২০০ নাটকের নায়ক-নায়িকা দেবশঙ্কর হালদার, সেঁজুতি মুখোপাধ্যায়। ছবি: ফেসবুক।
মঙ্গলবার দেবশঙ্কর হালদারের নাটক ‘টিনের তলোয়ার’ দেখতে গিয়েছিলাম। বুধবার ওঁর জন্মদিন। আগাম শুভেচ্ছা জানিয়ে এসেছি। দিনের দিন ওঁকেই বরং পিছন ফিরে দেখি? নাট্য পরিচালক, নাট্য ব্যক্তিত্ব দেবশঙ্কর। পর্দাতেও সমান সাবলীল। বড় পর্দার পাশাপাশি ছোট পর্দাতেও। ওঁর সঞ্চালনায় ‘হ্যাপি পেরেন্টস ডে’ বা ‘আপনি কী বলেন’ জনপ্রিয়। একই ভাবে দর্শকপ্রিয় দেবুদার অভিনীত ধারাবাহিক ‘বিন্নি ধানের খই’, ‘লক্ষ্মী কাকিমা সুপারস্টার’।
এগুলো তো আপনারা জানেনই। আজ বরং ‘ব্যক্তি’ দেবশঙ্করের কথা হোক। দেবুদার সঙ্গে কম করে দেড়শো থেকে দুশো নাটক মঞ্চস্থ করেছি। এত দিন ধরে কাজ করলাম। নেতিবাচক কিছুই চোখে পড়ল না! সব বিষয়ে ভীষণ পরিমিতি বোধ। আর নাটকের প্রতি অসীম শ্রদ্ধা। এই দুইয়ে মিলে আমার দেবুদা। আমরা হয়তো কোনও মহড়ায় পৌঁছেছি। গিয়ে দেখি, দলের বাকিরা নেই। দেবুদা তার অনেক আগেই পৌঁছে গিয়েছেন। বাকিরা দেরি করে আসছেন বলে কোনও বিরক্তি নেই। ওঁরও সময়ের দাম আছে। হয়তো পরের শো-ও আছে। তার পরেও রাগ নেই! নীরবে, হাসিমুখে প্রতীক্ষা করেন সকলের জন্য। কখনও কারও কিছু অপছন্দ হলে যখন বলেন, সেই বক্তব্যের শব্দচয়নেও অদ্ভুত পরিমিতি বোধ! এর ফলে, যার উদ্দেশে তিনি বলছেন সে হয়তো বুঝলই না। বাকিদের মধ্যে যাঁদের বোধ রয়েছে তাঁরাই কেবল বুঝলেন।
কী করে একজন মানুষ এতটা পারেন? আজও বুঝে উঠতে পারলাম না।
এই পরিমিতি বোধ অভিনয়ের ক্ষেত্রেও। মঞ্চে অভিনয় করতে গিয়ে এই পরিমিতি বোধ আরও এক নাট্য ব্যক্তিত্বের মধ্যে দেখেছি। তিনি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। এঁরা সহ-অভিনেতার জন্য কী যে আরামের, বলে বোঝানোর নয়। এঁরা মঞ্চে ভীষণ সুবিধা করে দেন। একই সঙ্গে ভরসার জায়গাও। সহ-অভিনেতা মঞ্চেই যদি কোনও সমস্যায় পড়েন এঁরা সেটাও উতরে দেন। একটা উদাহরণ দিই। এক বার আমাদের ‘মূল্য’র একটা শো হতে হতে উপর থেকে জ্বলন্ত বাল্ব ফেটে গরম কাচ ছড়ি়য়ে পড়ল। আমিও ছিলাম, দেবুদাও ছিলেন মঞ্চে। তিনি এমন ভাবে অভিনয় করতে করতেই সরে গেলেন যে দর্শক বুঝতেই পারল না। অথচ, আমিও সরে যাওয়ার সুযোগ পেলাম। আবার নাটকেও বিঘ্ন ঘটল না।
এই কারণেই দেবুদা সকলের কাছের মানুষ। মঞ্চ দুনিয়ার প্রথম তারকা। তার পরেও ধরাছোঁয়ার মধ্যে থাকেন। এই জন্যই তিনি এত জনপ্রিয়। আর একটা ওঁর রসবোধ। এত বুদ্ধিদীপ্ত রসিকতা করতে পারেন! মাঝেমধ্যে তাই নিয়ে আমাদের মধ্যে টক্করও চলে। এখানেও একটা মজার গল্প আছে। একবার আমরা একটা শো করে ফিরছি। সেই সময় ছোট পর্দায় দেবুদার সঞ্চালনায় ‘হ্যাপি পেরেন্টস ডে’ রিয়্যালিটি শো চলছে। আমরা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কামরায় বসে। অনেকেই চিনতে পেরে সই বা ছবি তুলে নিয়ে যাচ্ছে। তার মধ্যেই একজন বয়স্কা সহযাত্রী আমাদের চিনতে পেরেছেন। দেবশঙ্করদার সঙ্গে আছি। ওঁর মনে হয়েছে আমিও কেউকেটা। তাই বার বার বলছেন, ‘আপনাকে কোথাও দেখেছি।’ হঠাৎ করে জানালেন, তাঁর মনে পড়েছে। আমি ‘রচনা বন্দ্যোপাধ্যায়’! সঙ্গে সঙ্গে দেবশঙ্করদা বললেন, ‘আপনি ঠিকই বলেছেন। তবে উনি রচনা নন, উনি প্রবন্ধ!’ ওই যাত্রী বুঝলেন না। আমি হেসে সারা। যে হেতু কলেজে পড়াই তাই আমাকে ওঁর সম্বোধন, ‘এই যে প্রফেসর’।
লেখার আগে আনন্দবাজার অনলাইনের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। আমি ওঁর প্রচুর নাটকের নায়িকা। তাই জানতে চাওয়া হয়েছিল, পর্দার নেপথ্যে দেবশঙ্কর হালদার কতটা রোম্যান্টিক? পাঠক এবং দেবুদার অনুরাগীদের আশাহত করছি, উনি একটুও রোম্যান্টিক নন। ওখানেও ওঁর অসম্ভব পরিমিতি বোধ। ধরুন, নাটক শেষের পর আমরা বাড়ি ফিরছি। সবার শেষে হয়তো আমি নামব। তার আগে দেবুদা বাড়ি ফিরে এক দিনের জন্য ফোন করে খোঁজ নেননি, আমি সুস্থ ভাবে বাড়ি ফিরেছি কি না! কত দিন বলেছি, নাট্য পরিচালক হিসাবে এক বার খোঁজও নেবেন না, সহ-অভিনেতারা ঠিক মতো বাড়ি পৌঁছলেন কি না? কোনও তাপ-উত্তাপই নেই। আসলে, কিছুতেই বাড়তি অনুভূতি প্রকাশ করতে রাজি নন।
অথচ, মঞ্চে নাটকের কারণে এই মানুষটার জন্যই দুর্বল হয়ে কত বার মরেছি! না হলে নায়ক-নায়িকার রসায়ন ফুটে উঠবে কী ভাবে? খুব প্রেমে না পড়লে এই ধরনের অভিনয় সম্ভব! এই প্রসঙ্গে আবার একটা মজার ঘটনা বলি আপনাদের। আমি আর দেবশঙ্করদা দিল্লি থেকে ফিরছিলাম। সেই দিনই ওঁর জন্মদিন। বলেছিলাম, সব জায়গাতেই বোধ হয় কেক কেটেছেন। মাঝ আকাশে নিশ্চয়ই কেক কাটা হয়নি। আজ না হয় সেটাই হোক। বিমানবন্দর থেকে কেক কিনে সেই প্রথম মাঝ আকাশে কেক কাটা হয়েছিল।
একসঙ্গে এত নাটক মঞ্চস্থ করার দৌলতেই হোক বা দীর্ঘ দিন পেশার দুনিয়ায় পথ চলার কারণে, আমরা পরস্পরের এতটাই পরিচিত যে আলাদা করে কোনও কিছুরই আর দরকার পড়ে না। ঝগড়া, কথা কাটাকাটি, মান-অভিমান— কিচ্ছু না। তাই দেবশঙ্করদার জন্মদিনে আজও কোনও গোলাপের তোড়া পাঠানো হয়নি।
এত বলার পরেও বলব, যদি কিছু পাঠাতেই হয় তা হলে রক্তলাল গোলাপ নয়, দেবশঙ্কর হালদারকে সেঁজুতির রক্তকরবী পাঠানোর খুব ইচ্ছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy