লতা মঙ্গেশকর কোনও দিন খেয়াল গাননি। একই ভাবে বড়ে গুলাম আলি খাঁ সাহেব ছায়াছবির গান রেকর্ড করেননি। কেন গাননি? শাস্ত্রীয় সঙ্গীতশিল্পী অজয় চক্রবর্তীর মতে, “ছায়াছবি আর রাগাশ্রয়ী গানের মধ্যে সেতুবন্ধ তৈরি হয়নি বলে।” তাঁর আফসোস, “এই মেলবন্ধন যে যে গানে তৈরি হয়েছে সে সব গান কালজয়ী। আজও নানা অনুষ্ঠানে সেই গান শোনা যায়। যে সমস্ত গান এই ধারার বাইরে তারা স্থায়ী হয়নি।” এই প্রজন্মের মধ্যে সেই সচেতনতা আনতেই শিল্পী শুক্রবার খড়্গপুর আইআইটি-তে তাঁর সঙ্গীত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শ্রুতিনন্দনের পক্ষ থেকে একটি বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছেন। অনুষ্ঠানের নিবেদক গায়ক-পুত্র অনঞ্জন চক্রবর্তী। পণ্ডিতজির সঙ্গে থাকছেন অরিত্র চক্রবর্তী, মেধা বসু-সহ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের একঝাঁক শিক্ষার্থী।
রাগাশ্রয়ী গানের সঙ্গে কি ছায়াছবির গানের বিরোধ? ষাট বা সত্তর দশকের হিন্দি-বাংলা ছবির গানে কিন্তু রাগাশ্রয়ী সুর শোনা যেত। তার পরেও হয়েছে। যেমন, সঞ্জয় লীলা ভন্সালীর ‘হম দিল দে চুকে সনম’ ছবিতে সুলতান খান, কবিতা কৃষ্ণমূর্তি, শঙ্কর মহাদেবন গেয়েছিলেন ‘আলবেলা সজন আয়ো রে’ ...। প্রসঙ্গ তুলতেই শাস্ত্রীয় সঙ্গীতশিল্পীর যুক্তি, “শাস্ত্রীয় সঙ্গীতশিল্পীদের অনেকেই মনে করেন, ছায়াছবির গান অত্যন্ত লঘু। দুই ধারার গানের মেলবন্ধন ঘটেনি বলেই এই সচেতনতার অভাব।” তিনি জানিয়েছেন, যে যে ছবির গানে দুই ধারা মিলেছে তখনই সেই গান চিরকালীন হয়েছে। তাই প্রয়াত রাশিদ খানের গাওয়া গান এই প্রজন্ম গানের রিয়্যালিটি শো-তে পরিবেশন করেন।
এই জায়গা থেকেই শিল্পীর দাবি, “যে গান জনপ্রিয় সেই গানে কোনও না কোনও রাগের ছোঁয়া রয়েছে।” তাঁর দুঃখ, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এখন আর সেই ধারা বজায় নেই। কারণ হিসেবে তিনি জানিয়েছেন, রাগসঙ্গীতের মূল্য এখনও সঠিক জানেন না দেশবাসী। অথচ ভারতীয় সঙ্গীত বিশ্বের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। রাগাশ্রয়ী গান সম্পর্কে সচেতনতা নেই বলেই ভারতবাসী এ সম্বন্ধে সজাগ নন। এই কারণেই কি বাংলা বা হিন্দি ছবির গান আগের মতো দীর্ঘস্থায়ী নয়? এই প্রশ্নের সঙ্গে সহমত অজয়। তাঁর কথায়, “এই প্রজন্মের সুরকারদের মধ্যে সেই শিক্ষা নেই, যা ষাট বা সত্তর দশকের সুরকারদের মধ্যে ছিল। তাঁরা খ্যাতনামী শাস্ত্রীয় সঙ্গীতশিল্পীদের থেকে তালিম নিয়ে গানের সুর দিতেন। এই প্রজন্মের সেই তালিম কোথায়?”
আরও পড়ুন:
অজয়ের মতে, তালিম, রেওয়াজ, শিক্ষার অভাবেই এই প্রজন্মের গায়কেরা ক্ষণস্থায়ী। রিয়্যালিটি শো থেকে যাঁরা উঠছেন, তাঁরা নির্দিষ্ট সময়ের পর হারিয়ে যাচ্ছেন। ব্যতিক্রমীদের কথাও তিনি বলেছেন। তাঁর বক্তব্য, “সোনু নিগম, শ্রেয়া ঘোষাল, সুনিধি চৌহান, অরিজিৎ সিংহ— এঁরা সঠিক তালিম নিয়েছেন। নিয়মিত রেওয়াজ করেন। তাই ওঁরা থেকে গেলেন।” ছায়াছবির গানে যাতে আবার আগের মতো রাগ-রাগিনীর সুর শোনা যায় তার জন্য কী প্রয়োজন? শাস্ত্রীয় সঙ্গীতশিল্পীর জবাব, “প্রয়োজন সচেতনতা। তার জন্যই আমার এই অনুষ্ঠান। পাশাপাশি, সুরকারেরাও এই অভাব মেটানোর তাগিদ অনুভূব করছেন। তাই আমার সঙ্গে আলোচনায় বসেন এআর রহমান বা শঙ্কর-এহসান-লয়ের মতো সুরকার-শিল্পীরা।” অজয় চক্রবর্তীর মতে, তাঁরা বুঝেছেন ছায়াছবিতে রাগাশ্রয়ী গান ছাড়া গতি নেই।