মা মমতাশঙ্করের ৭০তম জন্মদিনে ছেলে রাতুলশঙ্কর। ছবি: ফেসবুক।
আমাদের পরিবারের সকলেই বিনোদন বা সংস্কৃতির দুনিয়ায় রথী-মহারথী। উদয়শঙ্কর-অমলাশঙ্করই বলুন বা মমতাশঙ্কর-চন্দ্রোদয় ঘোষ কিংবা আনন্দশঙ্কর-তনুশ্রীশঙ্কর। এই পরিবারের সন্তান আমি। কিন্তু ওঁরা এতটাই মাটির কাছাকাছি যে আমাদের কোনও দিন বুঝতে দেননি— ওঁরা কী বা কতখানি। আমাদের কাছে ওঁরা কিন্তু দিদা-দাদু, মা-বাবা, মামা-মামি। যেমন আর পাঁচটি পরিবারে হয়। এখন যত বড় হচ্ছি ওঁদের প্রকৃত অবস্থান উপলব্ধি করতে পারছি। মায়ের কথাই ধরুন। যত বলব ততই কম। আমার যে মূল্যবোধ তা কিন্তু মায়ের থেকেই পাওয়া। একই ভাবে নিয়মানুবর্তিতাও। নাচ আর অভিনয়ের বাইরে মা খুব ভাল রাঁধতে পারেন।
ছোট থেকে মায়ের সফরসঙ্গী
মাত্র দু’বছর বয়স। তখন থেকেই আমি মায়ের সফরসঙ্গী। সেই সময় মা তাঁর দল নিয়ে প্রায়ই বাইরে যেতেন। মনে আছে, মা শো করতে মঞ্চ উঠছেন। আমি উইংসের পাশে একটা চেয়ারে বসে মাকে দেখছি। এত ব্যস্ত, এত নামডাক— তবু মা বা বাবা কোনও দিন আমাদের বা আমাদের শৈশবকে অগ্রাহ্য করেননি। একই ভাবে আমার স্কুলের কাছেও কৃতজ্ঞ। আড়াই-তিন মাসের জন্য বিদেশযাত্রাতেও অধ্যক্ষ অনুমতি দিতেন। আসলে মা-বাবা চাইতেন না, আমি বা আমার ভাই ছোটবেলায় ওঁদের থেকে দূরে থাকি।
পাশাপাশি এ-ও বোঝানো হয়েছে, আমাদের মা একটু হলেও আলাদা। তিনি কাজ করেন এবং সেটা করতে হবে তাঁকে। প্রয়োজনে তাঁরা আমাদের বাড়িতে রেখে কাজে যাবেন। ছোট থেকে বিষয়টি দেখতে দেখতে আমরাও অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম। তার মধ্যেও, শরীর খারাপ হলে কি মায়ের জন্য বায়না করতাম না? বাচ্চারা যেমন করে থাকে। সেই সময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতেন দিদা আর মাসি। পুরোপুরি মায়ের জায়গা নিয়ে নিতেন। কলকাতায় থাকলে মা অনুষ্ঠান শেষ হলে প্রায় দৌড়ে বাড়ি ফিরতেন। বিদেশে থাকলে সেটা সম্ভব নয়। তখন হোয়াট্সঅ্যাপ, ফ্যাক্স বা ভিডিয়ো কল আবিষ্কার হয়নি। মা ট্রাঙ্ক কলে আমাদের খবর নিতেন। একটু বড়বেলায় স্কুলের চাপ বাড়লে আমরা দিদার কাছেই থেকে যেতাম।
আমাকে পেটুক বানিয়েছেন মা...
ইন্ডাস্ট্রিতে আমার খাওয়া নিয়ে সুনাম বা দুর্নাম যা-ই রয়েছে, তার নেপথ্য কারণ মা। ছোট থেকে খেতে ভালবাসি। খুবই খাদ্যরসিক। এখনও কেউ খাবারের ব্যাপারে কিছু জানতে আমাকে ফোন করেন। পুরোটাই মায়ের দাক্ষিণ্যে। শুনেছি, খুব ছোটবেলায় মা ভাত মেখে বড় বড় গ্রাসে খাইয়ে দিতেন এবং সেই গ্রাস নাকি বাকি বাচ্চাদের দুটো বা তিনটে গ্রাসের সমান! সঙ্গে নানা ধরনের গল্প। বাচ্চারা সাধারণত যখন খাওয়া নিয়ে ঘ্যানঘ্যান করে আমি কিন্তু তখন খুবই আগ্রহ নিয়ে খেতাম। সবটাই মায়ের কারণে।
ঠিক উল্টো ছবি স্কুলে ‘গার্জেন মিটিং’-এর সময়। ছোট থেকে খুব দুষ্টু। নানা কারণে স্কুল থেকে ডাক পড়ত। ফলে, বছরশেষে মিটিংয়ের জন্য অভিভাবকদের ডাক পড়লেই মা সিঁটিয়ে যেতেন। সেই মিটিংয়ে যাওয়ার দায়িত্ব বাবার। বাইরের অনুষ্ঠানে নিয়ে যাওয়ার আগে মা স্কুলে যেতেন। অধ্যক্ষের কাছে আন্তরিক ভাবে জানতে চাইতেন, তিনি কী করবেন। সঙ্গে সঙ্গে আমার ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের ‘ফাদার’ অনুমতি দিয়ে দিতেন। বলতেন, “বিদেশে ঘুরে আপনার ছেলে যতটা শিক্ষিত হবে, চার দেওয়ালের মধ্যে থেকে সেটা ও পাবে না। নিশ্চিন্তে নিয়ে যান।”
বিখ্যাত পরিবারের সন্তান... এই চাপ বাইরের
বিখ্যাত পরিবারের সন্তান হওয়ার সুবিধে যেমন, অসুবিধেও অনেক। অন্যেরা তেমনই বোঝেন। আমাকে সে সব ভোগ করতে হয়নি। বরং, বেড়ে ওঠার সময় প্রচুর স্বাধীনতা পেয়েছি। তার মানে এই নয়, আমরা উচ্ছৃঙ্খল। সে সবের সুযোগ আমরা পাইনি। প্রচণ্ড নিয়মানুবর্তিতার মধ্যে বড় হয়েছি। কিন্তু কী পড়ব বা বড় হয়ে কী হব— সেটা স্থির করার স্বাধীনতা আমার ছিল। তার পরেও বলব, পারিবারিক প্রভাব সেই পরিবারের সদস্যদের উপরে থেকেই যায়। সেই জায়গা থেকেই আমি সঙ্গীত পরিচালক। যেমন আমার মামা আনন্দশঙ্কর ছিলেন। তবে বিখ্যাত পরিবারের সন্তান হওয়ার চাপ পরিবারের অন্দরের তুলনায় পরিবারের বাইরে যেন বেশি। অন্তত আমার জীবন দিয়ে সেটাই বুঝেছি। আর একটি কথা, কঠোর নিয়মানুবর্তিতার মধ্যে বড় হলেও কখনও সেটা দমবন্ধকর পরিস্থিতি তৈরি করেনি। কারণ, নিয়ম মানতে বলার পাশাপাশি কেন সেই নিয়ম মানব— সেটাও বুঝিয়ে দেওয়া হত। কোনও কিছু জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হত না। আরও একটি কথা, শৃঙ্খলা শেখানোর পাশাপাশি মা খুব ভাল বন্ধুও। বড় হয়ে প্রেমে পড়ার পর একমাত্র মাকেই জানাতে পেরেছিলাম। তা বলে আমাদের মধ্যে কখনও কি মনোমালিন্য হয়নি? হয়েছে। আমরা সেটা মিটিয়েও নিয়েছি।
সফল নারীর পিছনে পুরুষ থাকেন...
সেটাই আমার বাবা, চন্দ্রোদয় ঘোষ। অনেকেই জানতে চান, মায়ের ছায়ায় আমি, আমার ভাই বা বাবা ঢাকা পড়ে গিয়েছি কি না। আমি দায়িত্ব নিয়ে বলছি, কখনওই না। বরং মায়ের অনুষ্ঠানে বাবার উপস্থাপনা বা সঞ্চালনা, তত্ত্বাবধানের একটা বিশেষ জায়গা থাকে, বরাবর। দর্শক তা ভীষণ পছন্দ করেন। অনেকে সে কথা জানিয়েওছেন। এ-ও দাবি তাঁদের, বাবার উপস্থাপনা না থাকলে মায়ের অনুষ্ঠান যেন অসম্পূর্ণ। এটা বলতে পারেন, সফল পুরুষের পিছনে যেমন একজন নারী থাকেন, একই ভাবে সফল নারীর পিছনে একজন পুরুষ। ঠিক যেমন আমার মা আর বাবা। বাবা মাকে আগলে না রাখলে মা কি এত সফল হতেন?
কেমন শাশুড়ি?
এটা আমার গিন্নি সুদেষ্ণা বেশি ভাল বলতে পারবে। আমি ছেলে হিসাবে বলছি, মা কোনও দিন বৌমাদের উপর জোর করে কিছু চাপিয়ে দেন না। কিছু মনে হলে সোজাসুজি বৌমাদের সঙ্গেই বোঝাপড়া করে নেন। ছেলেদের মাঝখানে রাখেন না। এমনও হয়েছে, মা-বৌমাদের মিটিংয়ের কিছুই আমরা দুই ভাই টের পাইনি!
রইল বাকি বিতর্ক...
আমার মা একটুও প্রাচীনপন্থী নন। ভীষণ আধুনিক। কিন্তু নিজের অস্তিত্ত্ব, নিজের সংস্কৃতি, নিজের শিকড় বাদ দিয়ে নয়। সেই উপলব্ধি বা বিশ্বাস থেকে মা নিজের মতামত জানান। সম্প্রতি মায়ের কথায় প্রচুর বিতর্ক তৈরি হয়েছে। কিছু করার নেই। কিছু মানুষ এই কাজ করতেই যেন বসে থাকেন। তাঁরা তাঁদের কাজ করেছেন। মা তা বলে নিজের বিশ্বাস থেকে নড়েননি। বরং বলেছেন, আমাদের দেশের সংস্কৃতি যথেষ্ট উন্নত। আমরা সে সব ফেলে পাশ্চাত্যের ফেলে দেওয়া অভ্যাস আপন করে নিচ্ছি। মা নিজে স্থির বলেই এত বিতর্কের পরেও স্বাভাবিক। এ সব মাকে ছুঁতেই পারে না। একই ভাবে আমাদেরও।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy