Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Shiboprasad Mukherjee

‘ইচ্ছে’ দেখে হল থেকে বেরিয়ে এক প্রযোজক বলেছিল, পর্দায় সোহিনীকে দেখে আমার ঘেন্না হচ্ছে!

প্রথম ছবিতে এত মোটা নায়িকা! বেঁকে বসেছিল গোটা ইন্ডাস্ট্রি। স্থূল চেহারার নায়িকা হলেই নানা বিড়ম্বনা। তা-ও কেন হার মানেননি নন্দিতা রায়-শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়? কলম ধরলেন শিবপ্রসাদ।

Image of Samadarshi and Sohini sen.

ইন্ডাস্ট্রির প্রায় সব প্রযোজকই ‘ইচ্ছে’-র কাহিনি শুনেছিলেন, সবাই চোখের জল ফেলেছিলেন। ছবি: সংগৃহীত।

শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়
শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৭ মে ২০২৩ ১৩:১৩
Share: Save:

একটি মোটা মায়ের গল্প

ফাটাফাটি: কিস্তি ১

আমাদের প্রথম সিনেমা ‘ইচ্ছে’-র মা কী রকম দেখতে হবে, সেটা নিয়ে খুব জল্পনা-কল্পনা ছিল। এক দিন দেশপ্রিয় পার্কে হাঁটতে গিয়ে দেখলাম, এক জন মোটা মা তার বাচ্চাকে সঙ্গে নিয়ে আসছেন। তার চুল উস্কোখুস্কো। দেখেই বোঝা যায়, নিজের প্রতি কোনও যত্নই যেন কোনও দিন নেননি, সবটাই তাঁর সন্তানকেই দিয়ে দিয়েছেন। চোখ দিয়ে অঝোরে জল পড়ছে এবং তিনি বলতে বলতে আসছেন, ‘‘আমার সব স্বপ্ন শেষ করে দিলি?’’ ছেলেটি মাথা নিচু করে মায়ের সঙ্গে আসছে। এই দৃশ্য দেখে আমি দৌড়তে দৌড়তে নন্দিতাদির বাড়িতে এলাম। এসে বলেছিলাম, ‘‘আমাদের মা যদি সোহিনী সেনগুপ্ত হয়!’’ নন্দিতাদি এক মুহূর্তে রাজি হয়েছিলেন। ব্যস, সোহিনীর সঙ্গে কথা বলে রাজি করানো হল।

কিন্তু এর পরের লড়াইটা ভয়ঙ্কর ছিল। ইন্ডাস্ট্রির প্রায় সব প্রযোজকই ‘ইচ্ছে’-র কাহিনি শুনেছিলেন, চোখের জল ফেলেছিলেন। কিন্তু কেউই রাজি ছিলেন না এই কাস্টিংয়ে ছবি বানাতে। কেন না, মোটা হিরোইন নিতে কেউ রাজি নন। এক এক করে তাঁদের নাম আমার পক্ষে বলা উচিত হবে না। জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত, নামডাকওয়ালা এক প্রযোজক আমাকে বলেছিলেন, ‘‘মা মোটা হলে হবে না, পর্দায় মাকে গ্ল্যামারাস লাগতে হবে।’’ মায়ের চরিত্রে বেশ কয়েক জন প্রথম সারির নায়িকার কথা বলেছিলেন আর ছেলের চরিত্রেও বেশ কয়েক জন সেই সময়ের তরুণ নামডাকওয়ালা ছেলের নামও বলেছিলেন। কিছুতেই মন সায় দেয়নি। সেই প্রযোজকের সঙ্গে কাজ করতে সবাই আগ্রহী ছিল। কিন্তু আমরা রাজি হতে পারিনি। মনে হয়েছিল, সেই অভিনেত্রীকে দরকার, সেই মাকে দরকার, যাকে দেখেই মনে হবে যে তার সর্বস্ব এই ছেলেটির জন্য দিয়ে দিয়েছে, আমাদের তাকেই চাই।

ফাটাফাটি: কিস্তি ২

আট বছর অপেক্ষা করতে হয়েছিল ‘ইচ্ছে’ করতে, যে হেতু নবাগত পরিচালক, কোনও অভিজ্ঞতা নেই সিনেমা করার। জীবনে টেলিভিশনেও কোনও ফিকশন বানায়নি। দ্বিতীয় তরুণ নবাগত হিরো, তৃতীয় হিরোইন মোটা। কাজেই, ছবি তৈরি হওয়ার পর সেই ছবি বিক্রি করতে লেগে গেল আরও তিন বছর। ২০০৮-এ যে ছবি বানিয়েছিলাম ২০১১-তে এসে সেই ছবি মুক্তির আনন্দ পেল। ‘ইচ্ছে’ মুক্তি পাবে, এটাই ছিল বিরাট বড় আনন্দ আমাদের কাছে। ‘ইচ্ছে’ মুক্তি পাওয়ার ঠিক আগে এই ইন্ডাস্ট্রির নামডাকওয়ালা প্রযোজক-পরিবেশকদের জন্য একটি ক্লোজড-ডোর শো-এর ব্যবস্থা করা হয়েছিল সল্টলেকের তৎকালীন এক ল্যাবে। ভিতরে আমাদের সিনেমার প্রথম শো চলছে আর আমরা উদ্‌গ্রীব হয়ে বাইরে অপেক্ষা করছি। সিনেমা শেষ হল, এক জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত প্রযোজক হল থেকে প্রথম বেরোতেই আমরা তাঁর কাছে গেলাম অনেক আশা নিয়ে। তিনি বললেন, ‘‘শেষ করে দিলেন সিনেমাটা, এই মেয়েটাকে কেউ হিরোইন নেয়? জঘন্য লাগছিল, বমি আসছিল ওকে দেখে আমার। পুরো পর্দা জুড়েই তো ও, কী করলেন আপনি! এত ভাল গল্পটা মার্ডার করে দিলেন! আমার ঘেন্না করছিল এই ছবিটা দেখতে। মার্ডার করে দিলেন এই সিনেমাটার।’’ এই কথাটা বলতে বলতেই তিনি চলে গেলেন। জীবনের প্রথম সিনেমার, প্রথম দর্শকের প্রথম অভিব্যক্তি সারা জীবন মনে থাকবে।

‘ইচ্ছে’ যে তৈরি হয়েছিল আর ‘ইচ্ছে’ যে মুক্তি পেয়েছিল তার জন্য দু’জনকে ধন্যবাদ দিতেই হয়, ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত এবং রাকেশ সিংহ। কেন যে তাঁরা রাজি হয়েছিলেন এই ছবির পাশে দাঁড়াতে এবং এই ছবিতে টাকা ঢালতে, সেটা ভগবানই জানেন।

Image of Shibaprasad Mukherjee.

অভিনেত্রী মোটা কিংবা রোগা সেটা বড় কথা নয়, অভিনেত্রীর অভিনয়টা বড় কথা। ছবি: সংগৃহীত।

ফাটাফাটি: কিস্তি ৩

‘ইচ্ছে’ মুক্তি পেল ১৫ জুলাই ২০১১। প্রথম তো আমরা বিশ্বাসই করতে পারিনি যে এই ছবি কোনও দিন মুক্তি পাবে। প্রিমিয়ারের রাত, আনন্দে ভেসে যাচ্ছি, ছবি কেমন হবে, মানুষ আদৌ ভালবাসবেন কি না, সেই নিয়ে আমাদের কোনও খেয়াল নেই। শুধু একটাই আনন্দ যে, সবাই বলেছিলেন, ‘‘ছবিটা কোমায় চলে গিয়েছে।’’ আমার এক প্রযোজক বন্ধু বলেছিলেন, ‘‘তুই এই সিনেমাটার কথা ভুলে যা, একটা ডিভিডি দিচ্ছি রিমেক বানিয়ে দে।’’ তিনি বিশ্বাস করতে পারেননি, ‘ইচ্ছে’ মুক্তি পেয়েছে। প্রিমিয়ারের দিন মধ্যরাতে একটা ফোন পেলাম এমন এক জনের, যিনিও জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত পরিচালক। অনেক আশা নিয়ে ফোনটা ধরেছি কী বলেন শুনতে। তিনি বললেন, ‘‘পর্দার একটা গ্ল্যামার আছে শিবু, সে গ্ল্যামারটাকে উপেক্ষা করা যায় না। আমার সিনেমাটা ভাল লাগেনি।’’ আমি অপর প্রান্তে নিশ্চুপ। তিনি আরও বলেন, ‘‘কিন্তু, তুমি সোহিনীকে নিয়ে একটা গ্যাম্বল করেছ। এই জুয়াটা যদি তুমি জিতে যাও, তা হলে ছবিটা ব্লকবাস্টার হবে। সিনেমার সব কিছুই দাঁড়িয়ে রয়েছে সোহিনীর কাস্টিংয়ে। দর্শক সোহিনীকে অ্যাকসেপ্ট করবে কি না দেখা যাক। আমরা মোটা হিরোইনদের নায়িকা হিসেবে অ্যাকসেপ্ট করি না কিন্তু শিবু।’’

‘ইচ্ছে’ মুক্তির পরের দিনের ঘটনা। সব হলেই দুপুরবেলারই শো পেয়েছিল। মাল্টিপ্লেক্সে দুপুর ১২টার শো পেয়েছিল এবং সেগুলো শনিবার দিনেই যে নেমে যাবে সেটা প্রায় জেনেই গিয়েছিলাম আগে। ম্যাটিনি-শো কয়েকটা জায়গায় টিকে ছিল। আমার পরিবেশক আমায় বলেছিলেন, ‘‘দেখুন, ছবিটা স্টেল হয়ে গিয়েছে।’’ মানে ইন্ডাস্ট্রির ভাষায় পুরনো হয়ে গিয়েছে, ‘‘রিলিজ় করার জন্য করা হয়েছে, কষ্ট পাবেন না। আপনি নতুন পরিচালক, আর আপনার কাস্টিংয়ে তো নাম-টাম কেউ নেই। তার উপর হিরো নতুন, হিরোইন তো বুঝতেই পারছেন একটু মোটা, ওটা দর্শক ঠিক দেখতে চান না। পরে যখন হিরোইন নেবেন, মানে… বুঝতে পারছেন তো? একটু নামডাক, আসলে অডিয়েন্স পোস্টারে একটা ফেস দেখতে চায়!’’

‘ইচ্ছে’ মুক্তি পাওয়ার পর, সব শত্তুরের মুখে ছাই দিয়ে ১২৫ দিন পার করেছিল এবং প্রচুর ভালোবাসা কুড়িয়েছিল। যে পরিচালক মাঝরাতে ফোন করে বলেছিলেন, ‘‘পর্দা গ্ল্যামার চায়’’, সেই পরিচালকই ‘ইচ্ছে’-র চার সপ্তাহ বাদে আমাকে বলেছিলেন, ‘‘সাংবাদিকদের বলো যে, আমি তোমায় প্রথম বলেছি ছবিটা ব্লকবাস্টার হবে।’’ যে প্রযোজক বলেছিলেন যে, সিনেমাটা দেখতে তাঁর বমি পাচ্ছে, তিনি আমাকে তাঁর পরের তিনটি সিনেমা করতে দিতে চেয়েছিলেন। আর যে প্রযোজক বলেছিলেন যে মোটা হিরোইন চলে না, গ্ল্যামারাস হিরোইন চলে, তিনি আজও আক্ষেপ করে যান, ‘ইচ্ছে’ না করার জন্য। আর যে পরিবেশক বলেছিলেন পোস্টারের গ্ল্যামার চাই, মোটা হিরোইন চলে না, তিনি ‘ইচ্ছে’-র ১০০ দিনের পার্টিতে এসেছিলেন আর আমার হাত ধরে বলেছিলেন, ‘‘আপনার হিরোইনই কিন্তু এই ছবির জান। আপনি ঠিক, আমি ভুল। আমার ছবির চিনতে ভুল হয়ে গিয়েছিল। কী অভিনয়টাই করেছে বলুন তো! আমার বৌ বলেছে যে, আমি নিজেকে দেখতে পাচ্ছিলাম।’’

‘ইচ্ছে’ মুক্তি পাওয়ার পর এক দিন আমাদের অফিসের সামনে প্রচুর মহিলার জটলা, আমি অফিসের সামনে যেতেই ওঁরা আমায় ঘিরে ধরলেন। ‘‘এটা পারলেন কী করে?’’ আমি তাকিয়ে রয়েছি, আবার মহিলারা বলে উঠলেন সমস্বরে, ‘‘এটা পারলেন কী করে? মা-রা কষ্ট করবে, নিজের সর্বস্ব দিয়ে দেবে আর ছেলে মাকে ছেড়ে চলে যাবে? এ হতে পারে না, ছেলেকে ঘরে ফিরিয়ে আনুন। আমরা নিতে পারছি না’’

সোহিনীর অভিনয়ের জয় ছিল এখানেই, সব মহিলাই সোহিনীর মধ্যে নিজেকে খুঁজে পেয়েছিলন। অভিনেত্রী মোটা কিংবা রোগা সেটা বড় কথা নয়, অভিনেত্রীর অভিনয়টা বড় কথা। একটা মানুষের শরীরটা বড় কথা নয়, তার মন, তার অন্তর যেন বড় হয়, ‘ফাটাফাটি’ ছবি সেই কথাই বলে। ‘‘আমরা মোটা হতে পারি কিন্তু আমাদের জীবনটা মোটামুটি নয়, ফাটাফাটি’’!

আর মোটা হিরোইনরা সব সময়ই আমার জন্য একটু বেশি লাকি , সে ‘ইচ্ছে’-ই বলুন, আর ‘প্রাক্তন’-ই বলুন।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy