মন্দার শেক্সপিয়রের মহাকাব্য হলেও তার প্রতিটি স্তরেই লুকিয়ে সমসাময়িক সমাজ, রাজনীতি ও মানুষের উচ্চাকাঙ্ক্ষার প্রতিচ্ছবি।
Fair is Foul, Foul is Fair...
গেইলপুর! এক রাক্ষস! আর ক্ষমতার বর্শায় গেঁথে যাওয়া কিছু মানুষ। উইলিয়াম শেক্সপিয়রের স্কটল্যান্ডের ট্র্যাজিক মহানায়ক ম্যাকবেথকে মন্দারে ভাবান্তরিত করে পরিচালক হিসেবে যাত্রা শুরু করলেন অনির্বাণ ভট্টাচার্য।
মৎস্যজীবী এক গ্ৰাম। গ্ৰাম নয়, নোনা সাগরের এক গভীর নগরী। এখানে চরিত্ররা সকলেই কাব্যিক ও আদিম, সকলেই লোভী- কেউ চায় রাজা হতে, কেউ রাজার পিতা, কেউ চায় সন্তান, কেউ চায় সন্তানের মঙ্গল। না চাওয়ার দলে কেবল তিন জন- এক বুড়ি, তার ন্যাড়া ছেলে ও তাদের পোষ্য কালো বেড়াল (শেক্সপিয়রের তিন ডাইনি)। কিন্তু তারাই নির্ধারণ করে গেইলপুরের ভাগ্য। মন্দারকে দেয় উচ্চাকাঙ্ক্ষার মন্ত্র। মালিক ডাবলু ভাইকে হত্যা করে রাজা হওয়ার খেলায় মেতে ওঠে সে। নপুংসক মন্দারের স্ত্রী তার শয্যাসঙ্গিনী হতে না পারলেও ক্ষমতার এই উন্মাদনায় তার ছায়াসঙ্গিনী। শুরু হয় গেইলপুরের ভাগ্যের এক অমোঘ নিয়তির পথে যাত্রা। বেইমানি, প্রতিশোধ, হত্যা, আত্মহত্যা মিলিয়ে চলতে থাকে এক অলৌকিক খেলা। খেলোয়াড়রাই এই খেলার ঘুঁটি হয়ে ওঠে। তার মধ্যেই আবির্ভাব এক অসৎ পুলিশ ‘মোকাদ্দার মুখার্জির’। রহস্যের জাল আরও গভীর জলে তলিয়ে যেতে থাকে। গল্পের চরিত্ররাও ক্রমশ ডুবে যেতে থাকে নিজেদের ভাগ্যের (দুর্ভাগ্যের) অতল সাগরে। সব কিছু গ্ৰাস করে নেয় ক্ষমতা নামক এক রাক্ষস।
মন্দার শেক্সপিয়রের মহাকাব্য হলেও তার প্রতিটি স্তরেই লুকিয়ে সমসাময়িক সমাজ, রাজনীতি ও মানুষের উচ্চাকাঙ্ক্ষার প্রতিচ্ছবি। ক্ষমতার লোভে যখন মানুষ বিসর্জন দিতে শুরু করে নিজের আদর্শ, সম্মান ও নৈতিকতা, তখন মন্দারের মতো এক অসুখ গিলে খায় গোটা অস্তিত্বকে। এই সিরিজে পূর্ব মেদিনীপুরের ভাষা ব্যবহার করে এক অনবদ্য সাহস দেখিয়েছেন পরিচালক ও লেখক। প্রান্তিক মানুষের গল্প বলার এক নতুন শৈলীর প্রচেষ্টা প্রশংসার দাবি রাখে। ট্যারান্টিনো বা অনুরাগ কাশ্যপের ছায়া থাকলেও মন্দার নিজ গুণে মৌলিক। সিরিজে নাটকের মতো দৃশ্যায়ন এক পরাবাস্তব পৃথিবীর সন্ধান দেয়। মোকাদ্দার এই সিরিজে চতুর্থ ডাইনি বা বিবেকের ভূমিকায়। যে বিবেক মানুষকে ‘ভাল’ হওয়ার পরামর্শ দেয় না। বরং মানুষকে আয়নার সম্মুখীন করে, তার লালসার আগুনের আঁচ বাড়িয়ে দূর থেকে দাঁড়িয়ে হাসে।
পরিচালক হিসেবে অভিষেকেই সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছেন অনির্বাণ ভট্টাচার্য। প্রতিটি দৃশ্যে কাব্যের বুনন করেছেন। অভিনেতা নির্বাচন থেকে ছবির দৃশ্য, সবটাই প্রায় নিখুঁত। সৌমিক হালদার তাঁর চিত্র গ্রহণে নিজেকেই যেন নতুন করে আবিস্কার করেছেন। প্রতিটি দৃশ্যে একটি করে ছবি এঁকেছেন তিনি। শুভদীপ গুহর আবহ এক এক সময়ে সিম্ফনির রূপ ধারণ করেছে।
মন্দারের ভূমিকায় দেবাশিস মণ্ডল তাঁর শরীর, মেধা, মনন দিয়ে ম্যাকবেথকে এক নতুন রূপ দিয়েছেন। সোহিনী সরকার (লাইলি) তার চাহনি দিয়ে এক অন্য উচ্চতায়ে নিয়ে গেছেন লেডি ম্যাকবেথকে। নিঃসন্দেহে এটা তার অন্যতম শ্রেষ্ঠ অভিনয়। শঙ্কর দেবনাথ(বঙ্কা), লোকনাথ দে(মদন), সুমনা মুখোপাধ্যায় (ডাবলু ভাইয়ের স্ত্রী) নিখুঁত এবং জীবন্ত। এই সিরিজের সম্পদ সজল মণ্ডল ও সুদীপ ধাড়া (ডাইনি বুড়ি ও তাঁর ছেলে)। অনির্বাণ ভট্টাচার্য (মোক্কাদার মুখার্জী) তাঁর নিপুণ কমিক টাইমিং দিয়ে এক অদ্ভুত আকর্ষণ সৃষ্টি করেন। তবে সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি ডাবলু ভাইয়ের ভূমিকায় দেবেশ রায়চৌধুরী। সব মিলিয়ে বহু দিন পরে বাংলার কোনও কাজে আমরা উপহার পেলাম দলগত অভিনয়। বাংলা সিরিজের ক্ষেত্রে এক জানালা এঁকে দিল ‘মন্দার’। সেই জানলা দিযে ঢুকে পড়ে এক নতুন আলোর দিশা। বাংলা সিরিজ ও তার দর্শককে পরিণত করবে সেই আলো।
সিরিজের প্রথম তিনটি পর্ব টানটান হলেও, শেষ দু’টি পর্বে গতি মন্থর হয়ে যায়। কিছু কিছু দৃশ্যে কিছু অতিনাটকীয়তা আছে, যা সব দর্শকের ভাল না-ও লাগতে পারে।
তবুও, এই ওয়েব সিরিজ আরও এক বার প্রমাণ করল, বাংলার কাজ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরের কাজগুলির থেকে কোনও অংশে কম নয়। এক নবীন পরিচালকের হাত ধরে এমন একটি উপস্থাপনা সত্যিই ভবিষ্যতের দিকে আমাদের অধীর আগ্রহে তাকিয়ে থাকতে আরও উৎসুক করে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy