কলকাতায় গাইতে এসে মাত্র ৫৪ বছর বয়সে মৃত্যু হয়েছে ‘পেয়ার কে পল’ গায়ক কেকে-র।
যে-খেলেনা রচিলেন মূর্তিকার/ মোরে লয়ে মাটিতে আলোতে,/সাদায় কালোতে,/ কে না জানে সে ক্ষণভঙ্গুর/ কালের চাকার নিচে নিঃশেষে ভাঙিয়া হবে চুর।
বাংলা ১৩৪৬ সালে ‘জন্মদিন’ কবিতাটি লেখেন রবীন্দ্রনাথ। পুরীতে। জন্মদিন তো আনন্দ-উৎসব। জন্মদিন মানেই তো উদ্যাপন। শুভেচ্ছার বার্তা। তা হলে কেন এমন কয়েকটি লাইন লিখলেন কবি, যেখানে লেগে রয়েছে মৃত্যুর দাগছাপ? জন্মদিনে কি তা হলে এসেছিল মৃত্যুচেতনা? জল্পনা চলতে থাকে, কিন্তু অস্বীকার করা যায় না যে, কারও কারও জন্মদিনে অবধারিত আসে মৃত্যুর অনুষঙ্গ। মৃত্যুই যেন স্মরণ করিয়ে যায় সেই ব্যক্তির জন্মমুহূর্ত। অন্তত এ বার কেকে-র জন্মদিনে যে তাঁর অসময়ে চলে যাওয়ার ঘটনার কথা ফিরে ফিরে আসবে অবধারিত ভাবে, তা অনুমেয়। ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বললে, মাত্র ৫৪ বছরে প্রয়াত না হলে কেকে-কে নিয়ে এই প্রতিবেদনটি লেখার প্রয়োজন হত না। সত্যি বলতে, নাটকীয় ভাবে মৃত্যুই যেন নতুন জন্ম দিল কেকে-র। যে মৃত্যুর ঘটনায় চিরকালীন ভাবে লেখা হয়ে থাকল কলকাতার নাম।
শহরের এক অনুষ্ঠানে এসেই তো অসুস্থ হয়ে পড়েন কেকে। অনুষ্ঠান করেন। রীতিমতো লাফিয়ে-ঝাঁপিয়ে শেষ বারের মতো মাতিয়ে দিয়ে যান শহরের শ্রোতাদের। প্রয়াণের পর যে টুকরো টুকরো ভিডিয়ো ছড়িয়ে পড়েছিল, তা দেখে মালুম হয়, শিল্পীর অস্বস্তি হচ্ছে। তিনি ঘাম মুছছেন। কখনও জল খাচ্ছেন। উপরের দিকে তাকাচ্ছেন। আবার ফিরে গিয়ে হাজার ওয়াটের আলোর ঝলকের সামনে দাঁড়াচ্ছেন। মাইক্রোফোন তুলে নিচ্ছেন হাতে। চিরচেনা স্বর ফিরে ফিরে আসছে তাঁর কণ্ঠে। বিনোদনের উপকরণ জোগানোই যাঁর উদ্দেশ্য ছিল, জীবনের শেষ কিছু মুহূর্তেও সেই কাজটি করে গিয়েছেন তিনি। এমন মৃত্যুতে তো এক ধরনের আত্মশ্লাঘা থাকতে পারে। গর্ব থাকতে পরে। তাই না?
‘এলিজি’ বা ‘মৃত্যুচেতনা’ সম্পর্কে কেকে-র ধারণা কী ছিল জানা যায় না। তবে, তা থেকে থাকলে এমন নিষ্ক্রমণ যে কোনও শিল্পী চাইতে পারেন, তা অনুমান করতে অসুবিধা হয় না। বলতে গেলে গান গাইতে গাইতেই চলে গেলেন তিনি। অর্জুনের মতো গাণ্ডীব তুলতে না পারার গ্লানি নিয়ে নয়।
বস্তুত, বলিউডের সঙ্গীতের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, কৃষ্ণকুমার কুন্নাথ ওরফে কেকে নব্বই এবং দু’হাজারের দশকে একাধিক সুপার হিট গান গেয়েছেন। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ১৯৯৬ সালে শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদের উপর আধারিত ছবি ‘মাচিস’এর গানের অংশবিশেষ, কিংবা ১৯৯৯ সালে তাঁর জনপ্রিয় অ্যালবাম ‘পল’ বা ২০০৮ সালের ‘হামসফর’ অ্যালবামটির কথা। নিছক তথ্য বলে, ১১টা ভাষায় প্রায় সাড়ে তিন হাজার বিজ্ঞাপনী জিঙ্গল রেকর্ড করেছেন কেকে। শাহরুখ খান, রণবীর সিংহ কিংবা সলমন খানের নেপথ্যকণ্ঠ হিসেবেও জনপ্রিয় হয়েছে তাঁর গান। অজস্র অনুষ্ঠান করেছেন দেশ-বিদেশে। তাঁর অনুষ্ঠানে মোহিত হয়েছে কয়েক প্রজন্ম।
অথচ, সঙ্গীতে কেকে-র প্রথাগত শিক্ষা ছিল না। মায়ের কণ্ঠের গান শুনে সঙ্গীতের প্রতি আগ্রহ তৈরি হয়। স্বরলিপি নয়, সুর শুনে গান তুলতে স্বচ্ছন্দ ছিলেন তিনি। পরবর্তী কালে একলব্যের দ্রোণাচার্য ছিলেন কিশোর কুমার। অন্ধ ভাবে অনুসরণ করতে থাকেন কিশোরকে। কিন্তু, এটাও ঘটনা যে, যাঁকে অনুসরণ করছেন, তাঁকে সর্বার্থে অনুকরণ করেননি। ফলে, অনেক ‘কণ্ঠী’র ভিড়ে তিনি হারিয়ে যাননি। স্বকীয়তা বজায় রেখেছেন। নিজের কণ্ঠস্বরের উপর আস্থা রেখে, পুরোপুরি নিজস্ব স্টাইল বজায় রেখে সঙ্গীত পরিবেশন করে গিয়েছেন। যা হয়তো তাঁকে স্বতন্ত্র স্থান দিয়েছে তাঁর প্রজন্মের অন্য গায়ক— কুমার শানু, অভিজিৎ, সনু নিগমের থেকে। ফলে, শুরু থেকেই কেকে ছিলেন ‘নিজের মতো’। নব্বইয়ের দশকের গোড়ার দিকে বলিউডও হয়তো এমন এক ‘ফ্রেশ’ কণ্ঠেরই খোঁজে ছিল। এ দিক থেকে দেখলে তাঁকে কিশোরের উত্তরসূরি বলা কি অত্যুক্তি হবে?
এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন,পুরস্কার নয়, তাঁর লক্ষ্য ছিল মানুষের হৃদয়ে জায়গা। মানুষের ভালবাসা যে তাঁর কাছে সবচেয়ে বড় পুরস্কার ছিল, তা প্রমাণ করেছিল তাঁর অকালপ্রয়াণ এবং তৎপরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ। জন্মদিনে ফিরে ফিরে আসবে তাঁর কণ্ঠ, তাঁর গল্প। জীবনে শক্তি পাওয়া যায় এমন কিছু গান আবারও শোনা হবে। শুধু এই দিনটিতেই নয়, কেকে থাকবেন কয়েক প্রজন্মের হৃদয়ে ‘আপন আসনে মাটিতে আলোতে, সাদায় কালোতে’।
কে না জানে জীবন ক্ষণভঙ্গুর। তাই বলে এতটাও কি, যেখানে মাত্র ৫৪-তেই থমকে যেতে হয় এমন এক প্রাণচঞ্চল শিল্পীকে? অস্বীকার করা যাবে না, কেকে-র এই জন্মদিনে লেগে থাকবে মৃত্যুর অনুষঙ্গ।
ওহ্! বলাই হল না, শুভ জন্মদিন কেকে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy