ্ছে ছিল। কিন্তু আমার দাদু-জ্যাঠারা খুব রক্ষণশীল। ওঁরা বলেছিলেন তুমি যদি বেশি রেওয়াজ করো, রবীন্দ্রসংগীত গাইতে অসুবিধে হবে। এটা যেহেতু আলাদা ঘরানা। আর পরবর্তী প্রজন্ম হিসেবে তোমাকে সেই ধারাটা বহন করতে হবে। ক্লাসিকাল মিউজিকটা আমার আর শেখা হল না, এটাই জীবনে আফসোসের জায়গা!
আমি যে পরিবেশে বড় হয়েছি, তাতে আলাদা করে কখনও মনে হয়নি, মা-বাবা সেলিব্রিটি। টিভি খুললেই মা-কে (শাশ্বতী গুহঠাকুরতা) দেখা যাচ্ছে বা বাবা (ভীষ্ম গুহঠাকুরতা) সত্যজিৎ রায়ের ছবিতে অভিনয় করছেন। যেমন ভাবে কারও বাবা ব্যাঙ্কে চাকরি করে, মা নাটক করে, এটাও সে রকমই।
আমার ছেলের এখন বারো বছর বয়স। ও কিন্তু জানে, মা গান করে। তবে ও কখনওই ভাবে না, মা একজন স্টার, বিদেশে কনসার্ট করছে... আসলে আমি, আমার মা-বাবা প্রত্যেকেই খুব সাধারণ। আমরা সেলিব্রিটি ওই বিষয়টার দিকে কখনও ছুটিনি।
আমি তো যৌথ পরিবারে বড় হয়েছি। দাদু (শুভ গুহঠাকুরতা) বাড়ির সব ভাই-বোনদের শীতকালে চিড়িয়াখানায় বেড়াতে নিয়ে যেতেন। সেই সঙ্গে একটা বড় প্রাপ্তি ছিল, জমিয়ে খাওয়াদাওয়া। শীতকাল মানেই ছিল পিকনিক। নয়তো হর্টিকালচারে যাচ্ছি। বাগানবাড়িতে পিকনিক করতে যাওয়া এ সব তো ছিলই।
আরও পড়ুন, বিয়ের ঠিক আগেই কী শপিংয়ে বেরোলেন পাওলি?
আমাদের বাড়িতে মিউজিকের সঙ্গে সঙ্গে বাবা-জ্যাঠা-কাকারা খুব খেলা ভালবাসতেন। সেই সুবাদে ইডেন গার্ডেন্সে যাওয়া। আমার বাবা রঞ্জি খেলেছে। জেঠুরাও বেঙ্গল খেলেছে। আমরা শীতকালে লুচি আলুর দম এ সব খাবার প্যাক করে ইডেন গার্ডেন্সে খেলা দেখতে যেতাম। খুব সিম্পল জিনিসের মধ্য দিয়ে আমরা বড় হয়েছি।
কলকাতায় দুর্গাপুজো বিশাল বড় একটা ব্যাপার ছিল। পুজোর আগে সবাই মিলে শপিং করতে যাওয়া, পুজোর দিনগুলোতে সব ভাইবোন একই রকম জামাকাপড় পরা, এ সব আলাদা আনন্দ ছিল। পয়লা বৈশাখের সকালে বাড়িতে কচুরি জিলিপি খাওয়ার চল ছিল। আমার পিসেমশাই নিয়ে আসতেন। তার পর রাতে মাংস-ভাত এ সব তো হতই। ট্র্যাডিশনটা আমাদের বাড়িতে ভাল ভাবেই মানা হত।
বিশ্বকর্মা পুজো মানে আমাদের বাড়িতে কম করে দেড়শো লোক মাংস-ভাত খেতে আসত। আমাদের জেনারেশন ভাই-বোন, বাবাদের বন্ধুবান্ধব সবাই মিলে ছাদে ঘুড়ি ওড়ানো হত। আবার কালীপুজোতে বাড়িতে বাজি তৈরি করা হতো। একের পর এক উৎসব লেগেই থাকত। ভারী মজার ছিল সে সব দিন। ৪০০-৫০০ তুবড়ি বানানো হতো, এই দশ বছর আগে পর্যন্ত। তাই সব রকম আনন্দ আমরা বাড়ির মধ্যেই করেছি। একমাত্র দুর্গাপুজোর মতো বড় পুজো আমাদের বাড়িতে হয়নি, জায়গা এবং এতগুলো মানুষের কারণে। এ ছাড়া পয়লা বৈশাখ, সরস্বতী পুজো, লক্ষ্মী পুজোয় পাঁচালি পড়া, ফল কাটা, আলপনা দেওয়া। মহালয়াতে ভোরবেলায় সবাই মিলে উঠে মহালয়া শুনতেই হবে। কলকাতা শহর এবং তার বাঙালিয়ানার সঙ্গে পরিচয় আমার পরিবারের মধ্য থেকেই হয়েছে।
আমার স্বামী পেশায় আইনজীবী। আমার বিয়ে হয়েছে আঠারো বছর হতে চলল। বিয়ের পর থেকেই আমি তার সঙ্গে বাইরে বাইরে। এই মুহূর্তে আমার ঠিকানা হিউস্টন। তার আগে প্যারিস, ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড, দুবাই, ইরানে ছিলাম। আমার এক কথায় যাযাবরের জীবন। যখন হিউস্টনে থাকি, আমার প্রত্যেক মাসে ট্র্যাভেল থাকে আমেরিকার নানান জায়গায়, নয়তো কলকাতায়। প্রোগ্রাম সব সময় লেগেই থাকে। এ ছাড়াও আবুধাবি, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুর গিয়েছি। সম্প্রতি অনুষ্ঠান করতে মালয়েশিয়া গিয়েছিলাম। বাংলাদেশেও গানের সূত্রে বছরে চার থেকে পাঁচবার যেতে হয়। এই কারণেই আমার বাবা-সহ পরিবারের সবাই খেপায়, বনগাঁ লোকালে যাতায়াত করি বলে। তবে এতটা ট্রাভেল করাটা আমার অভ্যেস হয়ে গিয়েছে। তাই কাজের সূত্রে দেশে-বিদেশে ক্রমাগত যাতায়াত আমাকে কখনও ক্লান্ত করে না।
বাবার সঙ্গে শ্রেয়া।
গান-বাজনা আমার প্রথম ভালবাসা। এবং এই সূত্রেই আমার এত মানুষের সঙ্গে পরিচয়। তাঁরা যখন ভেতর থেকে আমাকে ভালবাসেন, শ্রদ্ধা করেন— এটা একটা বিশাল পাওয়া।
এত কাজের মাঝেও আমি কিন্তু প্রায় আড়াই মাস অন্তর কলকাতায় আসি। কাজের ফাঁকেই পরিবারের সঙ্গে সময় কাটাই।
গানের সূত্রেই সবটা মেনটেন করা সম্ভব হচ্ছে। তবুও আমি কলকাতাকে খুব মিস করি। কারণ এখানকার চেনা হাওয়া, চেনা মানুষের গন্ধ বিদেশে বসে পাই না। আর কলকাতার খাবারদাবার খুব মিস করি। এটা তো বাইরে পাই না। এখানকার ফুচকা, রোল, বিরিয়ানি খুব মিস করি। কারণ আমি খুব খাদ্যরসিক।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সব কিছুই আধুনিক হচ্ছে। কলকাতায় বড় বড় ফ্লাইওভার হচ্ছে। অনেক কমার্শিয়াল ডেভলপমেন্টও হচ্ছে। যেটা খুব ভাল দিক।
ইদানীং শহরটাকে বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন লাগে। প্রচুর গাছপালাও লাগানো হচ্ছে, শহর সাজছে। কলকাতায় অনেক বড় বড় থিমের পুজো হচ্ছে। কলকাতার যে প্রাণ, এবং মানুষের মধ্যে ভালবাসার যে প্রাণ, এটা ছোটবেলাতেও ছিল। কলকাতার উষ্ণতাটা চট করে অন্য শহরে পাওয়া যায় না।
আরও পড়ুন, মুক্তির আগেই ১৬টি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কার জিতেছে এই ছবি!
বিদেশে এত বছর ধরে আছি তো। সে কারণে এই তফাতগুলো বেশ বুঝতে পারি। ওখানে আমাদের জীবনটা একদম যান্ত্রিক। সবাই এই জীবনে অভ্যস্ত এবং সকাল থেকে কাজে খুব ব্যস্ত। সবাই ছুটছে। কলকাতায় এলে যেটা মনে হয়, সব কিছুই একটু ধীর গতিতে চলছে। তবে সেটা আমার ভাল লাগে। কারণ সবাই ছুটলে কী করে চলবে। ক্রিয়েটিভ মানুষদের এই স্পেসটার দরকার আছে। ইনটেলেকচুয়াল ক্যাপিটাল কিন্তু সহজে হয়নি কলকাতা। এগুলোই তার কারণ। কলকাতার আকাশে-বাতাসে এখনও সেটা অনুভব করা যায়। এটা তখনও ছিল। কলকাতার এই প্রাণটা আমি অন্য কোথাও পাই না।
তবে কলকাতার যেটা খারাপ লাগে, এখানকার মেধাসম্পন্ন ছেলেমেয়েরা চাকরির জন্য কলকাতা ছেড়ে বাইরে চলে যাচ্ছে। যারা কর্পোরেট ওয়ার্ল্ডে চাকরি করতে চায়, তারা সবাই দিল্লি, পুণে, হায়দরাবাদ, নয়তো বেঙ্গালুরু চলে যাচ্ছে। কেননা ওখানে রোজগারটা বেশি, সুযোগ-সুবিধা বেশি। এটা তো কলকাতায় নেই!
এখন ক্যাপিটালিজমের যুগ তো। তাই কর্পোরেট ওয়ার্ল্ড ছাড়া বাঁচা যায় না। শুধু তো গানবাজনা, নাটক করে থাকা যায় না। এখানে আইটি বা ব্যাঙ্ক ছাড়া অন্যান্য কমার্শিয়াল ডেভলপমেন্ট একদম হচ্ছে না। আমার মনে হয়, কোনও শহরের বেড়ে ওঠার জন্য এই দিকটার খুব দরকার। এ কারণে ইকনমিক ডেভলপমেন্টের দিকে আরও নজর দিলে সব দিক থেকে ভাল হত। বাঙালি বরাবরই ট্যালেন্টেড, কিন্তু যখন দেখি তাদের উপস্থিতিটা কলকাতা থেকে সরে যাচ্ছে, তখন খুব খারাপ লাগে।
অনুলিখন: পিয়ালী দাস
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy