‘বেলাশুরু’ নামের সার্থকতাও এখানেই যে, সম্পর্কের মাত্রা উপলব্ধি করার কোনও নির্দিষ্ট কাল নেই, এই জরুরি বার্তাটি এই চলচ্চিত্র এনে দেয়। ফাইল চিত্র।
বিস্মরণে আক্রান্ত আরতি। তাঁর বাল্যস্মৃতি অনেকখানি ধরা আছে। মাঝে মাঝেই সেই বাল্যের টানে তিনি বর্তমানের ঘর ছেড়ে যান। একখানি এলোমেলো হাউসকোটের উপরে আধময়লা ওড়না, বাল্যে বিচরণ করা প্রায় বৃদ্ধ আরতির ভূমিকায় স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত স্বামী ও পুত্রকে বিপন্ন করে হেঁটে চলেন মাঠে, ক্ষেতে, রাস্তায়। বার বার তাঁকে পাওয়া যায়, কিন্তু প্রত্যেক বার তাঁকে আর ফিরে না পাওয়ার আশঙ্কা নিদারুণ উদ্বেগ হয়ে ছড়িয়ে পড়ে পরিবারে। কী ভাবে পরিবারটি এই বিপন্নতার সঙ্গে যুঝে চলার কথা ভাবছে? সম্ভাবনা দু’টি। এক, সন্তানেরা যে যার জীবন নিয়ে ব্যস্ত ও বাবা-মায়ের সমস্যা বিষয়ে উদাসীন। দুই, আদৌ তারা সমস্যাটি অবহেলা করে না। বরং যার যার জীবনধারা সাময়িক স্থগিত রেখে মায়ের সেরে ওঠার পথ খুঁজে পেতে চায়।
এই দ্বিতীয় পথের দৃষ্টান্ত দিয়ে ‘বেলাশুরু’ ক্রমে হয়ে ওঠে এই সময়ের সমস্যা ও অসহায়তা সমেত ইতিবাচক পারিবারিকতার ইতিকথা।
‘পারিবারিকতা’ শুধু এক পরিবারের গল্প নয়। বরং বর্তমান সমাজে সম্পর্ক যত নূতনতর রূপে প্রকাশ পায়, যত আধুনিক হতে থাকে সম্পর্কের সংজ্ঞা, সেই প্রগতি পরিহার না করে চলচ্চিত্রটি পারিবারিকতা উপস্থাপন করে।
পূর্ববর্তী প্রজন্মে দাম্পত্য ও পারিবারিকতার যে ধারণা সমেত মা আরতির বিস্মরণ ও বর্তমানের সঙ্গে স্মৃতির সংঘাত সমস্যাটি মানবিক করে তোলে, সেই মানবিক দর্পণেই আত্মদর্শন করে নতুন প্রজন্ম। তারা চাওয়া-পাওয়ার সঙ্গে বোঝাপড়া করে। ধৈর্য ধরতে শেখে। বাবাকে মায়ের প্রতি নিঃস্বার্থ ও নিরলস দায়িত্ববান দেখে এই প্রতীতি লাভ করে, দায়িত্ববোধ সম্পর্কের অন্যতম স্তম্ভ। প্রেমের সঙ্গে নৈতিকতার ঘন বুনোট প্রায় ভেঙে যেতে থাকা সম্পর্কগুলিতে খুঁজে পায় ভালবাসার অব্যর্থ টান।
এ কথা ভাবলে ভুল হবে, ভাঙা সম্পর্ক জুড়ে দিতে বসে পরিচালক নন্দিতা রায় ও শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় রক্ষণশীলতার শ্যাওলা পড়া সৌধ গড়েছেন। বরং তাঁদের রচিত এই জীবনবৃত্তান্তের ভিতর লিখনের মধ্যেকার অলিখিত ভাষ্য শিক্ষিত, মার্জিত, রুচিশীল ও মেধাবী বাংলার সংস্কৃতির অনুশীলন।
‘বেলাশুরু’ নামের সার্থকতাও এখানেই যে, সম্পর্কের মাত্রা উপলব্ধি করার কোনও নির্দিষ্ট কাল নেই, এই জরুরি বার্তাটি এই চলচ্চিত্র এনে দেয়।
কেন্দ্রিক চরিত্র বিশ্বনাথ, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় যে চরিত্রের অভিনেতা, প্রতিক্ষণে উদ্বেগ, বিপন্নতা, অস্থিরতা ও ভালবাসা এমন চূড়ান্ত নৈপুণ্যে অভিব্যক্ত করেন যে স্ত্রী আরতির বিস্মরণ অসুখের আঘাত চোখ ভিজিয়ে দেয়। তিনি ভাল অভিনেতা, সে কথা কে না জানে! এই চরিত্রায়ন দেখতে বসে মনে হয়, তিনি বিশ্বের বহু ভাল অভিনেতাদের এক জনও নিশ্চয়। সারা জীবনের অভিনয়চর্চা, জ্ঞানার্জন ও অনুশীলন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে যে উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিল, তার প্রতি মুগ্ধতা ও শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের কোনও পরিমাণ যথেষ্ট নয়। ‘বেলাশুরু’র পরিচালকদ্বয় তাঁর অভিনয়ক্ষমতা যথার্থ ব্যবহার করতে পেরেছেন।
দাম্পত্যের শেষ পর্বে এসে সৌমিত্র অভিনীত এই পিতা ও স্বামী বিশ্বনাথেরও নূতনতর উপলব্ধির বেলা শুরু হয়। একদা ব্যস্ত পুরুষ বিশ্বনাথ স্ত্রীকে বিশেষ সময় দেননি, সমাজও তেমনটি স্বাভাবিক জানে। 'বেলাশেষে’ চলচ্চিত্রে এই কথা বলা আছে। ‘বেলাশুরু’তেও তার রেশ আছে। আরতির বিস্মরণের কারণ যদি সেইখানে সন্ধান করা যায়, মনে হতে পারে, তিনি তাঁর পরিণত বয়সের থেকে পলাতকা, নির্মলতম আনন্দের মধ্যে সেঁধিয়ে গিয়েছেন বাল্যের দেশে। সবচেয়ে কাছের মানুষকে দেহে কাছে পেয়েছেন, মনে পাননি। বিস্মরণের অসুখ সেই অস্তিত্ব জারি রেখে কাছের মানুষকে করেছে দূরের মানুষ। চেনা মানুষকে করেছে অচেনা। আরতির চেতনায়, সবসময় ‘যে লোকটা’ সঙ্গে থাকে, পাশে শুয়ে ঘুমোয়, সে একটা অন্য লোক, স্বামী নয়। আর বিশ্বনাথ, যিনি স্ত্রীর কাছে ‘অন্য লোক’, যিনি একদা স্ত্রীকে সময় দেওয়ার কথা ভাবেননি, আজ দিবারাত্রি প্রায় শিশু হয়ে যাওয়া স্ত্রীকে আগলে রাখছেন। মুখে গ্রাস নিয়ে চুপ করে বসে থাকা স্ত্রীকে খাইয়ে দিচ্ছেন ধৈর্যে, মমতায়, প্রতি মুহূর্তে আশা করছেন, এই বুঝি আরতি চিনতে পারবেন তাঁর আপন মানুষটিকে। কিন্তু আরতি তাঁর বিয়ের সময়কার কথা বললেও, সুদর্শন বরের কথা বললেও, শেষ পর্যন্ত উচ্ছ্বসিত এক অতীন্দ্রদার গল্পে। কে এই অতীন্দ্র?
অসামান্য অভিনয়ে সৌমিত্র ফুটিয়ে তোলেন বিশ্বনাথের অপ্রতিভ অসহায়তা, লুকোনো ঈর্ষা ও দুঃখ, এবং গভীর প্রেমে সমস্ত গ্লানি ধুয়ে মুছে ব্যাকুল হয়ে ওঠেন এই ভাবনায়, যদি ওই অতীন্দ্রকে খুঁজে পাওয়া যায়, যদি যাওয়া যায় ওই সুদূর ফরিদপুরের গ্রামখানিতে, বাল্যের স্মৃতিপথে আরতি বর্তমানে ফিরে আসতেও তো পারে।
মনোবিদের সঙ্গে পরামর্শ করে যাওয়া হল। সপরিবার। দেখা হল সেই অতীন্দ্রদার সঙ্গে। সেই পুকুর, যেখানে মাছের চার ফেলে বলা হতো, মাছের পোনা আইসো, মাছের পোনা যাইয়ো না।
আরতি চরিত্রে স্বাতীলেখা সরল বাল্যে অনবদ্য ফিরে যান। যে বড় জামাই অতীন্দ্রদা ও শাশুড়ি সম্পর্কে সামান্য সন্দিহান ছিল, সে, অন্যদের সঙ্গে উপলব্ধি করে, ওই দেশের বাড়ি, উঠোন, মাছ ধরা, নৌকার গান,শান্ত জল আর সুদর্শন বরের অপেক্ষায় থাকা বালিকার চিরমধুর সম্পর্ক শুধু অতীন্দ্রদা নয়, সেই কালখণ্ড, সেই গন্ধ, শব্দ, স্বপ্ন, সত্তা, সমস্তটুকুর সঙ্গে। জীবনের এক সরল, মিঠে, ঝিকিমিকি আনন্দময় সময়ের সঙ্গে বাকি জীবনের অবিচ্ছেদ্য প্রেম, যার সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটাতে পারে না স্মৃতিগ্রাসী সুকঠোর স্নায়ুরোগ। প্রত্যেক ব্যক্তির হৃদয়েই কি থাকে না এমন এক আগলে রাখা বেলা? যে কোনও সময়েই কি তার আশ্রয়ে চলে যেতে চায় না ব্যথাতুর, যন্ত্রণাবিধুর, ক্লান্ত হৃদয়?
জীবনের শেষবেলায় আরতি মাতেন ব্যাখ্যাতীত স্বপ্নিল স্মরণ ও বোধাতীত বিস্মরণের লীলায়। বড় জামাইকে তিনি গুলিয়ে ফেলেন যা নয় তাই, অথচ বিচ্ছেদ নিয়ে যাওয়া পুত্রবধূকে কাছে পেতে চান। বিশ্বনাথ শুরু করেন এমন এক প্রেমাবিষ্ট দায়িত্ববোধপূর্ণ জীবন, যেখানে সব দেওয়া-নেওয়া, সব স্বার্থ জলবিন্দুতে বিলীন। প্রেমের এই নিঃস্বার্থ আবহ চেতনায় ধরা দেয় রবীন্দ্রনাথের সেই গানের সুরে সুরে, যেখানে বলা আছে “হৃদয় আমার চায় যে দিতে, কেবল নিতে নয়,” অথবা, প্রেমের অন্যতর চেতনার ধারক যে মেজজামাই, যে তার সমকামিতার কারণে বিবাহিতা স্ত্রী মিলির সঙ্গে নানাবিধ সংঘাতের পর এক সময়ে যৌথ ভাবে এই উপলব্ধিতে পৌঁছয়, দাম্পত্যর ভিতর যৌনতার বাইরেও আছে এক অমূল্য অর্থ। জগতে সেগুলি সুলভ নয়, সেই সব হল বিশ্বাস, নির্ভরতা ও বন্ধুত্ব। এই বোধ তার হাতে বাজিয়ে তোলে সেই সুর, “রাখো রাখো রে জীবনে জীবনবল্লভে”।
আরতির ভুলে যাওয়ার রোগ এই চলচ্চিত্রে গভীর বিশ্লেষণাত্মক। আগাগোড়া উদ্বেগ তৈরি না করে মাঝে মাঝে তা হাসি ও সরসতা রচনা করে। বড় মেয়ে ও জামাই, অভিনয়ে অপরাজিতা আঢ্য ও খরাজ মুখোপাধ্যায়, যাদের সম্পর্ক সরল ও নির্ঝঞ্ঝাট, এই সরসতার বাহক। মেজো মেয়ে ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত অভিনয়ে সুপরিমিত ও সুপরিণত। সার্বিক ভাবে, সৌমিত্র ও স্বাতীলেখার অভিনয় ছাড়াও অন্য চরিত্রগুলিতে অভিনয়গুণ এই সিনেমার এক সম্পদ। বিখ্যাত ও প্রতিষ্ঠিত কুশীলবের সঙ্গে সম মাত্রায় একেবারে ঝরঝরে অভিনয় করেছেন ছোটমেয়ে ও জামাইয়ের ভূমিকায় মনামী ঘোষ ও অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়।
রবি ঠাকুরের দু'টি গানের সুর ছাড়াও অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায় এবং অনুপম রায়ের রচিত ও গীত সঙ্গীতগুলি মন-কাড়া। আরতির দেশের বাড়িতে, নৌকায় বসে গান গায় এক বালক, ক্যামেরা তার সঙ্গে সঙ্গে ব্যাপ্ত করে বাংলার শ্যামল সজল রূপ। সেই গানখানি বাংলার চালচিত্র রচনা করে যায়।
মেধাবী গল্প, টানটান সংলাপ, বিষয়, দৃশ্য, গান, অভিনয়, সব মিলিয়ে 'বেলাশুরু’ সমাদৃত হওয়ার যোগ্য, এই পরিচালকদ্বয়ের আরও অনেক ছবির মতোই।
বিশেষত উল্লেখ্য, এই চলচ্চিত্র সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ও স্বাতীলেখা সেনগুপ্তর শেষ অভিনয়ের ধারক। এই দুই নক্ষত্রবিহীন অভিনয়ের বেলাও বাংলার নাট্য ও চলচ্চিত্রাভিনয়ের জগতে শুরু হল এই বেলা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy