কলকাতা থেকে সফর শুরু করেছিলেন। সেখান থেকে তিনি এখন বলিপাড়ার পাকাকাকি বাসিন্দা। প্রত্যেক মাসেই মুক্তি পাচ্ছে কোনও না কোনও গান। ‘আজ কি রাত’ ও ‘উই আম্মা’র মতো গান গাওয়ার পরে মুম্বইয়ের পরিচিত নাম মধুবন্তী বাগচী। মায়ানগরীর ব্যস্ততা প্রতি মুহূর্তে উপভোগ করছেন বাঙালি গায়িকা।
এর মধ্যেই প্রীতম, সচিন-জিগর, অমিত ত্রিবেদীর মতো সঙ্গীত পরিচালকের সঙ্গে কাজ করে ফেলেছেন। সঞ্জয় লীলা ভন্সালীর পরিচালনায় ‘হীরামন্ডি’তেও গেয়ে ফেলেছেন একটি ঠুংরি। সম্প্রতি মুক্তি পেয়েছে ‘জাট’ ছবিতে তাঁর গান ‘টাচ কিয়া’। তাই আপাতত মুম্বইয়েই থিতু গায়িকা। বাংলায় ভাল সুযোগ পেলে কাজ করতে রাজি তিনি। কিন্তু কলকাতায় ফেরার কোনও পরিকল্পনা নেই আপাতত।
মুম্বইয়ে বেশ কিছু কাজ করার পরে কলকাতা ও মুম্বইয়ের কাজের ধরনের মধ্যে পার্থক্য মধুবন্তীর কাছে এখন পরিষ্কার। আনন্দবাজার ডট কমকে মধুবন্তী বলেন, “শিল্পী এখন তাঁর সফরের ঠিক কোন পর্যায় রয়েছে, তার উপর অনেক কিছু নির্ভর করে। যেমন পাঁচ বছর আগে কলকাতায় যে বিষয়গুলোর সম্মুখীন হতাম, আজ কাজ করতে গেলে সেগুলোর মুখোমুখি হয়তো হতে হবে না। মুম্বইয়ে আসলে সবার হাতেই সময় খুব কম। খুব চটজলদি কাজ হয়। ‘এসো, গান গাও, রেকর্ড করো’— ওখানে এটুকুই হয়। আবার হয়তো গানটা প্রচার করতে যেতে হয়। কলকাতায় এটা হয় না।”
মুম্বইয়ের কাজের ধরন মধুবন্তীর পছন্দ। তাই গায়িকার কথায়, “আমার ব্যক্তিগত ভাবে মুম্বইয়ের কাজের ধরন পছন্দ। এখানে কাজটুকুর বাইরে আর কিছু থাকে না। আবার অনেকে হয়তো কলকাতার মতো আড্ডা দিয়ে, বেশ কিছুটা সময় একসঙ্গে কাটিয়ে কাজ করতে পছন্দ করেন।”
এই প্রসঙ্গেই মধুবন্তী আরও বলেন, “আসলে প্রত্যেক সঙ্গীত পরিচালকের হাতেই অজস্র কাজ। এখানে কারও এত সময় নেই যে আলাদা করে আড্ডা দেবেন। আমরা তো গান গেয়ে রেকর্ড করেই চলে আসি। কিন্তু গীতিকার বা সুরকারদের অনেকটা সময় দিতে হয় একটা গানের পিছনে।”
বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে মধুবন্তী আগেও জানিয়েছেন, তিনি অন্তর্মুখী। সহজে মিশে যেতে পারেন না সকলের সঙ্গে। অন্তর্মুখী মানুষদের কাজের জগতে এগোতেও বেশ কিছু সমস্যার মুখে পড়তে হয়। সেখানে মুম্বই গিয়ে নিজের শক্ত ভিত তৈরি করলেন কী ভাবে? প্রশ্ন করতেই গায়িকা বলেন, “আমি আসলে মুম্বইয়ে এসে একটা বিষয় বুঝে গিয়েছি। আমরা অন্তর্মুখী না কি বহির্মুখী— তা নিয়ে কিছু যায় আসে না। এঁরা প্রত্যেকে কাজ নিয়ে এতটা ব্যস্ত থাকেন, অন্য দিকে তাকানোরই সময় পান না। এখানে কে কাকে চেনে, কে কার বন্ধু, এ সব দিয়ে কাজ হয় না। মুম্বইয়ের শিল্পীদের একমাত্র লক্ষ্য হল, কাকে দিয়ে কাজটা হবে। আমার ব্যক্তিগত অস্তিত্ব নিয়ে হয়তো কারও হয়তো মাথাব্যথাই নেই। আমি গানটা কেমন গাইছি, সেটুকুই এখানে গুরুত্ব পায়।”

মুম্বইয়ে কাজ করতে গেলে বন্ধুত্ব পাতাতে হয় না। তাই মধুবন্তীর স্পষ্ট স্বীকারোক্তি, “আমি এখানে এসে কারও বন্ধু হওয়ার চেষ্টাই করিনি। কলকাতায় আমার মনে হত, বন্ধুত্ব তৈরি করা জরুরি। আমি একেবারেই সামাজিক নই। তাই আমার মনে হত, আমি হয়তো পিছিয়ে পড়ছি। রোজ দেখা করা, আড্ডা দেওয়া, এগুলো আমি পারি না। ক্লান্ত হয়ে যাই। তাই প্রথমে মনে হয়েছিল, মুম্বইয়েও একই সমস্যায় পড়তে হবে। আমি সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে পারব না, পার্টিতে যাব না। তা হলে কী হবে? আমি আজ পর্যন্ত নিজে কাউকে ফোন করে বলতে পারিনি, আমাকে দিয়ে গাওয়ান। মুম্বইয়ে এসে নিজের গানের নমুনা পাঠিয়েছি মাত্র। এখানে কিন্তু নতুনদের গান শোনা হয়। আমিও এই ভাবেই সুযোগ পেয়েছি এখানে। আগে আগে তো কাউকে চিনতামই না। এখনও তেমন চিনি না। কাজ করতে গিয়ে সামান্য চেনা-পরিচিতি মাত্র। তবে অন্তর্মুখী হয়েও এবং খারাপ জনসংযোগ হওয়া সত্ত্বেও কিছু অন্তত করতে পেরেছি।”
কলকাতায় শিল্পীর জন্য গান নির্বাচনের পদ্ধতির জন্য সমস্যায় পড়েছেন মধুবন্তী। গায়িকার মত, কলকাতায় শিল্পীর কণ্ঠের ধরন না ভেবেই তাঁর জন্য গান বাঁধা হয়। মধুবন্তীর কথায়, “এখানে গান তৈরি করে ফেলার পরে গাইতে বলা হয়। কিন্তু সব সঙ্গীতশিল্পীর গায়কি, গলার ধরন এক নয়। প্রত্যেকের গানের স্কেলও ভিন্ন। আমার কণ্ঠস্বর একটু ভারীর দিকে। তাই আমাকে যখন খুব চড়া স্কেলে গাইতে বলা হত, আমার অসুবিধা হত। আমি বুঝতে পারতাম, যিনি গান বেঁধেছেন, তিনি কোনও ক্ষীণ কণ্ঠস্বর ভেবেই গানটা বেঁধেছেন। তা হলে আমার কাছে গানটার প্রস্তাব কেন এল?”
কিন্তু এমন প্রস্তাব এলেও ফেরাতে পারেননি মধুবন্তী। তিনি বলেছেন, “কাজ এলে ফিরিয়ে দেবে, কলকাতায় এমন পরিস্থিতিতে কেউ থাকে না। তখন বাধ্য হয়ে কষ্ট করে কণ্ঠের উপর অত্যাচার করে চড়া স্কেলে গানটা গাইতে হয়। প্রত্যেকটা গানের জন্য ভিন্ন ধরনের কণ্ঠের দরকার হয়। তাই কার কণ্ঠে কোন গান মানানসই, সেটা ভাবা উচিত।”
পেশাদারিত্বের অভাব যে কোনও শহরেই থাকতে পারে। মুম্বইয়েও অনেক সময়ে গান রেকর্ড হয়ে যাওয়ার পরেও শিল্পীকে বদলে দেওয়া হয়। তবে সে বিষয় নিয়ে শিল্পীরাও মাথা ঘামান না। তাঁদের হাতে এত কাজ থাকে যে তাঁদের উপরে সেই ভাবে প্রভাব পড়ে না। তাঁরা পরের কাজের দিকে এগিয়ে যান। সেই দিক থেকে কলকাতায় কাজ থেকে বাদ পড়লে অসুবিধায় পড়তে হয় শিল্পীদের। গায়িকা বলেছেন, “মুম্বইয়ে আসলে কাজ প্রচুর হয়। ছবি, ওটিটি, স্বাধীন ভাবে তৈরি গানের কাজ, লেগেই থাকে। এই বছর আমি ‘কোক স্টুডিয়ো ভারত’-এ গাইছি। সৌভাগ্যবশত গত পাঁচ বছরে আমাকে সেই ভাবে প্রত্যাখ্যাত হতে হয়নি।”