‘আবার প্রলয়’ ওয়েব সিরিজ়ের একটি দৃশ্যে শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়। ছবি: সংগৃহীত।
দু’পাশে ম্যানগ্রোভের জঙ্গল। মাঝে নিস্তব্ধ নদীবক্ষ চিরে নৌকা এবং লঞ্চ এগিয়ে চলেছে। দূর থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই। যাত্রীদের মধ্যে রয়েছে নিস্তেজ কোনও তরুণী। কখনও বিয়ের অছিলা, কখনও আবার প্রেমের ফাঁদ— সুন্দরবনে জাঁকিয়ে বসেছে নারী পাচার চক্র। স্থানীয় প্রশাসন নাজেহাল। অগত্যা পরিস্থিতি ‘ঠান্ডা’ করতে কলকাতা থেকে ডাক পড়ে স্পেশ্যাল ক্রাইম ব্রাঞ্চের অফিসার অনিমেষ দত্তের। এই প্রেক্ষাপটেই তাঁর প্রথম ওয়েব সিরিজ় ‘আবার প্রলয়’-এর গল্প সাজিয়েছেন পরিচালক রাজ চক্রবর্তী।
দশ বছর পর ফের অনিমেষ দত্তকে (অভিনয়ে শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়) পর্দায় হাজির করলেন রাজ। ‘প্রলয়’-এর পর এ বার ওটিটিতে পা রেখেছে অনিমেষ। শুরু থেকেই অনেকেরই প্রশ্ন ছিল, ওয়েব সিরিজ় কেন? সিরিজ় দেখতে বসে তার কারণটা স্পষ্ট হয়। আসলে এই গল্পের সংলাপ বা কিছু দৃশ্য বড় পর্দায় দেখাতে চাইলে সেন্সর বোর্ডের কাঁচি এড়ানো হয়তো কঠিন হত। পাশাপাশি গল্পের পরিসর এবং চরিত্রও বেড়েছে। এক দিকে নারী পাচার চক্র, অন্য দিকে রয়েছে ভণ্ড বাবাজির আশ্রম। তিন বন্ধুর অতীত এবং বর্তমান। আর অবশ্যই সুন্দরবনের গা ছমছমে পরিবেশ। সব মিলিয়ে সুস্বাদু রান্নার আয়োজন ভালই করেছেন রাজ।
ট্রেলার থেকেই আন্দাজ পাওয়া গিয়েছিল ‘প্রলয়’ থেকে অনিমেষ এবং বিনোদবিহারী (পরান বন্দ্যোপাধ্যায়) ছাড়া সিরিজ়ে বাকি সবই নতুন চরিত্র। শুরুটা শাশ্বতকে দিয়েই করা যাক। আগের ছবির প্রায় মাঝে অনিমেষের আবির্ভাব ঘটেছিল। এ বার কিন্তু শুরু থেকেই সে স্বমহিমায়। বাণিজ্যিক ছবির শর্ত মেনে ঝাঁ-চকচকে ‘এন্ট্রি সিন’-এ পুলিশের টিমের তোয়াক্কা না করে একাই গুন্ডাদের ধরাশায়ী করেছেন শাশ্বত। চুলের ছাঁটে চমক থাকলেও গোঁফ এবং কালো সানগ্লাস কিন্তু বাদ যায়নি। মূল ছবিতে অনিমেষের সন্তানের আভাস পাওয়া গিয়েছিল। স্ত্রী ইন্দ্রাণী এবং ছেলে বরুণকে নিয়ে এখন তার ভরা সংসার। কাজের প্রতি একনিষ্ঠ অনিমেষ অপরাধীদের কাছে যমের মতো, কিন্তু বাড়িতে সেই স্ত্রীর কথায় ওঠে-বসে। দশ বছর পরেও শাশ্বতের ফিটনেস দেখে অনেকেরই ঈর্ষা হতে পারে। অন্ধকারে টর্চ নিয়ে বা চলন্ত বোটে সাবলীল ভাবে অ্যাকশন করেছেন। সঙ্গে রয়েছে অনিমেষের পরিচিত কিছু সংলাপ, শাশ্বতের মুখে যা শুনে দর্শক হাসতে বাধ্য।
‘প্রলয়’ ছবিতে বিনোদবিহারীকে ছাড়া অনিমেষের অভিযান পূর্ণতা পেত না। তবে এখানে পরান বন্দ্যোপাধ্যায়ের চরিত্রটির উপস্থিতি কিন্তু কম। যতটুকু সময় পেয়েছেন তাতেই অবশ্য তিনি দর্শকদের নজর কাড়বেন। বিশেষ করে তাঁর বাঁ কাধ ঝাঁকিয়ে নেওয়ার মুদ্রাদোষ দর্শককে ‘প্রলয়’-এর স্মৃতি উস্কে দেবে।
সিরিজ়ে চরিত্রের ভিড়। প্রত্যেকের উপরেই আলোকপাত করার চেষ্টা করা হয়েছে। স্থানীয়েরা সুন্দরবনের বাচনভঙ্গিতে কথা বলে। তবে তা কোথাও কোথাও আরোপিত মনে হয়েছে। শম্ভু বাবার চরিত্রে ঋত্বিক চক্রবর্তীর লুক নিয়ে পরিচালকের বিরুদ্ধে ‘অনুকরণ’-এর অভিযোগ উঠেছিল। ঋত্বিক কিন্তু তাঁর মতো করে চেষ্টা করেছেন। বরং স্থানীয় বাচনভঙ্গি আত্মস্থ করতে তিনি বাকিদের তুলনায় অনেকটাই এগিয়ে রয়েছেন। মোহিনী মায়ের চরিত্রে কৌশানী এই সিরিজ়ে চমকই বটে। মূল ধারার ছবির বাইরে তাঁর এই সাধারণ লুক আকর্ষণীয়। শম্পা এবং কানুর চরিত্রে যথাক্রমে সায়নী ঘোষ এবং গৌরব চক্রবর্তীর অভিনয় সাবলীল। তবে আলাদা করে নজর কেড়েছে সিরিজ়ের পুলিশবাহিনী। সোহিনী সেনগুপ্ত এবং লোকনাথ দে-র মজাদার অভিনয় সিরিজ়ের অন্যতম প্রাপ্তি। আর রাজ্যের সেচমন্ত্রী তথা নাট্যকর্মী পার্থ ভৌমিকের মুখে ‘হ্যালো স্যার’ সংলাপের কথা না উল্লেখ করলেই নয়। অনিমেষের সহকারীর ভূমিকায় দেবাশিস মণ্ডল মন্দ নন। এই সিরিজ়ে রয়েছেন একগুচ্ছ তরুণ অভিনেতা। ‘বড়’ অভিনেতাদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অভিনয় করেছেন তাঁরা। সামিউল আলম বা আর্য দাশগুপ্তেরা পরিচিত মুখ হলেও, বাকিরাও কোনও অংশে কম নন।
গল্পের শর্ত মেনে সিরিজ়ের গানগুলো তৈরি। ‘মেনকা খেলা হবে’ গানে আবার নুসরত ফারিয়াকে দেখা গিয়েছে। অমিত চট্টোপাধ্যায়ের আবহ সিরিজ়ের মেজাজ ধরে রেখেছে। মানস গঙ্গোপাধ্যায়ের ক্যামেরা সুন্দরবনের প্রকৃতি এবং জনজীবনকে বিশ্বাসযোগ্য ভাবে তুলে ধরেছে। তবে সম্পাদনায় দশ পর্বের এই সিরিজ়ের দৈর্ঘ্য আরও কিছুটা কমানো যেত। গল্প যতটা টানটান ভাবে শুরু হয়েছে, শেষের দিকে গল্প মেলাতে কোথাও কোথাও তাল কেটেছে। জলের নীচে গোপন ঘরের উপস্থিতি একটু অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে। সিরিজ়ের ভিএফএক্সও কোথাও কোথাও আশাপূরণ করতে পারেনি। সুন্দরবনের প্রেক্ষাপটে অভিনেতাদের পোশাক পরিকল্পনা বা রূপটানও যথাযথ। শুধু কয়েক জন মহিলা চরিত্রের চোখের নীলাভ ‘কনট্যাক্ট লেন্স’ একটু চোখে লাগে।
এক সময় বাণিজ্যিক ছবির হাত ধরে ইন্ডাস্ট্রিতে জায়গা করে নিয়েছিলেন রাজ। মাঝে অন্য ধারার ছবিতে হাত পাকালেও তিনি যে সাধারণ দর্শকের ‘পাল্স’ জানেন, ‘আবার প্রলয়’ তার অন্যতম প্রমাণ। সিরিজ়ের শেষে টুইস্টও রয়েছে। তাই পরিচালকের কাছে সিক্যুয়েলের আশা করাই যায়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy