অয়ন চক্রবর্তীর পরিচালনায় ‘ষড়রিপু ২: জতুগৃহ’-এর গল্প এগিয়েছে জটিল মনস্তত্ত্ব ও রহস্য রোমাঞ্চের জুটিতে।
পাকদণ্ডীর বাঁকে বাঁকে ঘটনার ঘনঘটা; যত পথ এগোয়, ক্রমশই ঘনীভূত হতে থাকে রহস্যে পরত। বাবার আদরের মেয়ে ঝলমলে মেঘা, বিখ্যাত সুরকার দেবরাজ সেন, গোয়েন্দা চন্দ্রকান্ত, বালিকা তিথি, গান এবং গানের জগত, পাহাড়ের গায়ে নদী, মায়াময় পাহাড়ি পথ— সকলেই কাহিনির কুশীলব। অয়ন চক্রবর্তীর পরিচালনায় ‘ষড়রিপু ২: জতুগৃহ’-এর গল্প এগিয়েছে জটিল মনস্তত্ত্ব ও রহস্য রোমাঞ্চের জুটিতে।
ছবির নামেই ‘ষড়রিপু’র উল্লেখ, যার যথার্থ প্রয়োগ ঘটেছে কাহিনিতে। কাম, ক্রোধ, লোভ, মদ, মোহ, মাৎসর্য— ছয় রিপুর সব ক’টিই যেন শিল্পসম্মত ভাবে উন্মোচিত। অভিনয়ে চিরঞ্জিত চক্রবর্তী, অরুণিমা ঘোষ, শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়, রাজেশ শর্মা, দেবরঞ্জন নাগ প্রমুখ। অয়ন চক্রবর্তীর কাহিনিতে এ ছবির সঙ্গীত পরিচালনা রূপম ইসলামের।
শ্বশুর এবং প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুর পর কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি পেয়ে যান বিখ্যাত সুরকার দেবরাজ সেন (শাশ্বত চ্যাটার্জি)। দেবরাজের দ্বিতীয় স্ত্রী-ও ছোট একটি মেয়ে রেখে, প্রথম জনের মতো একই ভাবে খাদ্যে বিষক্রিয়ার জেরে মারা যায়। এ হেন দেবরাজ তৃতীয় বার বিয়ে করেন বন্ধুর মেয়ে, বয়সে কুড়ি বছরের ছোট মেঘাকে (অরুণিমা ঘোষ)।
মেঘার ভালবাসার পুরুষ ডাক্তারি পাঠরত ঋজু; তাকে ছেড়ে সে বাধ্য হয় দেবরাজকেই বিয়ে করতে। কারণ বাবার কোটি কোটি টাকার ঋণ শোধ এবং তাঁকে বাঁচানোর এ-ই ছিল একমাত্র পথ। আর দেবরাজেরও একমাত্র বন্ধন, তার শিশু কন্যাটিকে দেখভালের জন্য বিশ্বস্ত কারও প্রয়োজন ছিল। সে কথাই তিনি বলেছিলেন মেঘাকে। দেবরাজের সন্তান তিথিকে নিজের মেয়ের মতোই গ্রহণ করে মেঘা। কিন্তু তাতেও কি সব দিক রক্ষা হয়? চূড়ান্ত অপমান, লাঞ্ছনা, শারীরিক ও মানসিক অত্যাচার; পদে পদে তটস্থ, জর্জরিত জীবনে মেঘা মরে বেঁচে থাকে।
ছবি শুরু হয় মা ও মেয়ের পাহাড় থেকে ফেরার দৃশ্যে। আর বাড়ি ঢুকতে না ঢুকতেই এক সাংঘাতিক ঘটনা; বন্ধ স্টুডিয়োর ভিতরে পাওয়া যায় দেবরাজের মৃতদেহ। কিন্তু এ কেমন করে হয়? মাসখানেক আগে মেঘা আর তিথির বেরনোর দিনেই তো দেবরাজেরও বেরিয়ে যাওয়ার কথা? এক মাসের অজ্ঞাতবাসেই তাঁর জোগাড় করে আনার কথা বছরভরের সৃষ্টিশীলতার রসদ। ঠিক কী ঘটেছিল তবে? তদন্তে আসেন গোয়েন্দা চন্দ্রকান্ত (চিরঞ্জিত চক্রবর্তী) এবং তাঁর সহকারী সানি। মেয়েটিকে চন্দ্রকান্ত শনি বলেই ডাকতে বদ্ধপরিকর। গল্প এগিয়েছে চন্দ্রকান্তর তদন্ত এবং মেঘার সঙ্গে তাঁর কথোপকথনের সূত্র ধরেই।
থ্রিলার-ধর্মী ছবিতে দর্শকের সমস্ত মনোযোগ থাকে রহস্যের উদ্ঘাটনের দিকেই। কিন্তু এ গল্প শুধু অপরাধ এবং রহস্যভেদ নিয়ে নয়। মনস্তত্ত্ব এ গল্পের মজ্জায় মজ্জায়। যে সব মেয়েদের দিয়ে গান গাওয়াচ্ছেন, সুরের বিচ্যুতিতে তাদের গায়ে হাত তুলছেন দেবরাজ। তাদেরই আবার শয্যাসঙ্গিনীও করছেন। সে কথা চিৎকার করে বলছেন প্রকাশ্যেই; অথচ নিজের তৃতীয় স্ত্রী তাঁর পুরনো বন্ধুর সঙ্গে মিশছেন কি না, তা নিয়ে তিনি চরম সতর্ক। তাঁর সংস্পর্শে যে সব মেয়েরা আসে, চরম অপমান এবং আত্মগ্লানির মধ্যে তাদের ছুঁড়ে ফেলেন তিনি। এ হেন দেবরাজের মৃত্যুতে কেন কাঁদতে দেখা যায় স্ত্রী মেঘাকে? কেনই বা কাঁদেন এক উঠতি গায়িকাও? অথচ দেবরাজের হাতে দুজনেই চরম শারীরিক এবং মানসিক লাঞ্ছনার শিকার দু’জনেই! কী করেই সুরের পূজারী কোনও মানুষ এমন নিষ্ঠুরতার পথে হাঁটেন? এই মেলাতে না পারার মধ্যেই রয়েছে মনস্তত্ত্বের অলিগলিতে ঘোরার সুখ। দর্শক মন এবং মস্তিষ্ক দিয়ে সমাধান খোঁজেন; এ ভাবে ভাবনাকে উস্কে দেওয়াই তো পরিচালকের দক্ষতা; যা সফল ভাবেই উপস্থিত এ ছবিতে।
গোয়েন্দা চন্দ্রকান্ত প্রথম থেকেই এক অদ্ভুত ব্যক্তিত্ব নিয়ে হাজির। হাল্কা মজা, ঠাট্টা-বিদ্রুপের মোড়কের ভিতরে থাকা এক মননশীল মানুষ। মেধাই যাঁর সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র। দর্শকের ভালবাসা এবং সহানুভূতি আদায় করে নেন মেঘাও। সানি ওরফে শনির নির্দোষ, আপাত বোকা বোকা প্রশ্ন এবং কথাবার্তায় মিলেমিশে যায় নিপাট হাস্যরস থেকে কঠিন বাস্তব।
প্রশংসা কুড়িয়ে নেবেই রূপম ইসলামের সঙ্গীত পরিচালনা। এ ছবির গান গল্পের মেজাজের সঙ্গে ওতপ্রোত জড়িয়ে। বেশ ভাল সৌভিক বসুর চিত্রায়ণ এবং সুজয় দত্ত রায়ের সম্পাদনাও। অসাধারণ অভিনয় করেছেন শাশ্বত, চিরঞ্জিত এবং অরুণিমা। পার্শ্ব চরিত্রে ভারি স্বতস্ফুর্ত দেবরঞ্জন নাগ, বরুণ চন্দ, ডলি বসু-রাও।
এ ছবির গল্পের বুনোট আঁটোসাঁটো। বুদ্ধি এবং তির্যকতার মিশেলে উপভোগ্যও। তবে খামতি একেবারেই নেই, তা নয়। হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ হিসেবে মেঘার প্রাক্তন প্রেমিকের কাছেই কেন মেয়েকে নিয়ে গেল দেবরাজ এবং মেঘা, তার বিশ্বাসযোগ্য কারণ থাকলে ভাল হতো। আবার পাহাড়ি নদীর পাশে দাঁড়িয়ে মেঘার কণ্ঠে ‘রাত্রি এসে যেথায় মেশে’ গানটি। সে এক অপূর্ব দৃশ্য।কিন্তু ক্যামেরা একেবারে কাছাকাছি পৌঁছলে অরুণিমার অভিব্যাক্তি এবং ঠোঁট মেলানোয় যেন খানিক তাল কাটে। এক বাটি দুধে এক ফোঁটা চোনার মতোই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy