Advertisement
E-Paper

কোনও মেয়ের বুকের খাঁজের দিকে তাকানোকে আজও স্বাভাবিক ঘটনা হিসাবে দেখা হয়: মিমি

“আমাকে মা এক দিন বলছিল, ‘আজকাল এত সংসার ভেঙে যাচ্ছে।’ আমি মাকে বলেছিলাম, মা, সংসার ভেঙে যাচ্ছে না। মানুষ সঠিক দিকটা বেছে নিচ্ছে,” বললেন মিমি চক্রবর্তী।

Image of Mimi Chakraborty

‘ডাইনি’ ওয়েব সিরিজ়ের নেপথ্যকাহিনি শোনালেন মিমি চক্রবর্তী। ছবি: সংগৃহীত।

স্রবন্তী বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২১ মার্চ ২০২৫ ০৮:৫১
Share
Save

প্রশ্ন: মিমি কি ‘ডাইনি’?

মিমি: বলব না। সিরিজ় দেখতে হবে।

প্রশ্ন: মারপিট, রক্ত, ভাল লাগে অভিনয় করতে?

মিমি: সত্যি কথা বলতে, আমি এই ধরনের মারপিটের দৃশ্যে খুব সাবলীল। আমার ভাল লাগে। প্রচুর রিহার্সাল করেছি আমরা। খলনায়কের চরিত্রে যিনি অভিনয় করেছেন তিনি অভিনয়ে নতুন। প্রচুর মারপিটের দৃশ্য ছিল। ১৩ থেকে ১৪ মিনিটের মতো মারপিটের দৃশ্য। তার উপর যা গরম ছিল। প্রস্থেটিক মেকআপের ভেতরে ঘেমে যাচ্ছি। কিছু করতে পারছি না। এক দিকে রক্ত পড়ছে, এক দিকে ঘাম ঝরছে, মাথায় হাত দিতে পারছি না। একটাই বাঁচোয়া, নো মেকআপ লুক ছিল। কাজল পরে, চুল আঁচড়ে সেটে চলে যেতাম। প্রস্থেটিক মেকআপ করতে যা সময় লাগত। যে হেতু এক দিনের গল্প, এখানে দেখা যাচ্ছে সময়ের সঙ্গে মুখেচোখে ক্ষত আরও বেড়ে যাচ্ছে।

প্রশ্ন: ‘ডাইনি’ নির্মাণের নেপথ্য গল্পটা কেমন ছিল?

মিমি: নির্ঝর যখন আমার কাছে চিত্রনাট্য নিয়ে আসে তখন ওকে বলেছিলাম, এখন তো আর এ সব হয় না রে। ও তখন আমাকে একটা তথ্যচিত্র দেখিয়েছিল। কত মেয়েকে ডাইনি অপবাদে পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে। গ্রামের দিকে পিতৃতান্ত্রিক চিন্তাভাবনা প্রখর। এখনও ডাইনি প্রথা সংক্রান্ত নানা ঘটনা শোনা যায়।

গ্রামে কোনও এক মহিলার স্বামীর মৃত্যু হল। স্বামী তাঁর স্ত্রীর জন্য সম্পত্তি রেখে গিয়েছেন। এ বার যিনি গ্রামের মোড়ল ও তাঁর ছেলেরা সেই সম্পত্তি গ্রাস করবেন! দেখছেন মহিলা একা, তাঁর কেউ নেই। এ ভাবেই তো নিজেদের সম্পদ বৃদ্ধি করেন তাঁরা। মানুষ চাঁদে যাচ্ছে, মঙ্গল গ্রহে যাচ্ছে, আর এ দিকে এখনও কিছু জায়াগায় আমরা মেয়েরা ঘোমটা টেনে বসে আছি!

প্রশ্ন: পড়াশোনা করতে হয়েছে বিস্তর?

মিমি: হ্যাঁ, অনেক কিছু জেনেছি। কিছু গ্রামাঞ্চলে এমন ঘটনা ঘটে! আমি জানি না, নাম উল্লেখ করা ঠিক হবে কি না। একজন মহিলার একটি পরিবারে বিয়ে হল। সেই পরিবারের সকল পুরুষের সঙ্গে তাঁর সহবাস! ভাবলেই কী রকম গা গুলিয়ে ওঠে। আর সে সব অঞ্চলে এটা খোলাখুলি বলা হয়! স্বামীর সঙ্গে সহবাসে সন্তান আসছে না, পরিবারের বাকি পুরুষদের সঙ্গে চেষ্টা করো! এ কী ভয়ঙ্কর ব্যাপার!

খুব অদ্ভুত লাগে। কিছু বলতে গেলেই সবাই বলবে নারীবাদী। আমরা নারীবাদী নই, দীর্ঘ বছর ধরে এত অবদমিত রাখা হয়েছে নারীদের, এ বার তারা স্বপক্ষে আওয়াজ তুলছে এই যা। ‘ডাইনি’তেও দুই বোনের বেঁচে থাকার লড়াই তুলে ধরা হয়েছে।

প্রশ্ন: ‘ডাইনি’ চ্যালেঞ্জিং মনে হয়েছিল না কি আত্মবিশ্বাসের পাল্লা ভারী?

মিমি: ইন্ডাস্ট্রিতে ১৫ বছর পার করে ফেলেছি। এখন এই ধরনের চরিত্রে অভিনয় করব না তো আর কবে করব? আমার কাছে এই ধরনের চরিত্রে অভিনয় চ্যালেঞ্জিং নয়, বরং ভালই লাগে এই ধরনের চরিত্রে অভিনয় করতে। এই ধরনের চরিত্র যে লেখা হচ্ছে এখন, তাতে আমি ভীষণ খুশি। লোকে যে কেন ভাবে আমি এ ধরনের চরিত্রে অভিনয় করতে চাই না! ‘ডাইনি’র পরে পরে এই ধরনের চরিত্রের কিছু চিত্রনাট্য এসেছে আমার কাছে। এখন আমার প্রশ্ন, তুমি আগে এলে না কেন? আমি করে ফেলার পরে কেন আসছ? এখন তো আমি এই ধরনের চরিত্র করে ফেলেছি, পুনরাবৃত্তি কেন করব?

গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।

গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।

প্রশ্ন: এটা ছবি হতে পারত না?

মিমি: হ্যাঁ, হতেই পারত। বড় বাজেটের সিরিজ়। আমরা গাড়ি এনেছি, পুড়িয়েছি। বিস্ফোরণ ঘটিয়েছি। এই নির্ঝর শুনে যা… (পরিচালক নির্ঝরকে ডেকে নিলেন মিমি।)

নির্ঝর: ছবি হতে পারত। ভাগে ভাগে হচ্ছিল। একটা পর্বের পর আর একটা। শুটিংয়ের পরেও এক বার ভেবেছিলাম, এটা ছবি করলে কেমন হয়। কিন্তু এডিটে যাওয়ার পর বুঝলাম সিরিজ়ই ঠিক আছে।

প্রশ্ন: অভিনেত্রী হিসাবে মিমিকে কেমন দেখলেন?

নির্ঝর: দুর্দান্ত।

মিমি: আমার সামনে বসে রয়েছে আর কী বলবে! দুর্দান্ত বলছে। (হাসি)

নির্ঝর: না। ওঁর একটা ধারাবাহিকতা রয়েছে। শিল্পের প্রতি ওঁর নৈপুণ্য বার বার প্রকাশ পায়। বাকি অভিনেতারা সকলেই নতুন।

প্রশ্ন: একসঙ্গে এত নতুন মুখ। অভিনয়ের সামঞ্জস্যে অসুবিধা হয়নি?

মিমি: আমরা সেটে সবাই মিলে একসঙ্গে থাকতাম। নতুনদের ভুল হলে সেটা নিয়ে উচ্চবাচ্য না করা, আড্ডা দেওয়া ইত্যাদি। আমার একার কাজ নয় এটা, মিমি চক্রবর্তীর কাজ নয়। আমি তো ভাল করবই, সে জন্যই তো আমাকে নিয়েছে। কিন্তু আমি যদি সবাইকে নিয়ে ভাল করতে পারি তা হলে সেটা পুরোপুরি আমার কাজ। নির্ঝর খুব ভাল কাস্টিং করেছে। আমি বলতাম, চিল কর। গাড়ির চালকের চরিত্রে যে অভিনয় করেছে সেটে বলত, “আমি না ভুল করতেসি।” জলপাইগুড়ির ভাষা আমার ভাল লাগত। আমি বলতাম, “করো ভুল, আমার ভাল লাগে।”

প্রশ্ন: ডাইনি প্রথা বন্ধ হবে বলে মনে হয়?

মিমি: হতে তো হবেই! যে দিন নারী-পুরুষ পুরোপুরি ভাবে সমানাধিকার পাবে সে দিন বন্ধ হবে। যে দিন ‘ফেমিনিজ়ম’কে আলাদা ‘স্ল্যাং’ বলে ধরা হবে না সে দিন বন্ধ হবে। কত রকম কথা। মহিলারাই তো এই সমাজের খলনায়ক। আমরা এ রকম জামাকাপড় পরি বলে এটা হয়। আমার স্বামীর মৃত্যু হয়েছে মানে আমার দোষ। অল্প বয়সে বিয়ে, তার পর স্বামীর মৃত্যুর পর আজীবন আমাকে ন্যাড়া হয়ে থাকতে হবে!

উপজাতি অঞ্চলে যদি কোনও পশুর মৃত্যু হয়, সে সময় তোমার যদি কোনও অসুখ হয় সে জন্ডিস হোক বা সামান্য ঠান্ডা লাগা, তুমি ডাইনিই। বাড়ির বাইরে ওরা কিছু জিনিস ঝুলিয়ে রাখে। তুমি জল নিতে পারবে না। কেউ এক দিন বাড়ির বাইরে খাবার ছুড়ে দেবে দূর থেকে, যেন তোমার কোভিড হয়েছে।

আজ আমার ঋতুচক্রের প্রথম দিন। বিগত দু’দিন ধরে ভাল করে ঘুমোতে পারিনি। এখন যদি আমি কোনও অনুষ্ঠানে ক্যামেরার সামনে কোনও ভাবে অসন্তোষ প্রকাশ করে ফেলি, কেউ বুঝবে না আমার অসুবিধাটা। সবাই আমার ওই বিরক্তি প্রকাশটাকেই তুলে ধরবে!

প্রশ্ন: অন্য মহিলাদেরও এমন মগজধোলাই করা হয়েছে যে তাঁরাও প্রতিবাদ করেন না?

মিমি: ওঁরা তো ভাবেন এটাই তাঁদের ভবিতব্য। বিহারে একটা পরিবারে বাবা, কাকা, ছেলে। সম্পর্ক তিন ধরনের। এমন অবস্থা, বুঝতেই পারা যাবে না মেয়েটি কার বৌ! একটি তথ্যচিত্রে দেখেছিলাম, এই প্রসঙ্গে এক মহিলা বলছেন, “আমি তো এই জন্যই তৈরি।” মানে ভাবুন, তাঁর মানসিকতাকে এই ভাবেই তৈরি করা হয়েছে। আমি তো শুনে হতবাক। ঠিক এই কারণেই মেয়েদের পড়াশোনাকে গুরুত্ব দেওয়া হয় না।

‘ডাইনি’ ওয়েব সিরিজ়ের একটি দৃশ্যে মিমি চক্রবর্তী।

‘ডাইনি’ ওয়েব সিরিজ়ের একটি দৃশ্যে মিমি চক্রবর্তী। ছবি: সংগৃহীত।

প্রশ্ন: অনেক শিক্ষিত মহিলারাও তো বলেন, ছেলে তো একটু রাগী হবেই! রাগের মাথায় হাত উঠে গিয়েছে।

মিমি: একদম! অনেক শিক্ষিত পরিবারেই শুনেছি, “ছেলেরা তো একটু মারবেই।” আমাকে মা এক দিন বলছিল, “আজকাল এত সংসার ভেঙে যাচ্ছে।” আমি মাকে বললাম, মা সংসার ভেঙে যাচ্ছে না। মানুষ সঠিক দিকটা বেছে নিচ্ছে। আমার বাবা ভালমানুষ, তাই তুমি রয়ে গিয়েছ। তোমার মতো আরও অনেকে রয়ে গিয়েছে কারণ তারা স্বাবলম্বী নয়। আজ আমাকে বেরিয়ে মা-বাবার বাড়িতে যেতে হবে না। আমি ভাড়াবাড়িতে থাকতে পারব। নিজের ছেলেমেয়েকে অন্য জীবন দিতে পারব কারণ আমি পড়াশোনা করেছি। কাজ করি। আমি স্বাধীন।

একটা ঘটনা বলি। আমাদের পিছনে বিহারি পট্টিতে দেখি রোজ ঝামেলা হচ্ছে কোনও না কোনও পরিবারে। এক দিন দেখি, এক মহিলাকে চড়, থাপ্পড়, ঘুষি মারা হচ্ছে। অন্য লোকে গিয়ে বাঁচাচ্ছে। সেখানে ওই মহিলা বলছেন, “আমার মরদ তো আমাকে মারবেই।” আমি তো হাঁ!

প্রশ্ন: সমাজমাধ্যমের প্রভাব রয়েছে, কী মনে হয়?

মিমি: একেবারেই তাই। এই যে সমাজমাধ্যমে ট্রোলিং ব্যাপারটাকে খুব একটা গুরুত্ব দেওয়া হয় না। কমেন্ট সেকশনে মেয়েদের গালিগালাজ করে, ধর্ষণের হুমকি দিয়ে চলে যায়। এই জন্যই আমি আমার ট্রোলারদের আদালত পর্যন্ত টেনে নিয়ে গিয়েছিলাম। সব সময় উপেক্ষা করলে ওরা ভাবে যেটা করছে সেটা ঠিক। আর যারা এই ধরনের হুমকি দিতে পারে, তারা মনে করে কোনও মেয়ের হাত ধরে টানলে তাতে কোনও ভুল নেই। কোনও মেয়ের বুকের খাঁজের দিকে তাকানোটাও ঠিক। স্বাভাবিক ঘটনা হিসাবে দেখা হয় এই ঘৃণ্য কাজগুলোকে। আমি দুঃখিত সেই সব বাচ্চাদের জন্য যারা এটা ভেবে বড় হয়েছে যে, মহিলাদের এগুলো বলাই যায়! ওরা যে পরিবেশে বড় হয়েছে, ওদের সংস্কৃতি নিয়ে আমি দুঃখিত। এই দেশটা কোথায় যাচ্ছে! এটা ভেবে আমি দুঃখিত।

প্রশ্ন: মিমি নিজে কখনও এই ধরনের ঘটনার সম্মুখীন হয়েছেন?

মিমি: আমি যখন এই শহরে এসেছিলাম, মা-বাবা, কাকা, দাদা কেউ ছিল না। আমি একাই এসেছিলাম। তখন কিন্তু পরিস্থিতি এ রকম ছিল না। কেউ এক জন রাস্তায় পিছু নিলে অন্য চার জন তাকে রীতিমতো মার দিত। আমিই পিটিয়েছি কত জনকে!

প্রশ্ন: এখন একটা নতুন ট্রেন্ড চোখে পড়ছে। রাখী গুলজ়া, শর্মিলা ঠাকুর, মিঠুন চক্রবর্তী, বর্ষীয়ান অভিনেতারা নতুন বছরের বাংলা ছবির মুখ। নতুন মুখ কি নেই?

মিমি: আমার মনে হয় না বিষয়টা এ রকম। চরিত্র, চিত্রনাট্য ভেবে কাস্ট করা হয়। দর্শক যেটা ভালবাসে ছবিনির্মাতারা সেটাই করে। যখন বাণিজ্যিক ছবি চলছিল, রিমেক চলছিল তখন দর্শক সেগুলোই ভালবাসত। পুরনোদের লোকে দেখতে চাইছে।

Mimi Chakraborty Dainee Bengali Actress New Web series

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}