কঠিন চরিত্রে প্রয়োজনীয় পরিশ্রম দিয়েছেন হিয়া, কিন্তু তাঁর অভিনয় ধারাবাহিকের উপযোগী মনে হয়েছে, ছবির মানানসই হয়ে উঠতে পারেনি।
নির্ভয়া। ২০১২ সালে দিল্লির নৃশংস গণধর্ষণ কাণ্ডের পরে এই নামটা খানিক প্রতীকী হয়ে গিয়েছে। তাতে জড়িয়ে গিয়েছে সেই নৃশংসতার অনুষঙ্গ। ছবির নাম ও প্রচার ঝলক থেকেই স্পষ্ট ছিল বিষয়বস্তু- ধর্ষণ ও তার পরবর্তীতে সমাজে নির্যাতিতার লড়াই। বিষয়বস্তু যথেষ্ট স্পর্শকাতর। তা দাবি রাখে সংবেদনশীলতার। কিন্তু এ ছবির পরতে পরতে তার অভাব। বরং, অংশুমান প্রত্যুষের এই ছবি জুড়ে বার বারই ফুটে উঠল অযত্নের ছাপ।
‘নির্ভয়া’ শুরু হয় একটি গ্রামে এক নাটকের অভিনয় দিয়ে। উচ্চৈস্বরে অভিনীত হচ্ছে দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ। চড়া মেকআপ ও অতিনাটকীয় সংলাপে ধরা পড়ছে পুরুষের নৃশংসতা। ক্যামেরা সমান্তরালে ধরছে পিয়ালির (হিয়া দে) ধর্ষণের দৃশ্য। এক দিকে মঞ্চে পাঞ্চালির অপমান। অপর দিকে, বাস্তবে তেরো বছরের এক কিশোরীর গণধর্ষণ। ছবি এগোয় কিছু দূর। ন্যায় বিচারের দাবি জানানোয় পরিবারকে খুন হতে হয় প্রভাবশালী নেতার ষড়যন্ত্রে। মামলা মোকদ্দমা করে লড়াই এগিয়ে নিয়ে চলে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার এক প্রতিনিধি (শ্রীলেখা মিত্র) ও এক তরুণ আইনজীবী ঋত্বিক দত্ত (গৌরব চক্রবর্তী)।
দীর্ঘ ৬ মাস কোমায় থাকার পরে পিয়ালির জ্ঞান ফেরে। অন্তঃসত্ত্বা পিয়ালি কী করবে তার অযাচিত সন্তানকে নিয়ে— এই দোটানা ঘিরেই এগোয় গল্প। ফলে ছবিতে ধর্ষণ, এবং তাতে আইন তথা আদালতের ভূমিকার পাশাপাশি গর্ভপাতের সিদ্ধান্তের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ও উঠে আসে। এত তাৎপর্যপূর্ণ কিছু প্রশ্ন তুলে ধরলেও শেষ পর্যন্ত তার প্রতি সুবিচার করতে ব্যর্থ ‘নির্ভয়া’। গোড়াতেই রয়ে গেল গলদ— এমন কিছু ছিদ্র, যা দর্শকের দৃষ্টি এড়িয়ে যাওয়া অসম্ভব।
ছবি শুরুই হয় ধর্ষণের ঘটনায়। দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণের সমান্তরালে যখন দেখানো হচ্ছে পিয়ালির ধর্ষণ, তখন প্রেক্ষাগৃহ ফেটে পড়ছে ড্রামস ও ইলেকট্রিক গিটারের চড়া আবহসঙ্গীতে। দুষ্কৃতীদের থেকে বাঁচার তাগিদে অসহায় পিয়ালির দৌড় যেন কোনও টানটান সাসপেন্স-থ্রিলার, এমনই মনে হতে থাকে বার বার। অতিনাটকীয় আবহসঙ্গীতে যেন উদ্যাপিত হল ঘটনাটি, সমালোচিত নয়। প্রতীক কুণ্ডুর আবহসঙ্গীত গোটা ছবিতেই বেশ বেমানান।
আলোর ব্যবহারেও ঘাটতি। জঙ্গলে পিয়ালির ধর্ষণ ঘটে রাতের অন্ধকারে। কিন্তু রাত বোঝাতে গেলেও পর্দায় ন্যূনতম আলোর প্রয়োজন চরিত্রদের দেখার জন্য। এই দৃশ্যে আলো এতই কম যে, চরিত্রদের ছায়া ছাড়া কিছুই তেমন বোঝা গেল না। বাকি সবটুকুই আন্দাজ করে নিতে হল তাদের নড়াচড়ায়। পিয়ালির ভূমিকায় ছোট পর্দার ‘পটলকুমার’ ওরফে হিয়া। ১৩ বছর বয়সে ধর্ষণের পরে অন্তঃসত্ত্বা কিশোরীর চরিত্রে অভিনয় করা যথেষ্ট পরিশ্রমের দাবি রাখে। হিয়া সেই পরিশ্রম দিয়েছেন। তবে তাঁর চরিত্রায়ণ ধারাবাহিকের উপযোগী মনে হয়েছে। ছবির মানানসই হয়ে উঠতে পারেনি।
ছবির বড় অংশ জুড়ে পিয়ালির ভবিষ্যৎ নিয়ে আদালতে বিচারপর্ব। তার অর্ধেক জুড়েই ক্যামেরা থাকে আদালতের কক্ষের ভিতরে। বিচারক (সব্যস্যাচী চক্রবর্তী), পিয়ালির আইনজীবী ঋত্বিক, বিরোধী আইনজীবী ঋতব্রত (শান্তিলাল মুখোপাধ্যায়)- এই তিন জনের মুখেই মূলত ঘুরে ফিরে সংলাপ। দ্বিতীয় শুনানিতে কিছু সংলাপ থাকে পিয়ালির মুখেও। এত দীর্ঘ ও পুঙ্খানুপুঙ্খ বিচারপর্বে আইনের কচকচানি বেশ একঘেয়ে লাগে। ক্যামেরাও কোনও রকম বৈচিত্র আনতে ব্যর্থ। কিছু কিছু শটে অ্যাঙ্গেল এতটাই অস্বাভাবিক যে, বেশ অস্বস্তিকরই লাগে। এক ফ্রেম থেকে অন্য ফ্রেমে যাতায়াতে ফুটে উঠল ছবি নিয়ে প্রাথমিক বোঝাপড়ার অভাব। একাধিক ক্ষেত্রে একটি শট দর্শক বুঝে ওঠার ঢের আগেই ক্যামেরা ঘুরে গেল পরবর্তী শটে। তাই গোটা ছবিতেই বার বার যেন ঝাঁকুনি লাগে। সম্পাদনাতেও পাওয়া যায়নি যত্ন বা নিষ্ঠার ছাপ।
ছবির একমাত্র ইতিবাচক দিক বিভিন্ন চরিত্রে বলিষ্ঠ অভিনেতারা। কিন্তু দুর্বল সংলাপ ও চিত্রনাট্য তাদের কাউকেই তেমন সুযোগ দিল না। তরুণ আইনজীবীর ভূমিকায় গৌরব বেশ ঝকঝকে। ন্যায়-অন্যায় নিয়ে এখনও আদর্শচালিত, তবে কিছু ক্ষেত্রে আবেগ ও মানবিকতাকে আগে রাখা— তারুণ্যের এই সহজাত দীপ্তিকে গৌরব ফুটিয়ে তুলেছেন যথাযথ। তবে অন্যান্য অজস্র সমস্যার গুঁতোয় তা ছবিকে বাঁচাতে পারল না। স্নেহশীল ও সহমর্মী এক নারীর চরিত্রে শ্রীলেখাকে ভাল লাগে। ঋত্বিকের স্ত্রী আরাত্রিকা দত্তের ভূমিকায় প্রিয়াঙ্কা সরকার। কিন্তু সংলাপ জুটল ছবির প্রায় শেষের দিকে। সেইটুকুতেও নজর কেড়েছেন তিনি। সীমিত পরিসরে শান্তিলাল মুখোপাধ্যায়ও রেখে গিয়েছেন তাঁর নিজস্ব দক্ষতার ছাপ। বিচারকের আসনে বসে কিছু আইনি মন্তব্য ছাড়া বিশেষ কিছু করার ছিল না সব্যসাচী চক্রবর্তীর। প্রৌঢ় বিচারকের ভূমিকায় বেশ মানানসই হলেও এই চরিত্রে তাঁর মতো অভিনেতা অপচয়ই বটে।
আরও কিছু প্রশ্ন থেকেই যায়। যেমন, দীর্ঘ ৬ মাস হাসপাতালে অচৈতন্য থাকার পরে জ্ঞান ফিরে পেয়েই পিয়ালি চরম উত্তেজিত হয়ে এত কথা বলে কী ভাবে, অথবা অপারেশন থিয়েটারের বাইরে থেকে কী করে শোনা যায় প্রসবযন্ত্রণার চিৎকার— তার উত্তর মেলেনি। আজন্ম গ্রামের বাসিন্দা তেরো বছরের কিশোরীর মুখে শহুরে উচ্চারণে ভারী ও দীর্ঘ সংলাপ একেবারেই বেমানান। গল্প এবং গল্প বলা, দুই ক্ষেত্রেই আরও অনেকটা যত্নশীল হওয়া যেত। গর্ভপাত ও মাতৃত্ব নিয়ে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বললেও শেষ পর্যন্ত চিরাচরিত অবস্থানে ফিরে যায় ‘নির্ভয়া’। ছবিতে বিভিন্ন দৃশ্যে ধর্ষিতার অনুষঙ্গে এসে পড়েছে দেবী-প্রসঙ্গও। ছবির নামেই তার প্রমাণ- ‘নির্ভয়া: সমাজের লক্ষ্মী’। পঞ্চাশ বছর আগে ‘দেবী’-র মতো ছবি দেখিয়েছিল মেয়েদের উপর দেবীত্ব আরোপের আড়ালে কী ভাবে লুকিয়ে থাকে পুরুষতান্ত্রিক ষড়যন্ত্র। তার এত বছর পরেও বাংলা ছবিতে নারীর সুবিচার চাইতে কেন ফিরে যেতে হচ্ছে সেই দেবীত্বে? আর কত দিনই বা থাকবে এই সমস্যাজনক প্রবণতা? এ বার হয়তো তলিয়ে ভাবার সময় এসেছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy