চিত্রকলার সঙ্গে সিনেমার সম্পর্ক অঙ্গাঙ্গি। অনেক দিন পর বাংলা ছবিতে সে সম্পর্ক ফেরাল ‘ধ্রুবর আশ্চর্য জীবন’। পরিচালক অভিজিৎ চৌধুরী গুণী মানুষ। চিত্রকলা যে তাঁর প্রিয় বিষয়, সেটা বলে দিতে হয় না। দেশ-বিদেশে তিনি পড়িয়েছেন। ছবির শুরুতেই তাই যামিনী রায়, গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিকাশ ভট্টাচার্য, বিনোদ বিহারী মুখোপাধ্যায়ের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছেন তিনি। তাঁদের সেরা চিত্রকলাগুলির সঙ্গে কথা বলে তাঁর এই ছবি। স্থির চিত্রকলা জীবন্ত হয়ে ওঠে ক্রমে এই ভাবে...
চারটি পর্বে ভাগ করা এই ছবি। চারটি আলাদা আলাদা গল্প। কিন্তু ছবির শেষে বোঝা যায় সব ক’টি গল্পই আসলে পরস্পর সংযুক্ত। কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে স্বীকৃতি পেয়েছিল ছবিটি। চার বিখ্যাত চিত্রকরের ছবির চারটি থিমকে ঘিরেই এগোতে থাকে গল্পগুলি। যামিনী রায়ের ছবির চিত্রচোর, গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছবির ভাসান মুহূর্ত, বিকাশ ভট্টাচার্যের ছবির ভৌতিক শিশু আর বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়ের অন্ধত্বের পর অন্তরের দৃষ্টি— এই সব থিমগুলোই ফিরে ফিরে আসে ছবির চারটি আখ্যানে। কিন্তু তা আসে আধুনিক সময়ের প্রেক্ষিতে, চেহারায়।

‘ধ্রুবর আশ্চর্য জীবন’ ছবির একটি দৃশ্যে। ছবি: সংগৃহীত।
অভিনেতা ঋষভ বসু প্রতিটি গল্পেই নানা চরিত্রের মধ্যে ফিরে আসেন। ভাল লাগে তাঁর অভিনয়। এ ছাড়া নতুনদের মধ্যে কোরক সামন্ত, যুধাজিৎ সরকার, ঋত্বিকা পাল, আনন্দরূপা চক্রবর্তীর অভিনয় ভাল লাগে। আছেন দেবেশ চট্টোপাধ্যায়ের মতো অগ্রজেরাও। দীপক হালদারের চরিত্রটিও ভাল লাগে। মধ্যবিত্ত জীবনে বারে বারেই আসে আদর্শ আর নৈতিক লড়াইয়ের দ্বন্দ্ব। এ ছবির প্রতিটি গল্পেই সেই দ্বন্দ্ব প্রধান চেহারা নেয়। কোন পথে যাবে ধ্রুবর আশ্চর্য জীবন এর পর? কখনও তাকে মূল্যবোধ পেরিয়ে সস্তায় ছবি চুরি করতে হয়, কখনও দেবী দুর্গারূপী কোনও নারীর স্বামীকে স্রেফ কিছু ধান্দার জন্য মেরে ফেলতে হয়, কখনও শৈশবকে ফিরে দেখতে গিয়ে ভৌতিক শিশুরা ভেসে ওঠে, আবার কখনও দৃষ্টিহীন প্রেমিকার মধ্যে দিয়ে সে জানতে পারে জীবনের সারসত্য। এ ভাবেই মহৎ চিত্রকলার সঙ্গে রচিত হয় সমকালীন গল্পের সেতু। জীবনে চলতে কোন পথটা আসলে সত্য, খোঁজ চলতে থাকে তারও।
মূলধারার বাংলা ছবির ক্লান্ত বাজারে এমন অভিনব ভাবনা নিয়ে ছবি করার জন্য পরিচালক অভিজিৎ চৌধুরীকে কুর্নিশ। সম্প্রতি ‘মায়ানগর’ ছবিটির কথাই ধরা যেতে পারে এ প্রসঙ্গে। হাজার প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে বিষয়বস্তুর জোরেই সাড়া ফেলেছে ছবিটি। তেমনই ‘ধ্রুবর আশ্চর্য জীবন’ প্রমাণ করে, এখনও অভিনব আইডিয়া নিয়ে ছবি বানানো সম্ভব। এবং যে কোনও ধরনের বাধা পেরিয়েও তা মানুষের ভালোও লাগবে।

এ ছবির ভিএফএক্স বিশেষ ভাবে প্রশংসার দাবি রাখে। বিশেষ করে রাজকীয় চিত্রকলার সামনে দাঁড়িয়ে আজকের সমাজের গল্পর সঙ্গে সেতু রচনা করা সহজ ছিল না। কিন্তু সে কাজটি ঘটালেন শুভায়ন চন্দ্র। তাই তাঁর সাহস ও মুনশিয়ানাকে কুর্নিশ জানাতেই হয়। ছবির সঙ্গীত প্রলয় সরকারের। তিনিও প্রশংসার দাবি রাখেন।
সব মিলিয়ে এ ছবি অনেক দিন পর বাংলা বাজারে অন্য ভাবে গল্প বলার এক জ্বলন্ত উদাহরণ।