পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়। ছবি: সংগৃহীত।
বাংলা ছবি অন্যতম ব্যস্ত অভিনেতা, পরিচালক হিসেবে বড় পর্দা হোক কিংবা ওটিটি, তিনি সফল। সিনেমা থেকে সিরিজ়, সাফল্যই পেয়েছেন। সদ্য জীবনের নতুন অধ্যায় শুরু করেছেন। অনুষ্কা শর্মা থেকে রবিনা, তৃপ্তি ডিমরি, অনেকের সঙ্গে কাজ করছেন, তবে তাঁর মনে বাঁধা পড়েছেন করিনা কপূর। বাংলা ছবির ভবিষ্যৎ থেকে টলিপাড়ায় জুলুমবাজি, সেই সঙ্গে নিজের সিরিজ় ‘নিকষ ছায়া’ ও ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে কথা বললেন পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়।
প্রশ্ন: ‘পর্ণশবরীর শাপ’ থেকে এ বার ‘নিকষ ছায়া’। তা-ও আবার ভূত চতূদর্শীতে মুক্তি! ‘তেনাদের’ সঙ্গে কি আত্মীয়তা রয়েছে?
পরমব্রত: হ্যাঁ, আছে খুব ছোটবেলা থেকেই। জীবনের নানা পর্যায়ে ‘তেনাদের’ সঙ্গে সখ্য গড়ে উঠেছে। তবে শুরুটা হয়েছিল শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের হাত ধরে। আমার মা বইমেলা থেকে বইটি কিনে দেন। বইটার নাম ‘আধ ছটাক ভূত’। এ ভাবেই মিষ্টি ভূতেদের সঙ্গে পরিচয়। সে ভাবে পরিচয় হয়ে ভাল হয়েছে। প্রথমেই যদি ভয় পেয়ে যেতাম, তা হলে ভালবাসতে পারতাম না। পরে অবশ্য ভূতেদের ভয়াল চেহারাটা বেশি মনে ধরেছে। তাই বলে ভূতেরা মজার হলে ভালবাসি না, তেমন নয়। তবে, ভয়ঙ্কর হলে ভয়ের ওই রসটা পাওয়া যায়। তাই ভূতের সিনেমা আমার দারুণ লাগে।
প্রশ্ন: তন্ত্রসাধনার মতো একটা বিষয় আপনার এই সিরিজ়ে, ‘তন্ত্র’ শব্দটা তো বহুব্যবহৃত। কোন দিকগুলো খেয়াল রাখতে হয়?
পরমব্রত: শব্দটা বহুব্যবহৃত, ফলে এর মূল্যটাও কমেছে। আজকাল সংবাদপত্র খুললেই তন্ত্রসাধকদের বিজ্ঞাপন, কোথাও আবার পিরদের বিজ্ঞাপন। সকলেই নাকি তন্ত্রসাধনা করেন। বহু ব্যবহারে বিষয়টা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তন্ত্র আসলে একটি উচ্চমার্গের সাধনা। এর মূল পীঠ কিন্তু এই পূর্ব ভারত। এটা হাজার বছর পুরনো পদ্ধতি। সেই জন্য তন্ত্রসাধনার ইতিহাসের উপর বিশ্বাস আছে। তবে বিভিন্ন জায়গায় নিজেদের তন্ত্রসাধক বলে পরিচয় দেন যে সব মানুষ, তাঁদের সকলের উপর আস্থা আছে, তেমনটা নয়। তনুকে ত্রাণ করে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে বিলীন হওয়ার যে কথা বলে তন্ত্র, তার প্রতি নিঃসন্দেহে আগ্রহ আছে।
প্রশ্ন: ‘ভুলভুলাইয়া ৩’ মুক্তি পেয়েছে, চলতি বছর ‘শয়তান’ও খুব হিট হয়েছে। তবে কি এই ধরনের ছবির প্রতি আগ্রহ বাড়ছে দর্শকদের?
পরমব্রত: ‘ভুলভুলাইয়া’ সফল একটা ফ্র্যাঞ্চাইজ়ি। ‘শয়তান’ দুম করে ব্যাপক সাফল্য পেয়ে যায় বক্স অফিসে। দু'বছর আগেও ভৌতিক গল্প নিয়ে কাজ করা বেশ কষ্টসাধ্য ছিল যে কোনও ইন্ডাস্ট্রিতে। এখন পুরোটাই উল্টো, মুম্বইয়ে এখন সকলে ভৌতিক গল্পই চাইছে। ‘পর্ণশবরীর শাপ’ করার সময় শ্রীকান্তদা জিজ্ঞেস করেছিলেন ‘হরর গল্প করবি’!
প্রশ্ন: ‘নিকষ ছায়া’ সিরিজ়টা কি সিক্যুয়েল?
পরমব্রত: না, সিক্যুয়েল নয়। এটা ‘ভাদুড়ি মশাই’ ফ্র্যাঞ্চাইজ়ির আলাদা গল্প।
প্রশ্ন: গত বারের তুলনায় এ বার চ্যালেঞ্জিং কোন বিষয়টা ছিল?
পরমব্রত: সত্যিই এ বার চ্যালেঞ্জটা বেশি। কারণ, গত বার পাহাড়ে শুটিং হয়েছিল। এমনিই পরিবেশটা একটু গা-ছমছমে। তাতে মুডটা ক্যামেরায় ধরা যায়। এ বার কিন্তু গল্পটা বারাসতের প্রেক্ষাপটে। তেমন জায়গায় শুট করেছি। এমন একটা জায়গায় ভৌতিক পরিবেশ সৃষ্টি করাটা একটু কষ্টসাধ্য। আমি এটুকু জানি যে, এ বারের গল্পটা আগের বারের তুলনায় রোমহর্ষক। এই গল্পটা শেষ পর্যন্ত দর্শককে বসিয়ে রাখবে।
প্রশ্ন: আমাদের দেশে ভয়ের ছবি কম হয়। তাই এই ধরনের গল্প নিয়ে কাজ করলে রিস্ক ফ্যাক্টর কতটা?
পরমব্রত: ভয়ের ছবি কম হয়, সেটা যেমন ঠিক, তেমনই যে ক’টা হয় তা কিন্তু মনে থেকে যায়। আমাদের ছোটবেলায় রামসে ব্রাদার্স এর বানানো ‘ভিরানা’, ‘পুরানা মন্দির’, ‘পুরানি হভেলি’ এমন নানা ছবি আমরা দেখছি। এবং সেগুলো কিন্তু হিট বক্স অফিসে। যখন টেলিভিশনের পথ চলা শুরু হল, সেই সময় জ়ি,স্টারে নানা হরর শো হত। খুব খাজা ভাবে বানানো, কিন্তু অমোঘ একটা আকর্ষণ ছিল। আমার ওই শোয়ের সুরগুলো পর্যন্ত মনে আছে। বড় পর্দায় খুব কম কাজই হয়েছে। এই জ্যঁরটা নিয়ে রামগোপাল বর্মা বেশ কিছু ছবি বানিয়েছিলেন হিন্দিতে। আমি একটা ছবি করেছিলাম ‘পরি’। আসলে ভৌতিক গল্প নিয়ে খুব বেশি লোক কাজ করে না। করলে বিফলে যায় না। কম কাজ হয়। কিন্তু যখন এই ধরনের গল্প নিয়ে কাজ হয়, তা দর্শক-মনে ছাপ ফেলে যায়।
প্রশ্ন: আপনার বেশির ভাগ হিন্দি কাজের বিষয় হয় ভূতুড়ে, কিংবা গা ছমছমে গল্প, সে ‘পরি’ বা ‘বুলবুল’ হোক, কিংবা ‘আরণ্যক’?
পরমব্রত: আমি যে খুব চিন্তাভাবনা করে চিত্রনাট্যগুলি বেছেছিলাম, তেমন নয়। তবে এই জগৎটা নিয়ে কাজ করতে ভাল লাগে। এত ব্যাপ্তি আছে জগৎটার। কিন্তু, মানুষের জ্ঞান সীমিত। আমাদের পূর্ব ভারতে বাংলা ও অসমে যে ভাবে মাতৃশক্তির আরাধনা করা হয়, উত্তর ভারতে সেটা হয় না। তাই সহজে ওরা আমাদের কালীসাধনাকে বলে দেয় ‘বঙ্গাল কা কালাজাদু’। আমাদের দেবীর অনুচর হিসেবে ভূত, প্রেত, পিশাচেরা থাকে যেমন, তেমনই ‘তেনাদের’ তাড়াতে গেলেও সেই দেবীর আরাধনাই করতে হয়। দশমহাবিদ্যার সঙ্গে আমাদের সম্পর্কটা ভারতের অন্য প্রান্তের লোকেরা বুঝতে পারে না। আমি তো আজকাল পাশ্চাত্য বা হলিউডের হরর ছবি না দেখে ইন্দোনেশিয়া বা তুরস্কের ভূতের ছবি দেখি। ইসলামে তো পরজন্ম, প্রেত... এই ধারণাটা নেই। সেটাকে ওরা সীমাবদ্ধতা হিসেবে না দেখে এই ইসলামিক দেশগুলো যে ভাবে এই জ্যঁরটা নিয়ে কাজ করে তা মুগ্ধ করেছে আমাকে।
প্রশ্ন: ভৌতিক গল্প নিয়ে আপনার কোনও ছবি কি আসবে?
পরমব্রত: হ্যাঁ, গত বছরই ছবিটা শুট করেছি। আমি ও ঋত্বিক চক্রবর্তী আছি। ছবির নাম ‘এখানে অন্ধকার’। সেটা মুক্তি পাবে। আগামী দিনে আরও কাজ করার ইচ্ছে আছে।
প্রশ্ন: চিরঞ্জিৎ চক্রবর্তীকে নিয়ে কাজ করেছেন, দীর্ঘ দিনের অভিজ্ঞতা তাঁর। অভিনেতা হিসেবে তিনি কি পরিচালকের বাধ্য?
পরমব্রত: মোটামুটি বাধ্য। অভিজ্ঞ অভিনেতা ছাড়াও তিনি একজন সফল পরিচালক। ওঁর পরিচালনায় বেশ কিছু হিট ছবি আছে। সেই জায়গাতে কিছু জিনিস ধরিয়ে দেন। আসলে সাধারণ মানুষের নাড়িটা বুঝতে পারেন। যে সব মানুষের ভাবনাচিন্তার কোনও দায় নেই, তাঁদের মনও বুঝতে পারেন। সেটা কাজে লাগে।
প্রশ্ন: আপনি তো ফিল্ম মেকিং নিয়ে পড়াশোনা করে এসেছেন বিদেশ থেকে, তেমন ডিগ্রি হাতে রেখে কাজ করার সুবিধে বেশি, না কি ময়দানে নামলে তবে শেখা যায়?
পরমব্রত: আমাদের দেশে প্রশিক্ষণ বিরোধিতার সংস্কৃতি রয়েছে। আমরা অশিক্ষাকে উদ্যাপন করি। প্রতিভাধর অনেকেই আছেন, যাঁরা কোনও প্রশিক্ষণ ছাড়া স্বক্ষেত্রে দুর্দান্ত সাফল্য পয়েছেন। কিশোর কুমার তার উদাহরণ। যেন বিষয়টা এমন, কিশোর কুমার কোথাও গান গাওয়া শেখেননি বলে আর কাউকে সেটা শিখতে হবে না। উত্তম কুমারও তো অভিনয় শেখেননি। তা বলে কি অন্যদের শিখতে হবে না! কিছু মানুষের সহজাত ভাবে কিছু জিনিস হয়। যদি তা যথাযথ প্রশিক্ষণ না পায়, সেটা তো ভোঁতা থেকে যাবে। সহজাত প্রতিভা ও প্রশিক্ষণ দুইয়ের প্রয়োজন আছে।
প্রশ্ন: বিদেশে ঠিক কতটা শিখেছিলেন?
পরমব্রত: আমি যখন বিদেশে গিয়েছিলাম, সেই সময় সব কিছু থেকে দূরে থাকতে চেয়েছিলাম। পৃথিবীকেও দেখতে চেয়েছিলাম। সেই জন্য সবচেয়ে ভাল ছুতো ছিল পড়তে যাওয়া। সেই কারণে যাদবপুরে স্নাত্তকোত্তরটা শেষ করিনি। আমার নামের পাশে একটা ‘এমএ’ থাকুক, চেয়েছিলাম। বাকি কাজ তো করতে করতে শিখেছি। ওখানে এত ভাষাভাষী ছেলেমেয়েদের সঙ্গে আলাপ হয় যে, আমার কথা বলতে পারাটা অনেক ভাল হয়ে যায়।
প্রশ্ন: পরিচালক হওয়ার দায়িত্ব বেশি, না কি অভিনেতা হওয়ার সুবিধে আছে?
পরমব্রত: একটা কাজের ভাগ্য নির্ভর করে পরিচালকের উপর। তাই সেই দায়িত্বটা অনেক বেশি। অভিনেতাদের উপর যেমন ছবির সাফল্য ও ব্যর্থতা চাপিয়ে দেওয়া হয়, তাই দায়িত্ব তাঁদেরও আছে। সেটা মুম্বইয়ে বেশি হয়, কারণ সেখানে ইন্ডাস্ট্রি তারকাকেন্দ্রিক। দক্ষিণ ভারতেও তারকাকেন্দ্রিক ইন্ডাস্ট্রি। তবে এখন সেখানে পরিচালকেরা উঠে আসছেন। মণিরত্নম, রাজামৌলি তো ছিলেনই, এ ছাড়াও বর্তমান সময়ে প্রশান্ত নীল, লোকেশ কঙ্গারাজের নাম উঠে আসছে। কিন্তু, এখনও এই দুই ইন্ডাস্ট্রিতেই ছবি চলে শাহরুখ খানের নামে কিংবা মহেশ বাবু, অল্লু অর্জুনের নামে।আমাদের এখানে দু’-এক জন হাতেগোনা তারকা। তাই এটা পরিচালক-কেন্দ্রিক ইন্ডাস্ট্রি। ফলে, তাঁদের উপর দায়িত্বটাও বেশি।
প্রশ্ন: অনুষ্কা, রবিনাদের সঙ্গে কাজ করেছেন। পছন্দের বলিউড অভিনেত্রী কারা?
পরমব্রত: এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে আলিয়া ভট্ট ও কৃতি শ্যানন, হুমা কুরেশি... এ ছাড়া তেমন কারওকে মনে পড়েছে না।
প্রশ্ন: কাজ করার ইচ্ছে কোন নায়িকার সঙ্গে?
পরমব্রত: (চওড়া হাসি দিয়ে) করিনা কপূর আমার সারা জীবনের প্রিয়। ওখানে কোনও নড়চড় হবে না। গত বছর একটা কাজের কথাও হয়েছিল। কিন্তু, আর সেটা হবে বলে মনে হচ্ছে না। সেটা নিয়ে একটু মনখারাপ আছে। যা-ই হোক, কাজ হবে। আজ না হোক, কাল হবে। এ ছাড়াও অভিনেত্রী বিদ্যা বালনের বিরাট অনুরাগী আমি।
প্রশ্ন: আপনি করিনার অনুরাগী, কিন্তু আপনারও তো মহিলা অনুরাগীর সংখ্যা কম নয়, বিয়ের পর সেই সংখ্যা কমল?
পরমব্রত: আমি কখনও এই ব্যাপারটা জীবনে খুব গুরুত্ব দিয়ে ভাবিনি। সেটা মনে হয়, ভুল করেছি। মাথায় চিরকাল পরিচালনার পোকা ছিল। সেই জন্য এ দিকটা তেমন নজর দিতে পারিনি। আবির যেমন এটা বেশ সিরিয়াসলি নেয়। তবে হ্যাঁ, মহিলারা আগ্রহ দেখালে কার না ভাল লাগে! যে হেতু সমাজমাধ্যমে অতটা সক্রিয় নই, তাই বুঝতে পারি না। বিয়ের পর থেকে ছবি দিয়ে দেখেছি মন্তব্য বাক্সে বিলাপ থেকে হতাশার বার্তা পর্যন্ত দেদার আসছে।
প্রশ্ন: বাংলা ইন্ডাস্ট্রিতে এত বছর কাজ করছেন। বিড়ম্বনাগুলি কেমন বুঝলেন এতগুলো বছরে?
পরমব্রত: এই ইন্ডাস্ট্রির অনেক ভাল জিনিস আছে। ভাল নয়, এমন জিনিসও আছে। এখানের নিজের ইচ্ছে মতো কাজ করার স্বাধীনতা আছে। আমাদের এখানে গল্পের গুণগত মান মুম্বইয়ের তুলনায় অনেক ভাল। আমরা যে সব গল্প তুড়ি মেরে বলতে পারি, সেগুলি মুম্বইয়ের লোকেরা শুনলে হাঁ হয়ে যান। বাঙালিদের সাহিত্যবোধের জায়গা থেকে গল্প বলার বোধ অনেক ভাল। আমাদের এখানে আমরা অল্পতেই অনেকে ভাল কাজ দিতে পারি। যেটা মুম্বইয়ে লোকেরা ভাবতে পারেন না। যেটা খারাপ দিক সেটা হল, এখানকার লোকেদের ব্যবসা বিরোধী মানসিকতা। ইন্ডাস্ট্রি বিরেধিতাও রয়েছে। প্রযোজককে লাভ করতে দেওয়া যাবে না, এমন মানসিকতা। যেন ‘লাভ’ কথাটা খারাপ কথা। এই ভাবনা থেকে উদ্ভট সব নিয়ম চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
প্রশ্ন: আপনি কি ফেডারশনের চাপানো নিয়মের কথা বলছেন?
পরমব্রত: ওঁরা নিয়ম বানানোর কেউ নন। তাঁরা আদালত, পুলিশ নন, আইন নন। কিন্তু, এতগুলো বছর ধরে নিয়ম চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন। ওঁরা নিজেদের টেকনিশিয়ানদের নেতাবর্গ বলে পরিচয় দিতে ভালবাসেন। আসলে টেকনিশিয়ানদের সংখ্যা অনেক। তাঁরা কখনও এমন কিছু ভাবেন না। যাঁরা নেতা বলে পরিচিত, তাঁরা নিজেদের আপাত স্বার্থ রক্ষা করতে গেলে বড় সুযোগ হাতছাড়া হয়। সাকুল্যে ইন্ডাস্ট্রির ফুলেফেঁপে ওঠার ক্ষেত্রেও প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। বুঝতে হবে, ‘মুনাফা’ কথাটা গালাগালি নয়। লাভ না হলে একজন টাকা ঢালবেন কেন? মুনাফা করতে গিয়ে কেউ যাতে শোষিত না হন, সেটাও দেখার বিষয়। যে হেতু বাংলা ও হিন্দি দুটো ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করি, তাই জানি তাঁরা বলেন, ‘‘এখানে যত দক্ষ লোক রয়েছেন, ততটাই অদ্ভুত নিয়ম আছে।’’ একটা দোটানা রয়েছে এই ইন্ডাস্ট্রিতে।
প্রশ্ন: সিনেমা শিল্প, না কি অঙ্ক?
পরমব্রত: আসলে দুটোই। অনেক মানুষকে নিয়ে কাজ। আবার, অনেক টাকা লগ্নি হয়। তাই দুটোই। এখানে অঙ্ক ও শিল্প দুইয়ের মিলন প্রয়োজন।
প্রশ্ন: বাংলা ইন্ডাস্ট্রিতে আপনি বললেন গল্পের অভাব নেই। গল্পকারও আছেন। তবু জাতীয় স্তরে কাঙ্ক্ষিত জনপ্রিয়তা আসছে কই?
পরমব্রত: আসলে গল্প বলার মধ্যে আমরা বৃহত্তর পশ্চিমবাংলার সঙ্গে যোগাযোগ হারিয়ে ফেলেছি। আমরা দক্ষিণ কলকাতা ভিত্তিক সিনেমার চল শুরু করেছি। যেটা একটা সময় দরকারও ছিল। কিন্তু, একটা সময়ে নিজেদের নাকউঁচুপনার জন্য যোগাযোগটা ছিন্ন করে ফেললাম। একটি আঞ্চলিক ভাষার ছবি জাতীয় স্তরে তখনই পৌঁছবে, যখন তার সাফল্য তাকে সর্বভারতীয় স্তরে মুক্তি দিতে বাধ্য হবে। নতুবা বিদেশে চলচ্চিত্র উৎসবগুলিতে সমাদৃত হবে। আমাদের এর কোনওটাই হয় না। যেটা দক্ষিণী ছবির ক্ষেত্রে হচ্ছে। সেখানকার ছবি এমন সফল হচ্ছে যে, বিভিন্ন ভাষায় মুক্তি পাচ্ছে। আমরা বড্ড বেশি মধ্যমেধার মধ্যে ঘোরাফেরা করছি, যেটা সর্বনেশে। হয় এমন ছবি বানাও যা সবাই বুঝবে, নয়তো এমন কিছু বানাতে হবে, যার শিল্পগুণ সেই পর্যায়ে হবে। কিন্তু, বহু বছর ধরেই এর মাঝামাঝি ঘোরাফেরা করছি আমরা।
প্রশ্ন: সম্প্রতি তিনটি বাংলা ছবি একসঙ্গে মুক্তি পেয়েছে, তিনটেই কী দেখছেন?
পরমব্রত: আমি ‘বহুরূপী’ ও ‘টেক্কা’ দেখেছি।
প্রশ্ন: বক্স অফিস রিপোর্ট বলছে ‘টেক্কা’র তুলনায় বাণিজ্যিক ভাবে বেশি সফল ‘বহুরূপী’, শিবপ্রসাদ-নন্দিতা রায় কি দর্শকের স্পন্দন বুঝতে পারেন?
পরমব্রত: আসলে শিবুদারা প্রথমে ছোট ছোট ছবি দিয়ে নিজেদের ভিত শক্ত করেছেন। পারিবারিক ড্রামা ধাঁচের ছবির মাধ্যমে জায়গাটা পোক্ত করেছেন। যখন সেই জায়গাটা মজবুত হয়েছে, তখন স্লগ ওভারে চালিয়ে খেলতে শুরু করেন। ওঁদের পরিকল্পনা এবং তার বাস্তবায়নের পদ্ধতি ও একনিষ্ঠতাকে কুর্নিশ জানাতে হয়। এর বাইরে ‘বহুরূপী’ ছবিটা আমার ভাল লেগেছে। সব জায়গা নয়, তবে শিবুদার অংশগুলো অসাধারণ। অনেক দিন ধরে বাংলা ছবিতে গ্রাম দেখা যায়নি, যেটা ওদের ছবিতে দেখতে পেলাম।
প্রশ্ন: সৃজিতের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক মধুর, মনঃক্ষুণ্ণ হবেন না পরিচালক... ‘বহুরপী’কে এগিয়ে রাখলেন যে?
পরমব্রত: এটা একটা বিপদ আমাদের ইন্ডাস্ট্রির। ভাল সম্পর্ক মানেই সব সময় ভাল কথা বলতে হবে! সেটা অস্বাস্থ্যকর। ‘টেক্কা’ আমি দেখেছি। খুব খারাপ লাগেনি। মোটের উপর সফল ছবি। খুব বেশি প্রত্যাশা নিয়ে যে ছবিটা দেখতে গিয়েছিলাম, তেমন নয়। সেটা সৃজিতকে জানিয়েছি।
প্রশ্ন: বাংলা ইন্ডাস্ট্রিতে ‘ভাল অভিনেতা’ বললেই আপনি, অনির্বাণ ভট্টাচার্য, ঋত্বিক চক্রবর্তীর নাম উঠে আসে, সত্যিই ভাল অভিনেতার সংখ্যা এতটাই কম?
পরমব্রত: প্রচুর ভাল অভিনেতা আছেন আসলে। আমার মনে হয়, অনেক ভাল অভিনেতাকেই ব্যবহার করা হয় না। আমি গৌরব চক্রবর্তীর কথাই বলতে চাই। সিনেমা বানানোর টেকনিক নিয়ে এতটাই জ্ঞান ওর। ও রকম অভিনেতা কম দেখেছি। সেটা নিজের এত বছরের অভিজ্ঞতা থেকেই বলছি। ওকে কিছু বলে দিতে হয় না। কেউ কেউ আছেন, চরিত্রের অন্তর্জগৎ ভাল বোঝেন, কিন্তু টেকনিক্যাল দিকটা নড়বড়ে থাকে। অভিনয় করতে গেলে এই দুটোই প্রয়োজন। গৌরবকে কি বাণিজ্যিক ছবির নায়ক হিসেবে দেখি আমরা? আবার আমার মনে হয়, অঙ্কুশ হাজরা অভিনেতা হিসেবে ভাল। কিন্তু অন্য রকম কিছু চরিত্র তাঁকে দেওয়া হয় না। তেমনই অভিনেতা হিসেবে ভাল বলে মনে হয় সোহম চক্রবর্তীকেও। সুতরাং, নাম অনেক আছে, তাঁদের সুযোগ দিতে হবে।
প্রশ্ন: এত ব্যস্ততা, মুম্বই-কলকাতা করছেন সর্ব ক্ষণ, সদ্য বিয়ে করেছেন, পিয়ার সঙ্গে সংসার কেমন চলছে?
পরমব্রত: ভাল চলছে। আমি ও পিয়া মানুষ দুটো এমন, যাঁদের অট্টালিকা, ফলস সিলিং বহুতলের চব্বিশ তলায় থাকতে হবে, এমন স্বপ্ন নেই। আমাদের ভাল লাগে পুরনো কলকাতা, উঁচু সিলিংয়ের ঘর, মোজ়েইকের মেঝে, গ্রিলের বারান্দা, ফ্রেঞ্চ লুভ্যর জানলা... সে সব নিয়ে গোছানো সংসার। যা আছে আমাদের, সেটাই গুছিয়ে রাখি। আর তাতেই আনন্দ পাই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy