বছর তিনেক আগের কথা। চলচ্চিত্র উৎসবের উদ্বোধনী মঞ্চে হঠাৎ মুখোমুখি সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় ও জয়া বচ্চন। ‘সাবিত্রীদি, ধন্যি মেয়ে!’— বলে ছুটে গিয়ে তাঁকে জড়িয়ে ধরেছিলেন ‘ধন্যি মেয়ে’-র ‘মনসা’ জয়া। দুনিয়ার যেখানেই যান, বাঙালিরা এখনও ‘ধন্যি মেয়ে’র কথা মনে রেখেছেন, মঞ্চে দাঁড়িয়ে জয়া সে দিন বলেছিলেন।
‘ধন্যি মেয়ে’-র পরিচালক অরবিন্দ মুখোপাধ্যায় ততদিনে অবশ্য সামাজিক জীবন থেকে কার্যত অবসর নিয়েছেন। টালিগঞ্জে টেকনিশিয়ান্স স্টুডিও লাগোয়া মধ্যবিত্ত পাড়ার বাড়ির অন্দরমহলে সমকালের যাবতীয় উত্তেজনা থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছেন মাঝ নব্বইয়ের কোঠায় ঢুকে পড়া বৃদ্ধ। দু’চোখে অন্ধকার, তাঁর মুখের কথা প্রায় বন্ধ। যদিও অরবিন্দবাবুর ছবি— অগ্নীশ্বর, নিশিপদ্ম, নতুন জীবন, মৌচাক, ধন্যিমেয়ে নিয়ে বাঙালির মুগ্ধ আলোচনা কখনও থেমে থাকেনি।
মৌচাক ছবির দৃশ্য
বুধ-সকালে টালিগঞ্জের বাড়িতেই বাংলা ছবির ওই প্রিয় পরিচালকের জীবনের চিত্রনাট্যে পূর্ণচ্ছেদ পড়ল। বার্ধক্যজনিত অসুস্থতায় ৯৬ বছর বয়সে প্রয়াত হলেন অরবিন্দ ওরফে ইন্ডাস্ট্রির ‘ঢুলুবাবু’। তাঁর দুই ছেলে, মেয়ে ও তাঁদের পরিবার আছেন। প্রয়াত পরিচালককে শ্রদ্ধা জানাতে ফুল পাঠানো হয়েছিল মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তরফে। সিরিটি শ্মশানে এ দিন দুপুরে বর্ষীয়ান পরিচালকের শেষকৃত্য সম্পন্ন হওয়ার সময়ে নতুন করে তাঁর ছবি নিয়ে আলোচনা করেছে আজকের টলিউড।
মৃণাল সেনের থেকেও দু’বছরের বড় অরবিন্দবাবু। বয়সের নিরিখে তিনিই ছিলেন টালিগঞ্জের ফার্স্ট সিটিজেন। তবু তাঁর ছবি যেন আজও প্রাসঙ্গিক। ‘ঢুলুবাবু’র স্নেহধন্য প্রসেনজিৎই যেমন বলে উঠলেন, ‘‘ওঁদের গল্প বলার ঘরানাটাই কিন্তু বাংলা ছবিতে আবার ফিরে আসছে। সময়ের নিয়মে ছবির মেকিং পাল্টাতে পারে। কিন্তু গল্প বলা, সাহিত্য নির্ভরতার যে পথ ঢুলুবাবুরা দেখিয়েছিলেন, সেটাই এখনও বাংলা ছবির অক্সিজেন।’’
গত দু’-তিন বছরে ফেলু-ব্যোমকেশদের গোয়েন্দা-কাহিনি বাদ দিলে বক্স অফিসে সাফল্যের মুখ দেখেছে গুটি কতক বাংলা ছবি। সেই কাহিনি বা গল্প বলার মুন্সিয়ানাই তাদের প্রাণভোমরা। নায়িকা ঋতুপর্ণা সেনগুপ্তও বলছেন, ‘‘ভাল গল্প বা কনটেন্টের জোরে অরবিন্দবাবুরা ছবির ভিতটা গড়ে দিতেন। তাতে তারকাদের কাজটা সোজা হয়ে যেত।’’
তবু বাংলা ছবির ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর সত্যজিৎ-ঋত্বিক-মৃণালদের দাপটে বরাবরই খানিকটা যেন স্বীকৃতি পাওয়ার ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়েছেন সে-যুগের পরিচালকদের একাংশ। অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়ও সেই দলেই পড়বেন। তবে আম দর্শকদের মনে স্থায়ী জায়গা করে নেওয়ায় ঢুলুবাবুদের জুড়ি মেলা ভার।
ধন্যি মেয়ে ছবির দৃশ্য
সত্যজিৎ-ঋত্বিক-মৃণালপন্থী না হয়ে আলাদা পথে হেঁটেই তপন সিংহ, অজয় কর, তরুণ মজুমদার, অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়রা নিজেদের পৃথক ঘরানা চিনিয়ে গিয়েছেন। নির্মল দে, বিভূতি লাহা (অগ্রদূত), সরোজ দে (অগ্রগামী) পার্থপ্রতিম চৌধুরী, পিনাকী মুখোপাধ্যায়দেরও স্বতন্ত্র যুগ।
ছবিতে নিটোল গল্প বলার আর এক ওস্তাদ অশীতিপর তরুণ মজুমদারও অরবিন্দবাবুর ছবি নিয়ে মুগ্ধ। বলছেন, ‘‘বাংলা ছবির ওই রস, বোধ, সাহিত্যনির্ভরতা, চরিত্রগুলো দক্ষতার সঙ্গে বার করে আনা, এখন কোথায়?’’
অথচ অরবিন্দবাবুর কিছু ছবির প্রিন্ট (তাঁর প্রথম ছবি ‘কিছুক্ষণ’, বর্ণচোরা’) হারিয়ে গিয়েছে। দাদা বনফুল বা বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়ের একটি গল্প অবলম্বনে ‘কিছুক্ষণ’ই তাঁর সব চেয়ে প্রিয় ছবি— দু’বছর আগে আনন্দবাজারকে শেষ সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন ঢুলুবাবু। রবি ঘোষের ফিল্মে আবির্ভাবও ‘কিছুক্ষণ’-এই।
গত কয়েক বছরের বাংলা ছবিতেও কিন্তু তারকাদের ছাপিয়ে যাচ্ছে গল্প। শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়-নন্দিতা রায়ের ‘বেলাশেষে’, ‘রামধনু’, সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের ‘চতুষ্কোণ’-‘রাজকাহিনি’, কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘শব্দ’, অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়ের ‘ওপেন টি বায়োস্কোপ’-এর মতো সফল বা আংশিক সফল ছবিতেও তরুণ নায়ক-নায়িকা জুটির প্রাধান্য খর্ব। গল্পটাই আসল।
সৃজিতের কথায়, ‘‘তপনবাবু, তরুণবাবু, অজয়বাবু, অরবিন্দবাবুদের ছবিই আমার ফিল্ম স্কুল।’’ অরবিন্দবাবুর ছবির অভিনয়ের ‘পিচ’ পছন্দ সৃজিতের। আবার নিশিপদ্ম, অগ্নীশ্বর—প্রিয় শিবপ্রসাদের। অনিন্দ্যর কাছে দারুণ প্রিয় অরবিন্দবাবুর ছবির ছোট ছোট মজা। ‘ধন্যি মেয়ে’য় হাড়ভাঙা ও সর্বমঙ্গলা ক্লাবের ফুটবলযুদ্ধ ঘিরে টক্কর, নায়ক-নায়িকার ঘুঁটের মালা পরানোর রোম্যান্স বা মৌচাকে একটি ছোট চরিত্রে দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাকতাল্লা মুখস্থ তাঁর। এবং ছবিতে গানের ব্যবহার। ‘কিছুক্ষণ’-এর ‘রাজার পঙ্খী উইড়া গেলে’ (শ্যামল), ‘নিশিপদ্ম’-র ‘আমার সকল সোনা’ (সন্ধ্যা), ‘মৌচাক’-এর ‘এ বার ম’লে সুতো হব’ (মান্না), বা ‘ধন্যি মেয়ে’র ‘এ ব্যথা কী যে ব্যথা’ (হেমন্ত), র মতো গানের জন্যও অরবিন্দবাবুর কাছে বাঙালির ঋণ শোধ হবে না।
‘ধন্যি মেয়ে’-তে জহর রায়ের হাড়ভাঙা ক্লাবকে হাফ ডজন গোলে হারিয়েছিল, উত্তমকুমারের সর্বমঙ্গলা। গল্পে, গানে, দৃশ্যে, সংলাপে, হাসিতে অরবিন্দবাবুও বার বার বাঙালির মনের পেনাল্টি বক্স টপকে গিয়েছেন। রুপোলি পর্দায় ‘খেলা’-র যে ধারার আবেদন আজকের সৃজিত, শিবপ্রসাদ, অনিন্দ্যরাও কাটিয়ে উঠতে পারছেন না। ঢুলুবাবুর মাহাত্ম্য এখানেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy