‘ব্যোমকেশ ও দুর্গরহস্য’ ছবিতে দেব। ছবি: সংগৃহীত।
উত্তম কুমার, আবীর চট্টোপাধ্যায়, অনির্বাণ ভট্টাচার্যের মতো অভিনেতারা পর্দায় যে চরিত্রকে প্রাণ দিয়েছেন, সেই চরিত্রে কি দেবকে মানাবে? দর্শক-সমালোচকেরা বেশ সন্দিহান ছিলেন। কারণ, সেই চরিত্র তো যে-সে নয়। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের অমর সৃষ্টি ব্যোমকেশ বক্সী। যার সঙ্গে বাঙালির আবেগ এতটাই জড়িয়ে রয়েছে যে, পান থেকে চুন খসলেই বিপদ! দেব সুপারস্টার হতে পারেন, কিন্তু বুদ্ধিদীপ্ত খাঁটি বাঙালি সত্যান্বেষীর জুতোয় পা গলাতে পারবেন কি? ট্রেলার মুক্তির পরই সকলের যাবতীয় প্রশ্নের উত্তর খানিকটা দিয়ে দিয়েছেন দেব। এত বড় ক্যানভাসে ছবির ঝলক পেয়েই সকলে নড়চড়ে বসেছিলেন। এবং অপেক্ষায় ছিলেন ছবির মুক্তির। ১১ অগস্ট বড় পর্দায় দেবকে দেখে তাঁরা বাকি উত্তরটাও পেয়ে যাবেন।
কেমন হল ‘ব্যোমকেশ ও দুর্গরহস্য’? তিন শব্দে উত্তর দিলে দাঁড়ায়, ‘এন্টারটেনমেন্ট, এন্টারটেনমেন্ট, এন্টারটেনমেন্ট’। চিত্রনাট্যের প্রতিটা পাতায় যাতে বিনোদনের ভরপুর রসদ থাকে, সে দিকে নজর দিয়েছেন শুভেন্দু দাশমুন্সী। সোনাদার জনপ্রিয় ফ্র্যাঞ্চাইজ়ির গল্পগুলি লিখে ইতিহাসের সঙ্গে অ্যাডভেঞ্চার মেশানোয় হাত পাকিয়েছেন তিনি। তাই ব্যোমকেশকেও সহজেই ‘মাচো ফাইটার’ বানাতে পেরেছেন, অজিতের উপর জটায়ুর খানিক ছায়া আনতে পেরেছেন, রহস্য সমাধানের যাত্রার সত্যবতীকে সহযাত্রী করে তুলেছেন, গোয়েন্দা গল্পেও বেশ বেড়ানো আর ইতিহাসের স্বাদ এনেছেন (শেষেরটায় অবশ্য স্বয়ং শরদিন্দুবাবু অনেকটা পথ দেখিয়ে দিয়েছিলেন)। ফলে দর্শককে রহস্য, প্রেম, সম্পর্ক, ইতিহাস, কমেডি, অ্যাকশন— সব কিছু একসঙ্গে সাজিয়ে দেওয়া গিয়েছে। যাঁরা ব্যোমকেশ পড়েননি, তাঁদের এই ছবি দেখার অভিজ্ঞতা নেহাত মন্দ হবে না। সপরিবার হলে গিয়ে পপকর্ন খেতে খেতে হইহই করে দেখে আসতে পারবেন। যাঁরা ব্যোমকেশের একনিষ্ঠ পাঠক, তাঁদের বলে রাখা ভাল, গল্পের সঙ্গে মেলানোর বৃথা প্রয়াস না করাই ভাল। নানা রকম বদল করা হয়েছে চিত্রনাট্যে। বিশেষ করে ক্লাইম্যাক্স অনেক বেশি অ্যাকশনধর্মী।
উপন্যাস ও সিনেমা দুটি ভিন্ন মাধ্যম। তাই প্রয়োজন মতো গল্পের গতি বাড়ানোর জন্য অনেক কিছুই যোগ করা হয়ে থাকে সিনেমায়। সত্যজিৎ রায় নিজেও ফেলুদার গল্পগুলি পর্দায় খানিক বদলে নিয়েছিলেন। তবে এ ছবিতে যে বদলগুলি আনা হয়েছে, সেগুলি শুধুই ভিন্ন মাধ্যমের প্রয়োজনে নয়, বরং এক জন তারকার প্রয়োজনে। এখানে ব্যোমকেশ শুধুই সত্যান্বেষী নয়। সে রহস্যের সমাধান করে গল্পের শেষে সকলকে জড়ো করে শুধুই গল্প বলে না। বরং অপরাধী পালালে, তার পিছু নিয়ে রীতিমতো ধাওয়া করে তাকে হাতেনাতে ধরে। মগজাস্ত্রের সঙ্গে সে ক্যারাটের কেরামতিও ভালই জানে। প্রয়োজন পড়লে দুষ্কৃতীদের মেরে কুপোকাত করে দিতে পারে। সে একসঙ্গে অজিতের প্রিয় বন্ধু, সত্যবতীর যত্নবান স্বামী হওয়ার পাশাপাশি প্রেমিকও বটে। বৌয়ের সঙ্গে রোম্যান্সটাও করে নেয় রহস্য ঘাঁটতে ঘাঁটতেই। এমন এক বহুমাত্রিক চরিত্রে কতটা মানাল দেবকে?
মহাদেবের যেমন একাধিক রূপ, এই ব্যোমকেশেরও তেমন। বরাবরই তাঁর বাংলা উচ্চারণ নিয়ে অপ্রস্তুত হতে হয়েছে দেবকে। কিন্তু এখানে তাঁর উচ্চারণ এবং সংলাপ বলার ধরন— কোনওটা নিয়েই খুব বেশি অভিযোগ করার জায়গা নেই। বরং দেব জানেন তাঁর জোরের জায়গাগুলি। তাই বেশি করে অ্যাকশন বা চেজ সিকোয়েন্স রাখা হয়েছে চিত্রনাট্যে। এই ব্যোমকেশ বেশ কেতাদুরস্ত। সত্যবতী এবং অজিত তার হঠাৎ কোট-হ্যাট পরা নিয়ে রসিকতা করতে পারে। কিন্তু ব্যোমকেশকে দেখে কে বলবে, সে সদ্য এমন পোশাক পরা শুরু করেছে। পর্দায় ব্যোমকেশদের তালিকায় আবীর-যিশু-অনির্বাণের পাশে যাতে এখন থেকে তাঁর নামটাও উজ্জ্বল হয়ে থাকে, তার জন্য যথেষ্ট পরিশ্রম করেছেন দেব।
অজিতের চরিত্রে অম্বরীশ ভট্টাচার্যকে ভাবায় অনেকেই ব্যঙ্গ করেছিলেন। কিন্তু তাঁরা বোধ হয় ভুলে গিয়েছিলেন যে, কোনও দক্ষ অভিনেতার কাছে চেহারা কোনও দিনই বাধা হয়ে দাঁড়ায় না। এই গল্পে ব্যোমকেশ যেমন অন্য রকম, অজিতও তেমনই। তার সংলাপ লেখা হয়েছে দর্শককে খানিক হাসানোর জন্য। কোনও কোনও দৃশ্যে জটায়ুর কথা মনে পড়তে পারে। তবে অজিতের উপস্থিতি শুধুই কমিক রিলিফের জন্য নয়। ব্যোমকেশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সে-ও ‘সাসপেক্ট’দের জিজ্ঞাসাবাদ করে। গল্পে অজিতের মুখে যা যা সংলাপ ছিল, বা গুপ্তধন খোঁজায় তার যতটা অবদান ছিল, সিনেমায় তাতে খানিকটা ভাগ বসিয়েছে সত্যবতী ও ব্যোমকেশ। কিন্তু সে সব পুষিয়ে দিয়েছে অম্বরীশের অভিনয়। দেবের সঙ্গে তাঁর রসায়নও জমজমাট।
সত্যবতী হিসাবে রুক্মিণী মৈত্রকে কেমন লাগছে, তার আন্দাজ ট্রেলারেই পাওয়া গিয়েছিল। সাজপোশাক নিয়ে এই সত্যবতী পর্দার বাকি সত্যবতীদের চেয়ে বেশি সচেতন। তাই রুক্মিণীকে দেখতে দারুণ লেগেছে। অন্যদের চেয়ে এই সত্যবতীর পর্দায় উপস্থিতি এবং রহস্য উন্মোচনে অবদানও অনেক বেশি। শরদিন্দুর কলমে সত্যবতী ছিল বুদ্ধিমতী, শান্ত অথচ দৃঢ়। এই সত্যবতী খুব একটা শান্ত নয়। বেশ হাত-পা নেড়ে উচ্চস্বরে কথা বলে। সত্যবতী হিসাবে রুক্মিণী ছিলেন পরিচালক বিরসা দাশগুপ্তের পছন্দ। পর্দায় দেবের সঙ্গে তাঁর রসায়ন যে দারুণ, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। তবে সত্যবতী হিসাবে তাঁর শরীরী ভাষা কোথাও কোথাও একটু হলেও চোখে লাগে।
পার্শ্বচরিত্রে সকলেই ভাল অভিনয় করেছেন। তবে রজতাভ দত্ত, ঐশানী দে এবং বিশেষ করে সত্যম ভট্টাচার্যের নাম আলাদা করে উল্লেখ না করলেই নয়। সত্যম যে ইন্ডাস্ট্রিতে লম্বা রেসের ঘোড়া হতেই এসেছেন, তা তাঁর অভিনয়ে স্পষ্ট।
ব্যোমকেশকে ভরপুর বিনোদনমূলক পারিবারিক ছবি করে তোলার পিছনে পরিচালকের অবদান অনেকটাই। বাংলায় তাঁর শেষ ছবি ছিল ‘মুখোশ’। তার পর মূলত মুম্বইতেই কাজ করেছেন। বাংলায় ফিরলেন এই ব্যোমকেশের হাত ধরেই। তেমনই তাঁর হাত ধরে ব্যোমকেশও যেন বসার ঘরের বাইরে বেরোল। এর আগে কোনও ব্যোমকেশের ছবিই এই পরিসরে তৈরি হয়নি। গোয়েন্দা গল্পের মধ্যেই একটি দুর্গ যে গল্পের একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র, তা নিশ্চিত করেছেন পরিচালক। গল্পের গতি কোথাওই পড়তে দেননি এবং তাঁর অ্যাকশন দৃশ্যের পরিকল্পনাও প্রশংসনীয়। তবে বিরসার জন্য এগুলি নতুন নয়। তিনি বরাবরই ছবি তৈরির টেকনিক্যাল দিকগুলিতে দক্ষ।
ছবির কস্টিউম থেকে প্রোডাকশন ডিজ়াইন— সবই উচ্চ মানের। বিদেশি গোয়েন্দাদের মতো ব্যোমকেশের বাড়ির বসার ঘর, সিংহ বাড়ির অন্দরমহল, ইতিহাসে মোড়া দুর্গের আনাচকানাচ, সবই ভীষণ দৃষ্টিনন্দন করে তুলেছেন শিল্প নির্দেশক। এ ছবির বাজেটের একটি বড় অংশ রাখা হয়েছিল ভিএফএক্স-এর জন্য। গল্পে ইতিহাসের দৃশ্যগুলি কোথাওই খটকায়নি। আবার গুপ্তধন খোঁজার অংশও অবিশ্বাস্য লাগেনি। সাপের সঙ্গে দেবের লড়াই দর্শকের মনে ‘চাঁদের পাহাড়’-এর নস্ট্যালজিয়া উস্কে দিতে বাধ্য।
সব মিলিয়ে দর্শকদের হলে আনার জন্য সম্পূর্ণ প্যাকেজ তৈরি করেছেন দেব এবং বিরসা। যদিও দেব একাধিক বার বলেছেন, তিনি এর পর আর ব্যোমকেশ করবেন না, তবে কয়েক সপ্তাহ পার করে ছবির কালেকশন দেখার পর সিদ্ধান্ত না বদলে থাকতে পারেন কি না, এখন সেটাই দেখার।
ছবির আবহসঙ্গীত তারিফযোগ্য। গতি ধরে রাখার পিছনে ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোরের বড় অবদান রয়েছে। যে দু’টি গান ছবিতে ব্যবহার করা হয়েছে, তার কোনওটাই খাপছাড়া লাগেনি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy