Advertisement
E-Paper

‘রবি কিরণে’ আলোকিত কেবল শুরুটা, বাকি কিরণের বৈপ্লবিক চিন্তাশৈলী

কিরণ রাও পরিচালিত ‘লাপতা লেডিজ়’ ছবিটি দেখল আনন্দবাজার অনলাইন।

review of ‘Laapata Ladies’ dgtl

‘লাপতা লেডিজ়’ ছবির পোস্টার। ছবি: সংগৃহীত।

সংযুক্তা বসু

শেষ আপডেট: ০৪ মে ২০২৪ ১৪:৩১
Share
Save

তখন স্মার্টফোন ছিল না, সোশ্যাল মিডিয়ার এত কেতা ছিল না। খবর আদানপ্রদানের এত বিচিত্র মাধ্যম ছিল না। মেসেঞ্জারে, হোয়াট্‌সঅ্যাপে, ফেসবুকে মনের খবর, বাস্তবের ঘটনা, বা নানা ধরনের কেচ্ছা-কেলেঙ্কারির রসালো বার্তা ভেসে উঠত না। সময়টাই ছিল আলাদা। হাতে-হাতে ঘুরত ছোট-ছোট বোতামটেপা মোবাইল ফোন। যাতে শুধু মেসেজ করা যায় আর চলমান অবস্থায় কথা বলা যায়।

ধরা যাক, সালটা ২০০১। জানুয়ারি মাস। এমনই এক সময়ের পটভূমিতে তৈরি হয়েছে পরিচালক কিরণ রাওয়ের ছবি ‘লাপতা লেডিজ়’। আমির খান প্রোডাকশনের এই ছবিকে একবাক্যে বলে দেওয়া যায় নিখুঁত, সূক্ষ্ম, এবং প্রতি স্তরে পরিপাটি আঙ্গিকে গড়া। যেখানে হালকা বিনোদনের সঙ্গে মিশেছে গাঢ়-গভীর বক্তব্য ও অনুভূতি। হাসির সঙ্গে মিশে গিয়েছে চোখের জল। যাতনা। সামাজিক ব্যঙ্গ।

নির্মল প্রদেশ নামে একটি অঞ্চল। এই ভারতেরই কোনও এক ভূখণ্ড। সেখান থেকেই নববিবাহিত লাল চেলির ঘোমটা পরা দুই মেয়ে চলেছে শ্বশুরবাড়ি। তাদের এক জনের নাম জয়া (প্রতিভা রান্তা), আর এক জনের নাম ফুল (নিতাংশী গোয়েল)। নতুন বরেদের সঙ্গে দিব্যি চলেছিল তারা ভিড়ে ভিড়াক্কার ট্রেনে চেপে। কিন্তু হঠাৎ গন্তব্য গ্রাম এসে পড়ায় অন্যতম বর দীপক (স্পর্শ শ্রীবাস্তব) তাড়াহুড়োয় লালচেলিতে মুখ ঢাকা এক নতুন বৌকে নিয়ে স্টেশনে নেমে পড়ে। সে বুঝতেও পারে না, জীবনসঙ্গিনী হিসেবে যে বৌটিকে নিয়ে সে নামল, আসলে সে অন্য লোকের বৌ। জয়া। নিজের বৌ ফুল একহাত ঘোমটা টেনে চলল প্রদীপ (ভাস্কর ঝা) নামের এক অন্য পুরুষের সঙ্গে, যে আসলে জয়ার বর।

review of ‘Laapata Ladies’ dgtl

‘লাপতা লেডিজ়’ ছবির একটি দৃশ্য। ছবি: সংগৃহীত।

‘লাপতা লেডিজ়’-এর সমালোচনায় বৌ বদলের এই ভুলভুলাইয়া নিয়ে রবীন্দ্রনাথের ‘নৌকাডুবি’র কথা বার বারই উঠে আসতে দেখা যাচ্ছে । কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি, বৌ বদলের ওই ঘটনাটুকু ছাড়া আর কোনও মিলই নেই ‘নৌকাডুবি’র সঙ্গে ‘লাপতা লেডিজ়’-এর। গল্প বলার ভঙ্গিতে কিরণ আগাগোড়া স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখেছেন। বদলাবদলি হয়ে যাওয়া দুই নারীর স্বপ্ন আলাদা। জীবনকে অনুভব করার ধরনও আলাদা। কোথায় আলাদা, কেন আলাদা, বলতে গেলে পুরো কাহিনি বলে দিতে হয়। সে দিকে এগোলে দর্শকের বিস্ময় কমে যাবে। বিপ্লব গোস্বামীর মূল কাহিনি অবলম্বনে এই ছবিতে পরিচালক কিরণ জোর দিয়েছেন, কেমন করে হারিয়ে যাওয়া দুই ভিন্ন ভাবনার নারী দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তরে নিজেদের অস্তিত্ব ফিরে পায়, বেঁচে থাকার স্বপ্নে বিভোর হয় এবং নিরুদ্দেশ থেকে উদ্দেশ্যের দিকে এগিয়ে যায়, সেই দিকেই।

ছবিতে গ্রামীণ ভারতের ভাল-মন্দ, দুই রূপকেই বিশ্বাস্য করে তুলে অত্যন্ত ‘ডিটেল’ তৈরি করেছেন কিরণ। স্বল্পখ্যাত অভিনেতা-অভিনেত্রীদের প্রত্যেকের কাছ থেকে সেরা পারফরম্যান্স একশো ভাগ আদায় করেও নিয়েছেন দক্ষ কান্ডারির মতো। জয়ার চরিত্রে প্রতিভা রান্তার বিদ্রোহী ও স্পর্ধাময় অভিনয় ছবির দৃঢ় এক বাঁক। অন্য দিকে, দীপকের নিজের বৌ ফুলের ভুমিকায় নিতাংশী তার নামের মতোই কোমল, সরল এবং বুদ্ধিমতী। ফুলের ভূমিকা কোনও অংশে জয়ার চাইতে গৌণ নয়। দুই নায়িকাই পাল্লা দিয়ে সুঅভিনয় করেছেন।

review of ‘Laapata Ladies’ dgtl

গ্রাফিক: সনৎ সিংহ।

ছবিতে যাঁদের দেখে আপাতদৃষ্টিতে খল বা ‘নেগেটিভ’ চরিত্র বলে মনে হয়, তারাও যেন শেষমেশ ‘পজ়িটিভ’ চরিত্র হয়ে ওঠে। যেমন ধরা যাক, পুলিশকর্তা শ্যামের চরিত্রে রবি কিশন। তিনিই তো অবশেষে জয়াকে তার জীবনের লক্ষ্যপথে এগিয়ে দেন! এবং জয়ার স্বামীকে ঠেলে দেন উচিত পরিণামের দিকে। মানুষ যে ‘ভাল-মন্দ মিলায়ে সকলি’— তার ছাপ রেখে গিয়েছেন দুর্দান্ত অভিনয়ে রবি কিশন। ভাল লাগে তাঁর ক্ষণে ক্ষণে রং বদলানো রসিক মেজাজ। স্টেশনের চা-ওয়ালির চরিত্রে ছায়া কদমের জোরালো অভিনয় আলাদা ভাবে নজর কাড়ে।

ফুলের বর দীপকের চরিত্রে স্পর্শ শ্রীবাস্তব গ্রাম্য যুবকের ভুমিকায় সাবলীল ভাবে মানিয়ে গিয়েছেন। যথেষ্ট ‘অবজ়ারভেশন’ না থাকলে এই চরিত্র ফুটিয়ে তোলা যায় না। ফুলকে হারিয়ে ফেলার মানসিক কষ্ট, টানাপড়েন, আবার জয়ার প্রতি তার বন্ধুসুলভ মনোভাব চরিত্রটিতে সুন্দর এক মাত্রা যোগ করে। বিরল স্পর্শের উপস্থাপনা।

‘লাপতা লেডিজ়’ শুধু যে দুই নারীর জীবনের উথালপাথালের গল্প তাই নয়, এই ছবিতে নারীশিক্ষা, পণপ্রথা, রাজনীতির জালে কেমন ভাবে বিপদে পড়া সাধারণ মানুষ জড়িয়ে পড়ে– এই সব অনিবার্য প্রসঙ্গও এসেছে। গ্রাম্য প্রেক্ষাপটে আঁকা একটি কাহিনি সর্বত্রগামী হয়ে উঠেছে কিরণের বিচক্ষণ চিন্তা, ভাবনা, মনন ও শিল্পবোধে।

তা ছাড়াও অবশ্যই উল্লেখ করতে হয় সঙ্গীতের কথা। রাম সম্পথের শ্রুতিমধুর সঙ্গীত পরিচালনা এই ছবির উৎকর্ষের আর এক দিক। চরিত্রসৃষ্টি ও গল্প বলার সঙ্গে সুরেলা ভাবে মানানসই। ‘ও সজনী ক্যায়সে কাটে দিনরাত/ ক্যায়সে মিলে তেরি সাথ/ তেরি ইয়াদ সতায়ে’— অরিজিৎ সিংহের কণ্ঠে এই গান মনকে করে বিরহ-উদাস। শ্রেয়া ঘোষালের গাওয়া ‘ধীরে ধীরে উড়ে পুরবৈয়াঁ’ গানের মূর্ছনা দিয়ে ছবি যখন শেষ হয়, মন সত্যিই নিরুদ্দেশের পথিক হয়ে ‘লাপতা’ হয়ে যেতে চায়।

অতি চমৎকার শেষ দৃশ্যের ভাবনা। সে বর্ণনা তোলা থাক না হয় দর্শকদের সাক্ষী হওয়ার জন্য।

কমেডির সঙ্গে জীবনের রূপ-রস-গন্ধকে মিলিয়ে দিয়েছে ‘লাপতা লেডিজ়’-এর পরিমিত সম্পাদনা। ঘোমটা বা অবগুণ্ঠন যে আসলে এক ধরনের বন্দিত্ব, পুরুষতান্ত্রিক সমাজে সত্যকে লুকিয়ে রাখার ছল– এই বিষয়টিকে আরেঠারে শেষ পর্যন্ত মোক্ষম শ্লেষে বুঝিয়ে দিয়েছেন কিরণ রাও। অকপটে দেখিয়েছেন নির্লজ্জ বধূ-নির্যাতন। নারীর সম্মানহানি।

দু’ঘণ্টা দু’মিনিটের ছবিতে দম ফেলার সময় থাকবে না। সিনেমার সার্থকতা তো এই রকম বুদ্ধিদীপ্ত রুচির বিনোদনেই। সিনেমার সংজ্ঞা ও ভাষা পাল্টে যাওয়ার প্রতীক হয়ে থাকবে ‘লাপতা লেডিজ়’। অস্তিত্ব-সঙ্কটে হারিয়ে যাওয়া, বিভ্রান্ত নারীদের, আকাঙ্ক্ষিত জীবনে ফিরিয়ে আনুক এই ছবি। একটি গ্রামের কাহিনি হলেও আসলে কোথাও এই গ্রাম সারা পৃথিবীরই একটি ক্ষুদ্র সংস্করণ। যেখানে নানা রকম মানুষের বাস। আসলে, গ্রাম, শহর, দেশ, মহাদেশ পাল্টে পাল্টে যায়। ঘোমটাটাও বদলায়। লড়াইটা থেকে যায় একই রকম!

Laapataa Ladies Kiran rao Netflix Review Film Review

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

এটি একটি প্রিন্ট আর্টিক্‌ল…

  • এমন অনেক খবরই এখন আপনার হাতের মুঠোয়

  • সঙ্গে রোজ পান আনন্দবাজার পত্রিকার নতুন ই-পেপার পড়ার সুযোগ

  • ই-পেপারের খবর এখন শুধুই ছবিতে নয়, টেক্সটেও

প্ল্যান সিলেক্ট করুন

মেয়াদ শেষে নতুন দামে আপনাকে নতুন করে গ্রাহক হতে হবে

Best Value
এক বছরে

৫১৪৮

১৯৯৯

এক বছর পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।
*মান্থলি প্ল্যান সাপেক্ষে
এক মাসে

৪২৯

১৬৯

এক মাস পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।