‘পদাতিক’ ছবিতে মৃণাল সেনের চরিত্রে চঞ্চল চৌধুরী। ছবি: সংগৃহীত।
‘‘হাজার বছর ধরে দেখছি ইতিহাস/ দারিদ্রের ইতিহাস/ বঞ্চনার ইতিহাস/ শোষণের ইতিহাস।’’ দারিদ্র, বঞ্চনা আর শোষণের পথ পেরিয়ে যাঁরা সূর্য রচনা করেন, মৃণাল সেন তাঁদের প্রতিনিধি। সাবলটার্ন মানুষের অসহায়তা, কলকাতার আটপৌরে রংচটা যাপনকে লেন্সের মিলিমিটারের বাঁধনে মৃণাল সেন বেঁধেছেন বার বার। আর সেই পদাতিক সৈন্যকে পরিচালক সৃজিত মুখোপাধ্যায় বাঁধলেন মাল্টিপ্লেক্সের প্রিভিলেজড দর্শকের ধ্যানবিন্দুতে। সৃজিত নিজের অজান্তেই তৈরি করলেন ইতিহাস। বায়োপিক হিসাবে ভারত-বাংলাদেশ যৌথ উদ্যোগে নির্মিত ‘পদাতিক’ নিঃসন্দেহে সৃজিতের মাস্টারস্ট্রোক হতে চলেছে, তা হয়তো থিয়েটার ফেরত দর্শক আর কিছু দিনের মধ্যেই প্রমাণ করবেন। ২০২৪-এর ১৫ অগস্ট যখন হলে বসে ছবিটি দেখছি, তখন মাথায় ঘুরছে আরজি কর, কলকাতার বিনিদ্র প্রতিবাদী রাত্রিযাপন আর তার সঙ্গে উত্তাল বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তন। এই মাহেন্দ্রক্ষণে ফুটে উঠছে অশীতিপর এক বৃদ্ধের ছবি। ক্যামেরার টাইট ফ্রেমে চৌকোনা আয়নায় ভেসে ওঠা জীর্ণ একটি মুখ। বৃদ্ধ মৃণাল সেন— ফ্ল্যাশব্যাকে রেডিয়োর প্রভাতী সুর, ‘কলকাতা ৭১’-এর গুলিবিদ্ধ ছেলেটির শরীর। পরিত্যক্ত ইতিহাসের চোরাস্রোতে ভাসমান শূন্য রাজবাড়ির স্তম্ভের মাঝে হেঁটে চলা মৃণাল খুঁজছেন তাঁর অতীতকে। অতীত আর বর্তমানকে ফ্ল্যাশব্যাক আর ফ্ল্যাশ ফরোয়ার্ডে বেঁধে সৃজিত তৈরি করেছেন এক অনবদ্য কোলাজ। খুব সহজ ছিল না কাজটি। কারণ, এক দিকে অভিনবত্ব রয়েছে এই ছবির দুই মূল অভিনেতা কোরক সামন্ত আর চঞ্চল চৌধুরীকে একেবারে কলকাতার আমজনতার মাঝখান থেকে তুলে নিয়ে এসে উপস্থাপন করায়। অন্য দিকে, ন্যারেটিভ চরিত্র থেকে বেরিয়ে এসে এই দুই অভিনেতার অভিনীত চরিত্রগুলিকে মৃণাল সেন পরিচালিত ছবিগুলির সিকোয়েন্সে মিলিয়ে দেওয়া। এর সঙ্গে আরও একটি দুঃসাধ্য কাজ সম্পন্ন করলেন সৃজিত। মৃণাল সেনের জীবনের সঙ্গে তাঁর পরিচালিত ছবির দৃশ্যায়নকে মিলিয়ে দিলেন তিনি। তবে এ কথা ঠিক, এই ত্রিবিধ মেলবন্ধনে যে ছবি গড়ে উঠেছে, সেই ছবিকে বুঝতে হলে মৃণাল সেনের ছবিগুলি আত্মস্থ করে আসা প্রয়োজন। না হলে এ ছবির বেশ কিছু টুইস্ট থেকে দর্শক রসবঞ্চিত হবেন।
ফরিদপুরের স্বাধীনতা সংগ্রামী মৃণাল কী ভাবে কলকাতায় এসে কমিউনিস্ট মৃণালে পরিণত হলেন, তা যেমন এ ছবি দেখিয়েছে, তেমনই আবার পরিচিত বন্ধুবর্গের চায়ের কাপে তুফান তোলা তর্কে নিৎসে ও রবীন্দ্রনাথকে শ্রেণিশত্রু বানানোর বিরোধিতার দৃশ্যগুলিও প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে। রবীন্দ্রনাথের শেষযাত্রা থেকে ১৯৪৩-এর মন্বন্তর আর নকশাল আন্দোলনের প্রেক্ষিতে মাথায় ঘুরপাক করতে থাকা সিনেমাপাগল লোকটি কেমন করে তার চরিত্রগুলিকে খুঁজে পাচ্ছেন রোজনামচায়, তা দর্শককে নস্ট্যালজিক করে তুলবেই। অথচ মৃণাল সেন নিজে নস্ট্যালজিয়া পছন্দ করতেন না— এই বার্তাও স্পষ্ট ভাবে দিয়েছেন সৃজিত। তুলে ধরেছেন চলচ্চিত্রের আরও দুই কিংবদন্তির সঙ্গে সখ্যের সম্পর্ক। ‘‘কিন্তু খালি পেটে ধর্ম বা সিনেমা, কোনওটাই হয় না।’’— এই ধ্রুবসত্যকে তুলে ধরেছেন মৃণালের বয়ানে সৃজিত। মেডিকেল রিপ্রেজ়েন্টেটিভ মৃণালের জীবনের তীব্র হতাশার দহন, উন্মুক্ত বিবস্ত্র শরীরে আত্মজিজ্ঞাসার দৃশ্য শিল্পমণ্ডিত হয়ে উঠেছে। তার সঙ্গে বিশেষ কৃতিত্বের দাবিদার কোরক ও চঞ্চলের সম্পৃক্ত অভিনয়। নেপথ্যে টুপ টুপ করে পড়া জলের শব্দ একঘেয়ে জীবনের প্রতিভূ। আর একটি দৃশ্যে পরিচালক বিশেষ কৃতিত্বের দাবিদার। পাসোলিনি, দে সিকা-র ছবির জগতে ভেসে বেড়ানো মৃণাল নিজস্ব ছবি বানানোর স্বপ্নে পাগলের মতো প্রযোজক খুঁজে চলেন। সেই খোঁজার মাঝে আসে গীতার সঙ্গে প্রেমের দৃশ্য। ‘দ্য কেস ফর কমিউনিজ়ম’ গঙ্গার জলে ভাসিয়ে অন্তরঙ্গতায় বাঁধা মৃণাল আর গীতা যেন বলে ওঠে আজকের কবির কথা— ‘‘অতল তোমার সাক্ষাৎ পেয়ে চিনতে পারিনি বলে/ হৃদি ভেসে যায় অলকানন্দা জলে।’’ ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোরে সানাইয়ের শব্দের সঙ্গে মিশে যায় রবীন্দ্রনাথের গান। ঠিক এইখানে সৃজিত ব্যবহার করলেন মৃণাল সেনের একটি ট্রিটমেন্টকে। চলচ্ছবির মাঝখানে একটি করে স্থিরছবি প্রয়োগ করে ছবির ন্যারেটিভকে আরও অবচেতনে গেঁথে দেওয়া। সৃজিত গাঁথলেন মৃণাল-গীতার বিয়ের বেশ কয়েকটি ফোটোগ্রাফকে। বিয়ের পরের দাম্পত্যে কাঁটা বেঁধাল দারিদ্র। মৃণাল সেনের দারিদ্রপূর্ণ সংসারের সঙ্গে সৃজিত মিলিয়ে দিলেন ‘বাইশে শ্রাবণ’-এর ফুটেজ। গীতা সেনের চরিত্রে মনামী ঘোষ কখনও মিশে গেলেন মাধবীতে। এক দিকে ‘রাত-ভোর’-এর মতো টিপিক্যাল ছবি বানানোর ফ্রাস্ট্রেশন, অন্য দিকে মৃণাল-গীতার সন্তানের জন্মের পর সেই সন্তানকে প্রতিপালনের দুশ্চিন্তায় ও অভাব-অনটনের সঙ্গে লড়াই করে দিন কাটানো পিতার ক্লান্তিহীন বিনিদ্র রাতে বেজে ওঠে রূপঙ্কর বাগচীর গলায় ‘‘ও আলোর পথযাত্রী...’’। সঙ্গীত পরিচালক ইন্দ্রদীপ দাশগুপ্তকে কুর্নিশ জানাই অনবদ্য সঙ্গীতায়োজনের জন্য। তার সঙ্গে সৃজিত তৈরি করলেন এক যথাযথ দৃশ্যায়ন। এক দিকে বিলাসবহুল গ্র্যান্ড হোটেল, অন্য দিকে কলকাতার শূন্য রাজপথে দারিদ্রের অসহ্য বোঝা নিয়ে একা পথ হাঁটছেন মৃণাল। অনবদ্য অভিনয়ে চোখের ভাষার সঙ্গে মনের ভাষাকে এক করে দিয়ে গীতা সেন তথা মনামী ঘোষ স্বামী মৃণালকে বলে উঠছেন— ‘‘এত অল্পে ভেঙে পড়লে চলবে কমরেড? এখনও তো অনেক লড়াই বাকি। অনেক রক্তক্ষরণ বাকি।’’ ঠিক সেই মুহূর্তে আবহে ভেসে আসে ‘‘আহ্বান, শোনো আহ্বান...’’।
এর পর জীবনের পালাবদল। পুত্র কুণালের বড় হয়ে ওঠা, ফ্ল্যাশব্যাকে কুণালের ছেলেবেলার দৃশ্যে পুত্রের মূল্যবোধে অনাহারের দৃশ্যরোপণ মন ছুঁয়ে যায়। কুণালের সঙ্গে কথোপকথনে উঠে আসে ‘নীল আকাশের নীচে’ ছবির কথা। ‘মহাপৃথিবী’র গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে পিতা-পুত্রের গঠনমূলক সমালোচনা। বলা বাহুল্য, হার্ট-মাইন্ড-সোল— এই তিনটিকে সমপর্যায়ে উন্নীত না করলে মৃণাল সেন হওয়া যায় না। যিনি পাঁচ ঘণ্টায় ‘ভুবন সোম’-এর মতো ছবির চিত্রনাট্য লিখতে পারেন, চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি সত্যজিৎ রায়ের ছবির ভুলগুলি পরিচালকের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে পারেন। ঠিক এইখানে সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের প্রতি আমার একটি অনুযোগ রয়ে গেল। বেশ তো থিয়েটারকর্মী একঝাঁক তরুণ মুখকে যথাযথ ভাবে ছবিতে ব্যবহার করলেন! জীতু কমলকে সত্যজিতের চরিত্রে ব্যবহার করে পরিচালক অনীক দত্তের পদাঙ্ক কেন অনুসরণ করতে হল? মৃণাল সেনের চরিত্রে চঞ্চল চৌধুরী তাঁর যথার্থতা প্রমাণ করেছেন অনায়াসেই। কিন্তু জীতু কমলের পুনরাবৃত্তি ও সত্যজিতের কণ্ঠস্বরের অহেতুক অনুকরণ কেমন যেন কানে বাজছে। সস্তার ক্লোন এবং প্রোটোটাইপ চরিত্র থেকে মৃণাল সেন বেরিয়ে আসতে চেয়েছেন সব সময়। সৃজিত সেটা করতেই পারতেন। এ ছাড়া সত্যজিৎ রায়ের বেশ কিছু উপস্থিতি সংক্ষিপ্ত হতে পারত ছবিতে। বরং সত্যজিৎ-মৃণালের রসিকতার দৃশ্যটি মনোগ্রাহী। যে ব্যক্তি সর্ব সময়ে অন্যের থেকে দেশলাই নিয়ে সিগারেট ধরাতেন, তিনি যখন রায়বাবুর সামনে নিজের পকেট থেকে দেশলাই বার করে সিগারেট ধরাচ্ছেন, রায়বাবুর নোটিসে বেশ মজার হয়ে উঠেছে দৃশ্যটি। মৃণাল সেনের কাছে সত্যজিৎ রায়ের অমোঘ স্বীকারোক্তি— ‘‘আই ফিল টেরিবলি লোনলি..’’— মনের মধ্যে মোচড় দিয়ে ওঠে।
এই একাকিত্বকে দূরে সরিয়ে মৃণাল হাঁটলেন রেড রোডে। পাশে ভিড় করে দাঁড়িয়ে থাকা তাঁর শ্রেষ্ঠ চরিত্রগুলির উত্তোলিত হাত আর ব্যাকগ্রাউন্ডে ‘‘তু জ়িন্দা হে...’’ অনবদ্য দৃশ্যায়ন। এ ভাবেই পরিসমাপ্তি ঘটে শিরদাঁড়া সোজা রেখে বাংলা সিনেমাকে বিশ্বের দরবারে স্থাপনার নায়কোচিত ‘কাট ইট’ উচ্চারণে।
যাঁর কথা না বললেই নয়, তিনি সোমনাথ কুন্ডু, এই ছবির রূপটান শিল্পী। অনবদ্য প্রস্থেটিক রূপটানে মনামীকে বৃদ্ধা গীতা সেন করে তোলা, তাঁর মুকুটে পালক তো পরাবেই! পোশাক পরিকল্পনায় সাবর্ণী দাস যথাযথ। শিল্প নির্দেশনায় তন্ময় চক্রবর্তীও বিশেষ কৃতিত্বের দাবিদার। চিত্রনাট্য, সংলাপ ও পরিচালনায় সৃজিত মুখোপাধ্যায় এ ছবির ক্ষেত্রে এগিয়ে থাকবেন অনেকটাই। কিন্তু সম্পাদনায় আরও একটু যত্নশীল হওয়া প্রয়োজন ছিল। তবে এ কথা ঠিক, পূর্বসূরি পরিচালকের বায়োপিক নির্মাণ করতে গিয়ে সৃজিত ‘গা বাঁচিয়ে নিরাপদ ভাবে’ এগোননি। এগিয়েছেন আপন মর্জিতে, আপন সৃষ্টির খেয়ালে। তাই চিরায়ত কলকাতার রাজপথ তাঁকেও স্যালুট জানাবে নিঃসন্দেহে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy